Cvoice24.com

চট্টগ্রামে আজ, বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪

সময় ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড


সাতকানিয়ায় ফুলের রাজ্য চর খাগরিয়া

প্রকাশিত: ১৫:০১, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০
সাতকানিয়ায় ফুলের রাজ্য চর খাগরিয়া

বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষের জন্য সাতকানিয়া উপজেলার খাগরিয়া ইউনিয়নের চর খাগরিয়া গ্রামটির সুখ্যাতি দীর্ঘদিনের। মৌসুমে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দিবসকে উপলক্ষ করে এখান থেকে সারাদেশে কোটি টাকার  ফুল বিক্রি হয়ে থাকে প্রতি বছর। বিগত এক শতাব্দী কালের অধিক সময় ধরে এই গ্রামে ফুল চাষ হয়ে আসছে। ইতোমধ্যে ফুল চাষ করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন এ এলাকার অর্ধশতাধিক পরিবার। এজন্য ধীরে ধীরে এ এলাকার কৃষকরা ফুল চাষে ঝুঁকে পড়েছে। ফুল চাষে চাষীদের যেমন ভাগ্য পরিবর্তন ঘটে তেমনি সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে পায় ওই এলাকার খেটে খাওয়া দিন মজুররা। ফুলের মৌসুমে সংসার স্বচ্ছলতা ফিরাতে ফুল তোলা ও মালা গাঁথার কাজে নিয়োজিত হয় শত শত নারী ও  শিশুসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠি
 
সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার খাগরিয়া ইউনিয়নের চর খাগরিয়া গ্রামে কোন অনাবাদি খালি জমি নাই। বিশাল মাঠজুড়ে হরেক রকম ফুল চাষ। এ এলাকায় সাধারনত  গাঁদা, বাসন্তি গাঁদা, ইন্ডিয়ান খাঁসি গাঁদা, লাল গাঁদা, চায়না বেলি, জবা, বোতাম, গ্ল্যাডিওলাস, জিপসি, গোলাচী, ডালিয়া ও স্বর্ণপুটি প্রজাতির ফুল চাষ হয়ে থাকে। যত দূর চোখ যায় শুধু নানা রংয়ের হরেক রকম ফুল আর ফুল। মাঠের মাঝখানে আঁকাবাঁকা গ্রামীন সড়কের দুই পাশে লাগানো স্টার ফুল যেন পথচারীদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
মাঠে ফুল তোলার কাজে ব্যস্ত সময় ফুল চাষীসহ এলাকার নারী ও শিশু শ্রমিকরা। দল বেঁধে একঝাঁক শিশু গাঁদা ফুল তোলে বস্তাভর্তি ও ড্রাম ভর্তি করছে। 

এসময় তাদের সাথে কথা হলে তারা জানান, তাদের পরিবারে অভাব অনটন যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। শিশু শ্রমিকের অধিকাংশই আবার স্কুল ও মাদ্রাসা পড়ুয়া। শ্রেণি কার্যক্রম শেষ করে এসে দরিদ্র পরিবারকে একটু সহযোগিতা করতে প্রতিদিন তারা মিলে ক্ষেতে ফুল তোলার কাজে শ্রমিকের হিসেবে লেগে পড়ে। প্রতি বস্তায় ফুল ভরে মজুরি হিসাবে পায় ১০০ টাকা। এভাবে শিশুগুলো দৈনিক সংসারে ঘানি টানার মত মজুরি না পেলেও মোটামুটি অভাবের সংসারে ডালভাতের ব্যবস্থা করার মত মজুরি পেয়ে থাকে। এই মজুরি সামান্য হলেও বড় জোগান হয়ে উঠে দরিদ্র পরিবারে। 

