Cvoice24.com


ফাল্গুন চৈত্রের অপূর্ব মিলনে বাঙালীর বসন্ত

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০
ফাল্গুন চৈত্রের অপূর্ব মিলনে বাঙালীর বসন্ত

ফাইল ছবি।

সহসা খুলিয়া গেল দ্বার
আজিকার বসন্ত প্রভাতখানি

দাঁড়াল করিয়া নমস্কার:  কবি নজরুলের এই পঙক্তিমালার  মধ্য দিয়ে  প্রকৃতির রাণী  বসন্তের আবির্ভাব ঘটে মনোহর ধরায়। ফাল্গুন চৈত্রের অপূর্ব মিলনে বাঙালীর বসন্ত। বসন্তে বাঙালীর জীবননাট্যে সংযোজিত হয় নবতর আমেজ।হিমহিম রুক্ষ শীতের শুষ্কতা, রিক্ততা যে প্রকৃতিতে উদাসীনতা ও বৈরাগের জন্ম দেয় সে প্রকৃতি বসন্তের পরশ পাথরের স্পর্শে রূপায়িত হয় নববধূর অপরুপ সৌন্দর্য্যে। ফাগুনের রুপালী ছোঁয়ায় প্রকৃতি সাজে শতরঙের নজরকাঁড়া ক্যানভাসে। সুরের বিহঙ্গী কোকিলের কুহু কহু তান আর বউ কথা কও পক্ষীকুলের সুমধুর গীতে আলোড়িত হয় আবহমান প্রকৃতির চিত্রপট। শালিক,ময়না, টিয়ার কলকাকলিতে নির্জীব প্রকৃতির প্রাণে ফিরে আসে কর্মচাঞ্চল্য।  ফাগুনের অনুষঙ্গ ভ্রমরের নৃত্যে কাননের পুষ্পসম্ভারে বয়ে যায় রোমাঞ্চের ঢেউ। মৌমাছির দল ফুলের মধু আহরণে ছুটে চলে বন বনান্তের পানে।
প্রকৃতির এই বিচিত্র লীলাখেলায়

 আত্নহারা কবি গাহিয়া বেড়ায়,
    এলো বনান্তে পাগল বসন্ত।
বনে বনে মনে মনে রঙ সে ছড়ায় রে,
    চঞ্চল তরুণ দুরন্ত।
বাশিঁতে বাজায় সে বিধুর পরজ বসন্তের সুর,
    পান্ডু-কপোলে জাগে রঙ নব অনুরাগে,
 রাঙা হল ধূসর দিগন্ত।

অতঃপর বদলে যাওয়া প্রকৃতি খুলে দেয় তার দক্ষিণ দুয়ার। দখিনা হাওয়ার মৃদু শীতলতার আতিসয্যে কাব্যপ্রেমীদের হৃদয়ে সৃষ্টি হয় পরম সুখের আবহ। কবি তার কাব্যে বসন্তকে বরণ করেছেন কাব্যরসের অমিয় সুধায়  যা শোভা পায় কবির আপন ভঙ্গিমায়   :
আজ দখিন দুয়ার খোলা
এসো হে এসো হে এসো হে আমার বসন্ত
এসো দিক হৃদয় দোলায় দোলা
এসো হে এসো হে এসো হে আমার বসন্ত এসো।

হিমশীতল দক্ষিণা হাওয়ার পরম স্পর্শ কবিমনে অনাবিল মোহের সৃষ্টি করে। সেই মোহের তালে তালে কবির সুরেলা কন্ঠে ফুটে ওঠে,
      ফুলরেণু মাখা দখিনা বায়
      বাতাস করিছে বন বালায়।

