Cvoice24.com


পার্বত্য জনপদের সর্বজনবোধ্য লোকভাষা

প্রকাশিত: ১২:২৫, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮
পার্বত্য জনপদের সর্বজনবোধ্য লোকভাষা

কবি, সাংবাদিক হাফিজ রশিদ খান

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূখণ্ড। এর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের স্তুতি, নদী-ঝিরি-জলাভূমি, পাহাড়ের সুবিন্যস্ত অপরূপতা এখন আর নতুন কোনো বিষয় নয়। এসব নিয়ে এই তথ্যপ্রযুক্তির কালে প্রচুর লেখালেখি, প্রামাণ্যচিত্র, ফটোগ্রাফি, কাব্যিকতা যেমন হচ্ছে, তেমনি এসবের টানে ওই ভূখণ্ডে বেশুমার পর্যটকের প্রবাহ চলছে ছুটির দিন ছাড়াও অন্যান্য দিনগুলোতেও।

এখানে স্বীকৃতভাবে এগারো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। তারা হলো : লুসাই, খুমি, ম্রো, খিয়াং, বম, পাংখোয়া, চাক, তঞ্চংগ্যা, ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা। এই স্বীকৃতদের বাইরেও এখানে আছে রাখাইন, অহমিয়া, মণিপুরি, নেপালি বা গুর্খা’সহ আরও কয়েকটি আণুবীক্ষণিক নৃগোষ্ঠী। যাদেরকে উল্লিখিতদের সঙ্গে অস্ট্রো-মঙ্গালীয় অবয়ব ও দেহগত সাদৃশ্যের কারণে অনেক সময় আলাদাভাবে চট করে শনাক্ত বা চিহ্নিত করা যায় না। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশিরভাগ অংশই এখনও দুর্গম, ঝোপ-জঙ্গল আচ্ছাদিত, পাহাড় পরিবেষ্টিত। ওইসব আদিবাসীদের অধিকাংশই ওইসব দুর্গম এলাকায় বসবাসে অভ্যস্ত বলে এদের গমনাগমন উপজেলা বা জেলা-সদরে তেমন একটা দৃষ্টিগোচর নয়। অথচ ওদের তো ঠিকই নিকটবর্তী হাটবাজার বা গঞ্জ বা জনসমাগমপূর্ণ স্থানে পণ্য বেচা-কেনা বা আদান-প্রদানের জন্যে সপ্তাহ বা মাসান্তে আসা-যাওয়া করতে হয়। জীবনধারণের প্রয়োজনে বস্তুসামগ্রী সংগ্রহের পক্ষে হাটবাজার বা একটি সাধারণ অনুমোদিত স্থানে সকলের সমবেত হওয়ার এই যে কঠিন বাস্তবতা- এটা প্রধানতই সংঘটিত হয় সকলের কাছে মোটামুটিভাবে বোধগম্য কোনো একটি ভাষার মাধ্যমে। অথচ এখানকার বাস্তবতা হচ্ছে, এ অঞ্চলে বসবাসরত প্রত্যেক জনগোষ্ঠীরই রয়েছে নিজস্ব ভাষামাধ্যম- যা স্বগোত্রীয় ছাড়া অন্যদের কাছে পরিচ্ছন্নভাবে বার্তাজ্ঞাপন ও প্রদানে তেমন সমর্থ নয় বা উপেক্ষণীয়।

উল্লিখিত এগারো জনগোষ্ঠীর নামের আদলে প্রচলিত পার্বত্য অঞ্চলের ভাষাগুলো হলো- লুসাই, খুমি, ম্রো, খিয়াং, বম, পাংখোয়া, চাক, তঞ্চংগ্যা, ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা। এখানে লুসাই, বম ও পাংখো- এ তিন জনগোষ্ঠীর ভাষার মধ্যে অনেকটাই সাযুজ্য পরিলক্ষিত হওয়ায় এ তিন ভাষাভাষিকে আপাতত একটি ভাষাগোষ্ঠী, খুমি ও ম্রো ভাষার মধ্যে সাযুজ্যের কারণে এ দুই ভাষাভাষিকে একটি ভাষাগোষ্ঠী, চাক ও মারমা ভাষার মধ্যে অল্পমাত্রার সাযুজ্যের কারণে এ দুই ভাষাভাষিকে একটি ভাষাগোষ্ঠি এবং তঞ্চংগ্যা ও চাকমাভাষার মধ্যে একই রকমের সাযুজ্যের কারণে একটি ভাষা বলে ধরে নেয়া যায়।

এর বাইরে থাকছে খিয়াং ও ত্রিপুরা ভাষা। অর্থাৎ স্বীকৃত এগারো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত ভাষা হল সাকুল্যে ছয়টি। এছাড়া রয়েছে এখানে বাংলাভাষিদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ। এর আবার দুটো দিক। উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিশাল জনপদের অসংখ্য মানুষ নিকট প্রতিবেশিতা, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরির প্রয়োজনে এখানে সুদীর্ঘকাল থেকে বসবাস করে আসছে। যাদের মুখের বুলি হচ্ছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বা উপভাষা।

