Cvoice24.com


কারচুপি-জারদৌসির বুননে ব্যস্ত বিহারী পল্লীর বুটিক শিল্পীরা

প্রকাশিত: ০৯:৪৮, ১৪ মে ২০১৯
কারচুপি-জারদৌসির বুননে ব্যস্ত বিহারী পল্লীর বুটিক শিল্পীরা

ছবি: মিনহাজ জন্টু

ঈদ উপলক্ষে প্রাণ ফিরেছে চট্টগ্রামের ঝাউতলা বিহারী পল্লীর বুটিকস হাউসগুলোতে। একসময় এখানকার কারচুপি-জারদৌসির বুনন শিল্পীদের সারাদিনই ব্যস্ত থাকতে হতো কাজে। এখন আর সেই সময় নেই। বলতে গেলে একেবারেই ঝিমিয়ে গেছে এখানকার বুটিকস ব্যবসা। বছরজুড়ে এখন অনেকটা নিষ্প্রাণ সময় যায় এই বুটিকস হাউসগুলোর। কিন্তু ঈদ আসলে বদলে যায় এখানকার চিত্র। ঈদের পোশাক তৈরিতে দারুণ কর্মব্যস্ততা শুরু হয় ঝাউতলার কারচুপি-জারদৌসির পল্লীতে।

এখানকার কারিগররা ফুল, পাখি, আল্পনা এঁকে মানানসই নকশা তৈরি করেন। তাদের ব্যবহার করা বিভিন্ন ডিজাইনের মধ্যে বহুল প্রচলিত দুটি ডিজাইন হচ্ছে, কারচুপি ও জারদৌসি। এছাড়া কাস্টমাররা নিজেদের পছন্দের ডিজাইনও দেন মাঝে মাঝে। প্রতিটা ক্ষেত্রে কাজ ভেদে ৫০০ থেকে শুরু করে ৫০০০০ পর্যন্ত পারিশ্রমিক নেন তারা। 

অন্যান্য সময় কাজ না থাকলেও ঈদে গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে সকাল ১০টা থেকে ভোর ৩টা পর্যন্ত একটানা কাজ করছেন এখানকার কর্মীরা। পুতি, জড়ি, স্প্রিং, চুমকি ও দাপকার অপূর্ব কারুকাজে  বুটিকস হাউসগুলোতে চলছে থ্রি-পিস, লেহেঙ্গা, শাড়ি আর পাঞ্জাবী তৈরির কাজ। জর্জেট, শিফন, টিস্যু, সিল্ক ও বেলব্রেট কাপড়ের উপর সুই সুতার সাহায্যে জারদৌসি-কারচুপি কাজের মোহনীয় নকশা ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।

তবে এই ব্যস্ততা কেবল ঈদকে কেন্দ্র করে। ঈদ শেষে আবার নেমে আসবে কাজ না থাকার হতাশা। এ অবস্থার জন্য এখানকার কারিগররা দুষছেন ভারত থেকে রেডিমেট পোশাক আমদানিকে। 

ঝাউতলা স্টেশন রোডে পাপ্পু বুটিকস হাউসে গিয়ে দেখা যায় চারজন কারিগর মিলে পোশাক তৈরির কাজ করছেন। কেউ কাপড় কেটে দিচ্ছেন, কেউ সেই কাপড়ে নকশা আঁকছেন। কেউ সে নকশার উপর পুতি স্প্রীং বসাচ্ছেন। এভাবে সকাল ১০টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত কাজ করেন তারা। 

বুটিকসের মালিক পাপ্পু জানান ২২ বছর ধরে এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত তিনি। গত ১২ বছর ধরে নিজের প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন। একসময় খুব ভাল চাহিদা ছিল এই কাজের। এখন বলতে গেলে অস্তিত্বের সাথে লড়াই করছেন তারা। তিনি বলেন, ঈদে কিছু কাজ পাই। অন্য সময়তো কাজই থাকে না। তবে এর মানে এই নয় যে মানুষ বুটিকসের কাজ করাচ্ছে না। মানুষ ঠিকই কাজ করাচ্ছে। কাজগুলো চলে গেছে বড় ব্যবসায়ীদের হাতে। 

