Cvoice24.com


তরুণদের রক্ষায় বাড়াতে হবে তামাকজাত দ্রব্যের দাম ও কর 

প্রকাশিত: ০৯:৫৪, ২৯ মে ২০১৯
তরুণদের রক্ষায় বাড়াতে হবে তামাকজাত দ্রব্যের দাম ও কর 

ফাইল ছবি

উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে তামাকের বাঘা বাঘা কোম্পানি যখন নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, ব্যবসাপাতি গুটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছে, তখনই বাংলাদেশে জাপান টোব্যাকো  তামাক ব্যবসায়ে  ১৪৭ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১২ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা (ডলারপ্রতি ৮৪ টাকা হিসাবে) বিনিয়োগ করেছে । যা এ যাবৎকালের মধ্যে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে একক বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগ।  আইনের কঠোর প্রয়োগের কারণে উন্নত দেশগুলোতে হারানো বাজার ফিরে পেতে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাজার সম্প্রসারণে মনোযোগ দিচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। 

পশ্চিমা বিশ্বে যখন তামাক পণ্য ব্যবহারে ক্রমবর্ধমান কড়াকড়ি আর স্বাস্থ্যসচেতনতা সৃষ্টির কারণে সিগারেটের ব্যবসা পড়তির দিকে, তখন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর টার্গেট এশিয়া বা আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলো। এর কারণ আর কিছু নয়, বাংলাদেশে  ধূমপায়ীর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি, বিশাল বাজার আর ধূমপানে নিরুৎসাহিত করার ক্ষেত্রে সরকারের অনীহা, কর, ভ্যাটের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের চেয়েও অনেকটা সুবিধাজনক ও নিরাপদ অবস্থান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এর হু’র গবেষণা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী তামাকজনিত মৃত্যুর ৮০ শতাংশই ঘটবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। 

অপরদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তামাক নিয়ন্ত্রণের নানা উদ্যোগ ও বিধিবিধান কার্যকর করার মধ্য দিয়ে সাফল্য অর্জন করছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আইন থাকলেও  বাংলাদেশে ধূমপান ও তামাক সেবন কমছে না। বরং বাড়ছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি তামাক সেবনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এর কারণ আর কিছু নয়, তামাকজাত দ্রব্যের সহজলভ্যতা, কম দাম এবং খুচরো সিগারেট ক্রয় বিক্রয় এবং বিজ্ঞাপন । যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের যেসব দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা কম  সেসব দেশের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সিগারেটসহ তামাকপণ্যের দাম সেখানে তুলনামূলক অনেক বেশি। বাংলাদেশে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেটের দাম ২৪০ টাকা। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো তামাকের বহুজাতিক কোম্পানির দেশ যুক্তরাজ্যে এক প্যাকেট সিগারেটের  প্রায় ১৫শ টাকা।  কাজেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও উচ্চহারে সব ধরনের তামাকপণ্যের দাম বাড়াতে হবে যদি এর আগ্রাসন কমাতে চায়। আর এ জন্য উচ্চমাত্রায় কর আরোপ করতে হবে উৎপাদনে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী সিগারেটের মূল্যস্তর উঠিয়ে সব সিগারেটের উপর ৭০% এক্সাইজ ট্যাক্স নির্ধারণ করতে হবে। এতে সিগারেটের মূল্য গড়ে ১৩০% বৃদ্ধি পাবে এবং সিগারেট সেবনের হার ৬৬% কমবে। এতে প্রায় ৭০ লক্ষ ধূমপায়ী ধূমপান ত্যাগ করবে এবং ৭১ লক্ষ তরুণ ধূমপান শুরু করা থেকে বিরত থাকবে। ৬০ লক্ষ (বর্তমান ধূমপায়ীসহ) মানুষের তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালমৃত্যু রোধ রক্ষা করা সম্ভব হবে। তবু সরকারের রাজস্ব ১৫০০ কোটি টাকা বাড়বে।

বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের সকল জেলার ১০,০০০টি পরিবারের উপর চালানো  জরিপ এবং গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকের স্বাস্থ্য ক্ষতির কারণে বছরে ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে যাচ্ছে, যা জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ২৩ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ তামাকে এক বছরে যে ক্ষতি হচ্ছে, তা দেশের মোট স্বাস্থ্য বরাদ্দের চেয়ে ৭ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা বেশি। একদিকে কম কর আরোপের কারণে যেমন বিশাল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার তেমনি অন্যান্য খাতের রাজস্বের বিশাল পরিমাণ খরচ করতে হয় চিকিৎসায়। এ থেকে মুক্তির অন্যতম পদক্ষেপ হতে পারে উচ্চ হারে কর আরোপ এবং সাথে জনসাধারণের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনা বৃদ্ধি করাতো আছেই।
উন্নয়নশীল বিশ্বে  দ্রুত যেভাবে এ মহামারি ছড়িয়ে পড়ছে সেটা রোধ করা না হলে মানবজাতিকে ভবিষ্যতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে- সে ব্যাপারে সন্দেহের কোন  অবকাশ নেই। এমনিতেই যত ক্ষতি হয়ে গেছে তা অনেক ব্যাপক। 

২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদনে  বাংলাদেশে তামাক ব্যবহার নিয়ে ভয়ানক তথ্য উঠে এসেছে- তা আতংকের, যেকোনো ধরনের তামাক ব্যবহারে ( ধোঁয়াযুক্ত বা ধোঁয়াবিহীন) প্রতিবছর বাংলাদেশে ১,৬১,০০০ জন মানুষ মারা যায়, যা দেশের বার্ষিক মোট মৃত্যুর ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের প্রতি পাঁচজনে একজন ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ তামাক ব্যবহার। এরপরেও যদি এর সম্পর্কে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া না হয় তবে তা হবে জেনেশুনে বিপুল জনশক্তি অকার্যকর করার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
এখনো যেটুকু সুযোগ আছে তা কাজে লাগানো গেলে, সরকার সচেষ্ট হলে এর ক্ষতি হয়তো পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ আছে। আর এর জন্য কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে সরকারকেই। কঠোর আইন প্রণয়ন, নজরদারিসহ জনসাধারণকে স্বাস্থ্যসচেতন করে তুলতে হবে। আর তামাকজাত কোম্পানিদের কুদৃষ্টি এদেশ থেকে সরাতে, উৎপাদন, বিপণনে নিরুৎসাহিত করতে টোব্যাকো কোম্পানির উপর ব্যাপকহারে কর ধার্য্য করতে হবে।

'বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা' তামাক নিয়ন্ত্রণের যে কয়টি পদ্ধতির কথা বলেছেন, তার মধ্যে করবৃদ্ধি অন্যতম। করবৃদ্ধির কারণে শুধু কোম্পানি নিরুৎসাহিত হবে সেটা নয়, কর বৃদ্ধির কারণে তামাকজাত দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি করতে বাধ্য হবে কোম্পানিগুলো। যার ফলস্বরূপ ধূমপায়ীরাও নিরুৎসাহিত হবে ধূমপানে, তামাক ব্যবহারে। ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে বাসযোগ্য গড়ে তোলার জন্য তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া উপায় নেই। ২৫-৩০ শতাংশ হৃদরোগ এবং ২০-৩০ শতাংশ স্ট্রোকের শিকার হতে পারে কেবল পরোক্ষ ধূমপানের কারণে। 

সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বিটা (বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব থিয়েটার আর্টস) একটি জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ জরিপের মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরীতে ১৬০৫টি তামাক বিক্রয় কেন্দ্র পাওয়া গেছে তা সত্যিই দুশ্চিন্তার বিষয়। আশা করা যায়, তামাকের দাম ও কর বৃদ্ধির ফলে তামাকের ব্যবহার কমে এলে তা বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা কমিয়ে আনতেও ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা যায়। উল্লিখিত  জরিপে আরো উঠে এসেছে যে চট্টগ্রাম নগরীতে ১১ হাজার ৪৬২টি (যা মোট বিক্রয় কেন্দ্রের ৭১ শতাংশ) বিক্রয় কেন্দ্রের কোন ট্রেড লাইসেন্স নেই। এ সকল বিক্রয় কেন্দ্রকে স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ট্রেড লাইসেন্স এর আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি তামাক এর মূল্য বৃদ্ধি ও ব্যাপক হারে কর বৃদ্ধি তামাক নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে।  

সিভয়েস/আই
 

ইমরান বিন ছবুর, স্টাফ রিপোর্টা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়