ফুল চাষী মোহাম্মদ বেলাল হেসেন জানান, ফুল চাষ করে এ গ্রামেরই চোখের সামনে অনেকে লাখপতি হয়েছেন। আমি এক সময় জমিতে সবজি চাষ করতাম। সবজির তুলনায় ফুল চাষে লাভের আধিক্য হওয়ায় ঝুঁকে পড়েছি ফুল চাষে। এ বছর ১০ কানি জমিতে গ্ল্যাডিওলাস সহ বিভিন্ন জাতের ফুল চাষ করেছি। তবে গ্ল্যাডিওলাস একটু বেশি করেছি। এ মৌসুমে আমি সবচেয়ে বেশি জমিতে ফুল চাষ করেছি। গ্লাডিওলাসে অন্য ফুল চাষের তুলনায় উৎপাদন খরচ একটু বেশি। গ্ল্যাডিওলাস ফুল চাষে প্রতিকানি উৎপাদন খরচ ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা। অপরদিকে অন্যান্য ফুল চাষে উৎপাদন খরচ প্রতিকানি ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। বাজার ভাল থাকলে প্রতিকানি উৎপাদিত গ্ল্যাডিওলাস বিক্রি করে খরচ পুষিয়ে দ্বিগুন কিংবা তিনগুন লাভ পাওয়া যায়।অনুরূপভাবে অন্যান্য ফুলের ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ পুষিয়ে অর্ধ লক্ষ টাকা লাভ পাওয়া যায়। তাছাড়া সরকারি বিভিন্ন দিবসে লাভের অতিরিক্তি লাভও পাওয়া যায় বলে অনেকে জানান।


 
অপরদিকে চার খাগরিয়া এলাকার মাঠের ফুল চাষীরা আক্ষেপ করে বলেছেন, এক সময় সংসারে অভাব অনটনের ফুল চাষে স্বচ্ছলতা ফিরে পায়। মাঝখানে দীর্ঘ কয়েক যুগ স্বচ্ছলতার মধ্যে কেটে গেলে ফুল চাষে আবার আকাল দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়ত একদিন ফুল চাষই বন্ধ হয়ে যাবে। বর্তমান প্রকৃতভাবে উৎপাদিত ফুলের জায়গা দখল করে নিচ্ছে প্লাষ্টিকের তৈরি ফুল। যার কারনে দিন দিন চাষের ফুলের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে। প্লাষ্টিকের তৈরি ফুলের কদর বাড়ছে কারন এ ফুল নষ্ট হয়না বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে একবার কিনে বারবার ব্যবহার করা যায়। পক্ষান্তরে চাষের ফুল একাধিকবার ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। ফলে প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে ক্ষেতের উৎপাদিত ফুল।

যদিওবা অনেকে বলেছেন, আগের তুলনায় দাম বেশী হলেও চাহিদা হ্রাস পাওয়ার কারনে বর্তমান ফুল চাষে লাভ আশা করা খুব কঠিন। 

গ্ল্যাডিওলাস চাষী আবুল হোসেন ও বেলাল হোসেন জানান, ফুলের চারা লাগানোর পর পর বৃষ্টি হওয়ায় গ্ল্যাডিওলাস বাগানে রোগ বালাই দেখা দিয়েছে। গ্ল্যাডিওলাস  চারা অবস্থায় বৃষ্টি সহ্য করতে পারে না। সে কারনে এক ধরনের ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছে আমার গ্ল্যাডিওলাস বাগান। যার কারনে একটু চিন্তিত তবে ভেঙ্গে পড়িনি। আশা করি পুষিয়ে নিতে পারব।  

গ্ল্যাডিওলাস চাষী কামাল উদ্দিন, জালাল আহমদ, মোহাম্মদ বেলাল হোসেন, গাঁদা ফুল চাষী মোহাম্মদ মুন্সি মিয়া, ফরিদুল আলম, মোহম্মদ সেলিম, আবুল হোসেন, মোহাম্মদ শফি, স্বর্ণপুটি ফুল চাষী আমীর জানান, ফুলের বাগান করতে খরচ ও শ্রম একটু বেশি হলেও লাভ যে কমতা নয়। শুধুমাত্র বর্তমানে প্লাষ্টিকের ফুল আমাদেরকে সর্বনাশ করেছে।   এ গ্রামে ফুল চাষ অব্যাহত থাকলে আর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই অনেকে কোটিপতি হয়ে যেত। আমাদের অনেকে ফুল চাষ করে চট্টগ্রাম শহরে ফুলের আড়ত ও  দোকান প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্লাষ্টিকের ফুল বাজারে আসার পর থেকে এখানে পাইকারদের ভিড় কমে গেছে।  দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারদের আনাগোনা দেখাই যাচ্ছে না। 