তিনি বলেন একসময় পুরো একটা ফ্ল্যাট নিয়ে ২০ জন কারিগর দিয়ে কাজ করা হতো তার বুটিকস হাউসে। সেখানে এখন একটি ছোট রুমে ৪ জন কারিগর কাজ করছে। ভারতীয় রেডিমেট পোশাক আমদানি বাড়ার কারণে তাদের এ দুর্দশা বলে মন্তব্য পাপ্পুর। 

মেহজাবিন্স শপে গিয়ে দেখা যায়, সিল্কের কাপড়ে স্প্রীং বসানোর কাজ করছেন সোহেল নামে এক কর্মী। ক্যামেরা দেখে কিছুটা নড়েচড়ে বসে সে। অনুযোগের সুরে বলে , আপনারা প্রতি বছর এসে ছবি তুলে নিয়ে যান। আমাদের কাজতো বাড়ছে না, বরং প্রতি বছরই কমছে। লিখেন কী আপনারা। এক নাগাড়ে এসব বলে একগাল হেসে সে আবার বলে, আসলে ভাই মূল সমস্যা ঐ ইন্ডিয়ান রেড়িমেট কাপড়। তারা মেশিনের সাহায্যে কাজ করে। যে কাজ তারা এক ঘণ্টায় করে সেই কাজ করতে আমাদের সময় লাগে ১৫ দিন। ফলে তারা যেটা ১৫০০ টাকায় গ্রাহকের হাতে তুলে দিচ্ছে তা আমাদের কাছ থেকে করাতে গেলে তিন থেকে চার হাজার টাকা লাগে। 

তবে দামের যেমন পার্থক্য আছে গুণগত মানেও তেমন পার্থক্য আছে, এমনটাই দাবি সোহেলের। সোহেল বলেন ওদের কাজগুলো টেকসই না। আমরা যে কাজ করি সেগুলো অনেক টেকসই আর কাজও নিখুঁত। 

সোহেল বলেন, এখন কিছু কাজ আছে হাতে। কিন্তু ঈদ শেষ হওয়ার পর আবার কোরবান পর্যন্ত বসে থাকতে হবে। একসময় আমরা বেশ ভালোই ছিলাম পরিবার পরিজন নিয়ে। এখন যা আয় করি তা দিয়ে নিজে চলাও দায়। এসব কারণে এ এলাকায় বুটিকস হাউসের সংখ্যা কমে গেছে। অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। যারা করছেন তারাও লোক কমিয়ে ফেলেছে। এভাবে চলতে থাকলে এই শিল্পটা ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাবে। আর অনেক মানুষ বেকার হবে।

মেহজাবিন্স শপের আরেক কারিগর সুমন বলেন, এক সময় নিউ মার্কেট, মিমি সুপার মার্কেট, আফমি প্লাজা, লাকী প্লাজা, আমিন সেন্টারসহ বড় বড় মার্কেটের শোরুম গুলো এখান থেকে শাড়ি, জামা ,লেহেঙ্গা, থ্রি-পিস বানিয়ে নিতো। ফলে সারা বছরই কাজ থাকতো তাদের। কিন্তু ইন্ডিয়ান পণ্য বাজারে ঢুকার পর থেকে এখন আর এসব মার্কেট থেকে কাজের অর্ডার পান না তারা। 

এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে বলে দাবি এখানকার কারচুপি-জারদৌসির কারিগরদের। তারা বলেন, ভারতীয় পণ্য বাজারে প্রবেশে কড়াকড়ি নীতিমালা করা উচিত সরকারের। এটা না করতে পারলে শুধু আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো না, দেশেরও ক্ষতি হবে। 

একদিকে যেমন আমাদের বিশাল একটা বাজার ভারতের দখলে চলে যাচ্ছে অন্যদিকে  কর্মসংস্থানও সংকুচিত হচ্ছে। এছাড়া এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটা হারিয়ে যাওয়ার ক্ষতিতো আছেই। এই শিল্পকে বাঁচাতে তাই সরকারসহ সংম্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি ও আনুকূল্য দাবি করছেন এখানকার বুটিকস হাউসের মালিকরা।

-সিভয়েস/এআরটি/আই

আবু রায়হান তানিন

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়