Cvoice24.com

হুমকির মুখে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র
বাঁশখালীতে ইটভাটায় কাঠ পোড়ানোর অভিযোগ, প্রশাসন নিরব!

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ৭ ডিসেম্বর ২০১৯
 বাঁশখালীতে ইটভাটায় কাঠ পোড়ানোর অভিযোগ, প্রশাসন নিরব!

ছবি : সিভয়েস

সরকারি নিয়ম নীতি না মেনে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় ইট ভাটাগুলোতে কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ানোর অভিযোগ করছে স্থানীয়রা। ইটভাটায় দিন দুপুরে কাঠ পোড়ানো হলেও  প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই বলে বিভিন্ন সুত্রের অভিযোগ।    

অভিযোগ রয়েছে, বাঁশখালীর বাহারছড়ায় ৩টি ইট ভাটার মধ্যে ১টিতে ১২০ফুট চিমনি থাকলেও অপর গুলোতে পুরাতন আমলের ড্রাম চিমনির মাধ্যমে ইট পোড়ানো হচ্ছে। ফলে আশেপাশের পরিবেশের চরম বিপর্যয় হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর বা জেলা প্রশাসনের কোনো অনুমোদন ছাড়াই এসব ইটভাটা গুলো গড়ে তুলেছেন।

স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, বাঁশখালী ১ নং পুকুরিয়া ইউনিয়নের চা-বাগান সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে জিকজ্যাগের পরবর্তীতে গড়ে তোলা হয়েছে লম্বা চিমনির মেসার্স চৌধুরী ব্রীক নামের নবনির্মীত ইটভাটা। তাছাড়া সাতকানিয়া - বাঁশখালী সীমান্ত চূড়ামণি এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে তোলা হয়েছে ৫টি ইটভাটা। একইভাবে বাহারছড়া ইউনিয়নের ইলশা গ্রামে দুই কিলোমিটারের ব্যবধানে জনবসতি ও কৃষি জমিতে গড়ে উঠেছে  ৩টি ইটভাটা, চাম্বল-বড়ঘোনা সড়কের পাশেই লোকালয়ে ১টি, শেখেরখীল-ছনুয়া সড়কে ১টি, বাঁশখালী পৌরসভার দক্ষিণ জলদী পাহাড়ের পাদদেশে ১টি রয়েছে তবে বর্তমানে ২ বছর যাবৎ সেটি বন্ধ রয়েছে।  

তথ্যমতে, নির্দিষ্টভাবে ১২০ ফুট চিমনির মাধ্যমে ইট পোড়ানোর নিয়ম থাকলেও দু’একটা ছাড়া কয়েকটি ইট ভাটা সেই নিয়মও মানছে না। ইতোপূর্বে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইট ভাটা গুলোতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে আর্থিক জরিমানা করা হয়। কিন্তু পরিবেশ নানান ভাবে হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়লেও এই ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।

বাহারছড়া ইউনিয়নে ৩ কিলোমিটারের দূরতে কৃষি জমি ও জনবসতি এলাকায় রয়েছে ৩ টি ইটভাটা। আর এসব ইটভাটা গুলোর লাগোয়া রয়েছে কয়েক গ্রামের হাজার মানুষের বাস। স্থানটি কোনোভাবেই ইটভাটা স্থাপনের জন্য উপযুক্ত নয়। ইট পোড়ানোর ফলে এই এলাকার জনস্বাস্থ্য যেমন হুমকির মুখে পড়ছে, তেমনি আশপাশের বনাঞ্চলও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একবার ইট পোড়াতে প্রায় চারহাজার মণ কাঠ পোড়াতে হয়। এসব কাঠ জোগাড় হচ্ছে আশপাশের সংরক্ষিত বন থেকেই। ফলে উজাড় হয়ে যাচ্ছে গাছপালা। কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়ছে। হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ। প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন  ইটভাটা গুলো গড়ে উঠলেও তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। শুধু বাহারছড়ায় নয়, চাম্বল, জলদী, শেখেরখীল, পুকুরিয়াতে এভাবে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে লোকালয় ও ফসলি জমিতে অনেক ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এসব অবৈধ ইটভাটায় কয়লার পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ। একটা সময় এর পরিণাম হবে ভয়াবহ।

পরিবেশ আইন, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন আরও কঠোর করা ও তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতের দাবি স্থানীয়দের। অবৈধ ইটভাটার মালিকরা দাবি করেছেন, তাঁদের পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাশোহারা দিয়ে ইটভাটা চালু রেখেছেন।