বসন্তের ছোঁয়ায় শীতের জীর্ণ শীর্ণ খোলস ছেড়ে বৃক্ষরাজি নব কিশলয়ে  সজ্জিত হয়।রক্তাক্ত পলাশ ও রাঙা শিমুলের সমারোহে প্রকৃতি হয় সুশোভিত।ফুটন্ত কৃষ্ণচূড়া,রাঁধাচূড়া তরু যেন প্রজ্জ্বলিত আগুনের লেলিহান শিখা। বাসন্তী, বেলী, জুঁই, মল্লিকা, মালতি, পারুল, রক্ত জবা, কাঞ্চন, পারিজাত, মাধবী, গামারী, চামেলী, রজনীগন্ধা, হাসনাহেনা এবং হরেক রঙ ও ঢঙের  গাঁধা ফুলের  অনুপম নৈসর্গিক  সৌন্দর্য্য প্রকৃতিতে যোগ করে অপার মহিমা। মৌসুমী ফুলের স্নিগ্ধ সৌরভে প্রকৃতি হয়ে ওঠে নির্মল। আম্র মঞ্জরীর মৌ মৌ গন্ধে সুবাসিত হয় আবহমান বাংলার আকাশবাতাস। প্রকৃতির এই রুপ রস গন্ধ কবিমনে জাগিয়ে তোলে প্রেমময় আকুল আবেদন। তাইতো কবিকন্ঠে ফুটে ওঠে,
 "আজি এ বসন্ত দিনে বাসন্তী রঙ ছুঁয়েছে মনে;
  মনে পড়ে তোমাকে ক্ষণে ক্ষণে
  চুপি চুপি নিঃশব্দে  সঙ্গোপনে।" মহাকালের পথপরিক্রমায় বসন্ত উৎসব হয়ে উঠেছে  বাঙালী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বসন্তবরণকে সামনে রেখে বাঙালীরা মেতে উঠে উৎসবের বর্ণিল আমেজে।

মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলা নববর্ষের প্রথম যাত্রা শুরু। তখন প্রচলিত ১৪টি উৎসবের মধ্যে বসন্ত উৎসব উল্লেখযোগ্য। আগুন রাঙানো ফাগুন একদিকে যেমন প্রকৃতির হৃদয়পটে উচ্ছ্বাসের ঢেউ তুলে তেমনি অন্যদিকে তারুণ্যের প্রাণে বইয়ে দেয়  উচ্ছ্বাসের  জোয়ার। বসন্তের আয়োজনে   তরুণ তরুণী সাজে বসন্তের অপরুপ সাজে। বাসন্তী শাড়িতে সাজা তরুণীর খোঁপায় শোভা পায় রঙবেরঙের গাঁদাফুল। তরুণদের পরনে বাহারি পাঞ্জাবি নজরকাঁড়ে। শিশু কিংবা বয়োবৃদ্ধের বসনেও ফাগুনের চিরায়ত স্পর্শ। যা সৃষ্টি করে অনন্য দৃশ্যপট।বসন্তের আবেগমাখা বর্ণিল স্বপ্নিল পরিবেশে উল্লসিত হয় তারুণ্যের প্রতিটি স্পন্দন। গান, কবিতা, ভালবাসার ত্রয়ী আবেদন প্রেমিকপ্রেমিকার হৃদয়ে জাগায় প্রিয় মিলনের গোপন অভিসার। ফাগুনের এই অনাবিল রুপ জৌলস ও প্রকৃতির নয়নাভিরাম মাধুর্যতা, মন্ত্রমুগ্ধতার মাঝে প্রমিক সত্তা হারিয়ে যায় স্বর্গীয় মর্ত্যলোকে।

পরিশেষে ঘটে ঋতুর রুপ বদল। প্রকৃতি তার চিরচেনা রূপে আবির্ভূত হয়। বসন্তের চিরযৌবনা রুপ মিলায়ে যায় ঘোর অন্ধকারে। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে প্রকৃতি হয়ে পড়ে মলিন। একসময় আকাশপটে শরু হয় মেঘের তর্জন-গর্জন। বসন্ত হারিয়ে যায় বটে, ফেলে যায় তার ভুবনজয়ী উচ্ছ্বাস। বসন্তের এই অনন্ত সৌষ্ঠব সৌরভে বিমোহিত হয়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ফুল ফুটুক আর না ফুটুক এখন যে বসন্ত।

-সিভয়েস/এসসি

ফছিহুল হক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়