চাষীরা জানান, বর্তমানে গ্ল্যাডিওলাস ফুলে কিছু দাম পাওয়া যাচ্ছে।  বর্তমানে প্রতিপিস গ্ল্যাডিওলাস ১০-১২ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। 

ফুল চাষী মোহাম্মদ মুন্সি মিয়া জানান, এ বছর আমি ১ কানি ৩ গন্ডা জমিতে গাঁদা ফুলের চাষ করেছি। মানুষ লাভের পিছনে দৌঁড়ে। লোকসানের দিকে কেউ যেতে চায়না। আমি ও এর ব্যতিক্রম নই। গ্রামে ফুল চাষ লাভজনক হিসাবে গড়ে উঠায় আমি সবজি চাষ ছেড়ে ফুল চাষে ঝুঁকে পড়েছি। ব্যাপক সফলতাও পেয়েছি।  আমাদের দেশে সারা বছর বিয়ে কিংবা নানান অনুষ্ঠান লেগেই থাকে । তবে  বছরের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দিবস, ভালবাসা দিবস, বিয়ে ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ের লগ্নকে ঘিরে ফুলের চাহিদা বাড়ে ও দামও থাকে বেশী। বর্তমানে প্লাষ্টিকের ফুল আমাদের এ ব্যবসায় দারুনভাবে আঘাত হেনেছে। 

ফুলের বাগান হতে ফুল তুলতে রসুলপুর মাদ্রাসার ৪র্থ শ্রেনির ছাত্র আমীর হামজা(৯), ৯ম শ্রেনির ছাত্র এনামুল হক(১৪),খাদিম আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেনির ছাত্র আরমান(১৩), আমজাদ হোসেন(১৩), ৬ষ্ট শ্রেনির ছাত্র রবিউল হাসান(১১) ও খাদিম আলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩র্য় শ্রেনির ছাত্র লতিফুল ইসলাম(৯)ও নুরুল আবছার(৯) ও ২য় শ্রেনির ছাত্র সাইমন(৭) জানান, মাদ্রাসা ও স্কুল ছুটির পর তারা বাগানে ফুল তুলতে আসেন। এক বস্তা ফুল তুলে দিলে তারা পায় ১০০ টাকা। আবার ওই ফুল দিয়ে ১ টি লড়া গেঁথে দিলে প্রতি লড়ায় পায় ১ টাকা।

জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে এই গ্রামে প্রচুর পরিমাণ ফুল চাষ হয়ে আসলেও উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে ফুল চাষীদের প্রতি উন্নত পরিসরে সেবা প্রদান করা হয় না। এসব ফুল চাষীরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এবং প্লাষ্টিকের ফুলের আগ্রাসন রোধ করতে পারলে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ফুল বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব বলে অনেকে জানিয়েছেন। 

সাতকানিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রতাপ চন্দ্র রায় বলেন, চলতি বছর উপজেলায় ৭ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হয়েছে। ফুল চাষ করে চর খাগরিয়ার কৃষকরা প্রচুর সফলতা পেয়েছেন। ওই গ্রামে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ফুল চাষ। ফুল চাষ করে অনেকে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই গ্রাম থেকে উৎপাদিত ফুল বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানি দেশ-বিদেশেও করা সম্ভব। 

তিনি আরো বলেন, ভাইরাস আক্রান্ত গ্ল্যাডিওলাস  বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করেছি। নতুন রোগ সে কারনে প্রতিকারের বিষয়ে একটু চিন্তা ভাবনা চলছে। তাছাড়া প্লাষ্টিকের ফুলের আগ্রাসনের বিষয়ে সরকারের উর্ধ্বতনদের সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। 
 

জাহেদ হোসাইন, সাতকানিয়া

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়