তারা বলেন, শুরুতে তাঁরা ড্রাম চিমনি পদ্ধতির ভাটায় ইট পোড়াতেন। পরে সরকার ১২০ ফুট উঁচু চিমনি দিয়ে ইটভাটা তৈরির নির্দেশনা দেয়। এর পরিপ্রক্ষিতে বেশির ভাগ ইটভাটা ১২০ ফুট উঁচু চিমনিতে রুপান্তরিত করা হয়। সর্বশেষ সরকার নতুন এক নির্দেশনায় জিগজ্যাগ কিলন, হাইব্রিড কিলন, ভারটিক্যাল স্যাফট কিলন, টানেল কিলন পদ্ধতিতে ইটভাটা প্রস্তুতের নির্দেশনা জারি করে। তবে তারা সেই নীতিমালা মানছে না। কারণ, এরই মধ্যে সব ভাটায় ইট পোড়ানো শুরু হয়ে গেছে। আগামী মার্চ-এপ্রিল পযর্ন্ত চলবে ইট পোড়ানো। এরপর মাত্র তিন মাসে কোনো অবস্থায়ই ইটভাটা রুপান্তরিত করা যাবে না। কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ানোর ফলে দিন দিন বৃক্ষ শূন্য হয়ে পড়ছে পরিবেশ ও বনাঞ্চল। একটি গ্রুপ পাহাড়ি মাটি কেটে ইট ভাটা গুলোতে সরবরাহ করছে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে। এদিকে পাহাড় থেকে মাটি কেটে ইট ভাটা গুলোতে নিয়ে আসার ফলে দিন দিন বিনষ্ট হচ্ছে পাহাড়ি ভূমি। ইট ভাটা গুলোতে কয়লার পরিবর্তে কাঠ ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে ইট ভাটার মালিকগণ কয়লার সংকটের কারণে কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে দাবি করেন। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ কয়লার চেয়ে কাঠের দাম কম হওয়ায় ইট ভাটাগুলোতে প্রতিনিয়ত বেপরোয়া ভাবে পোড়ানো হচ্ছে অবৈধ কাঠ।

চাম্বল বনবিট কর্মকর্তা শেখ আনিসুজ্জামান বলেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ইট ভাটাগুলোতে পাহাড় কাটা ও কাঠ পোড়ানো সম্পূর্ণ ভাবে নিষেধ রয়েছে। তবে পরিবেশ বান্ধব নিয়ম অনুসারে ইটভাটা হলে বন বিভাগের কোনো আপত্তি নাই। যে সমস্ত ইটভাটা পরিবেশ বান্ধব নিয়ম না মেনে পাহাড়ি মাটি বা কাট ব্যবহার করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে কেউ যাতে পাহাড় থেকে মাটি ও কাঠ না কাটে সেই জন্য কঠোর ভাবে নজরদারীতে রাখা হয়েছে। তবে নিয়ম বহির্ভূত কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে  আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বিগত কয়েকবছর আগে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি উপজেলায় অভিযান করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের অবরোধের মুখে পড়ে। পরে অনেক দেনদরবার করে সে যাত্রায় আর অভিযান পরিচালনা করা সম্বভ হয় না। অভিযান না চালানোর জন্য রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের চাপও রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে।

বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোমেনা আক্তার বলেন, সরকারের নিয়ম বহির্ভূত পরিবেশ বান্ধব ইটভাটা তৈরিতে কোনো বাধা নাই। তবে পাহাড়ি থেকে কাটা মাটি  ও কাট পড়ানোর কোনো নিয়ম নাই। যদি কেউ এই নিয়ম না মেনে চলে তদন্ত পূর্বক তাদেরকে ১০ বছর সশ্রম কারদন্ড ও ১০ লক্ষ টাকার জরিমানা করা হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো. মকবুল হোসেন বলেন, পরিবেশ আইন অনুযায়ী, জনবসতি ও পাহাড়ি এলাকার আশপাশে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। কিন্তু চট্টগ্রামের বেশির ভাগ ইটভাটা এই আইন অমান্য করেছে। এ ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী, পরিবেশসম্মতভাবে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইটভাটা তৈরি করতে হবে। এই নির্দেশনাও অমান্য করছেন ইটভাটা মালিকরা।

২০১৩ সালের ৫৯ নম্বর আইনে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন-সংক্রান্ত কর্মকর্তা নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত্র আইনের ৪ নম্বর ধারায় লাইসেন্স ব্যতীত ইট তৈরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, ইটভাটা যে জেলায় অবস্থিত সেই জেলার জেলা প্রশাসকের নিকট হইতে লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতিরেকে, কোনো ব্যক্তি ইটভাটায় ইট প্রস্তুত করিতে পারিবেন না।

মকবুল হোসেন আরো বলেন, ‘অবৈধ ইটভাটা এবং কাঠ পোড়ানোর বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর সতর্ক নজরদারি, নিয়মিত অভিযান চালানো এবং ইটভাটা মালিকদের সচেতন করতে মালিকের সঙ্গে সভা করা হয়েছে। যারা আইন অমান্য করবে তাদেরকে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না।

-সিভয়েস/এসসি

মুহাম্মদ মিজান বিন তাহের

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়