অন্যদিকে রয়েছে ‘সেটেলার’ বা পুনর্বাসিত বলে কথিত বৃহত্তর চট্টগ্রামের বাইরে থেকে আগত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাভাষি মানুষ। যাদের মুখের ভাষাও স্ব-স্ব অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, অর্থাৎ যেসব অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে তারা বসতিস্থাপন করেছেন। এদের মধ্যে কুমিল্লা, বরিশাল, বাগেরহাট, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলার নদীভাঙা ও উদ্বাস্তুশ্রেণির মানুষই বেশি। সাধারণভাবে এদের ভাষাকে বাংলাভাষার একটি মিশ্ররূপ বলে ধরে নেয়া যায়। এছাড়া রাখাইন আহমিয়া মণিপুরী নেপালি বা গুর্খা ভাষাও, তা যতো কম সংখ্যক মানুষের মধ্যেই চালু থাকুক না কেন, এখানে অস্তিত্বমান। এসবের পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থার কর্মী-কর্মকর্তা, উপদেষ্টা ও বিশেষজ্ঞতার সূত্রে কর্মরত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষজন। এঁদের মধ্যে কিছু সংখ্যক বাঙালি ও আদিবাসীর উপস্থিতি থাকলেও, দাপ্তরিক কাজে তাঁদের নিজেদের মধ্যে ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য থাকায় পার্বত্য অঞ্চলে বিদ্যমান ভাষার সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে তেরোটি। এ ভাষাসমূহ নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী, নির্দিষ্ট অঞ্চল পেরিয়ে পার্বত্য জনপদের সকল মানুষের মুখের বুলির পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। এর পেছনে নানা আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক, স্থানিক অহমিকা ও স্বার্থসংশ্লিষ্টতার সংযোগ রয়েছে নিঃসন্দেহে। তাহলে কি ওই অঞ্চলে দৈনন্দিন কাজকর্মে সকলের ব্যবহার্য, সকলের কাছে চলনসইভাবে বোধগম্য কোনো ভাষামাধ্যমের উপস্থিতি নেই? এ প্রশ্ন সঙ্গত। কেননা যে-ভাষাভাষি মানুষজনই তারা হোন না কেন, একটা সর্বজনবোধ্য, মোটামুটি সহজ যোগাযোগসক্ষম ভাষা না হলে তো কারুরই তেমন চলবার কথা নয়। এছাড়া এ অঞ্চলের মানুষ কোনো ইশারাভাষা বা আকার-ইঙ্গিতকে সম্বল করে তাদের মনোভাব প্রকাশ করে চলেছে, এমনও তো নয়। তারা ইতোমধ্যে ঠিকই কাজ চলাযোগ্য একটা ভাষাকাঠামো গড়ে নিয়েছে কোনো প্রাতিষ্ঠানিকতা বা বাধ্যবাধকতার মুখাপেক্ষি না হয়েই। স্রেফ জীবনের পথে চলতে গিয়ে, জীবন-বাস্তবতার মুখোমখি হতে-হতে।

চট্টগ্রামি উপভাষা
দেখা যাচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপুল-অধিকাংশ মানুষের মধ্যে দৈনন্দিন কেনাকাটা, অতি প্রয়োজনীয় ভাববিনিময়, মজলিশি আড্ডা বা বড় ধরনের সামাজিক সমাবেশে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বা উপভাষাই কথোপকথনের সহজ মাধ্যম হিসেবে সবচে বড় স্থান দখল করে আছে। স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমূহ তাদের বিশেষ ধরনের উচ্চারণরীতির সঙ্গে এ ভাষার লোকজ স্ফূর্তিকে ধারণ করে যে-ভাষিক আবহ তৈরি করে তা পরিচ্ছন্ন আঞ্চলিক চট্টগ্রামি ভাষার হুবহু না হলেও ওই অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষের বোধগম্যতার অনেকটাই সমীপবর্তী। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত অন্য কোনো ভাষার পক্ষে এ স্ফূর্তি ধারণ করা কিছুতেই সম্ভবপর নয়।

আদিবাসীদের মধ্যে জনসংখ্যার প্রাধান্যের দিক থেকে চাকমা প্রথম, মারমা দ্বিতীয় ও ত্রিপুরা বা ককবরক তৃতীয় ভাষামাধ্যম। এ তিন জনগোষ্ঠীতে পরস্পরের ভাষাগ্রহণ বা চালাচালিতে রয়েছে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, দুর্বোধ্যতা ও এড়িয়ে চলার মনোভাব। অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোও একই সমস্যার বাস্তব উপস্থিতি থেকে বিযুক্ত নয়। এ সংকট-সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দরকার এমন একটি নিরপেক্ষ ভাষামাধ্যম, যেখানে রয়েছে বিভিন্ন ভাষার শব্দ ও শব্দমূলের বিচিত্র সমারোহ, অথচ যা হবে সকল ভাষাভাষির পক্ষে সহজবোধ্য। আদিকাল থেকে চট্টগ্রাম ও সন্নিহিত অঞ্চল বন্দরের উপস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যে উন্মুক্ত ও নানা জাতির মহামিলনের স্থান হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠায় এ অঞ্চলের ভাষাকাঠামার মধ্যে পর্তুগিজ, বর্মী, ইংরেজি, আরবি, ফারসি, হিন্দি, উর্দু ও আদিবাসী ভাষাসমূহের ঘটেছে বিচিত্র সম্মিলন। এ কারণে চট্টগ্রামি ভাষার শরীরে রয়েছে নানামুখি মানবিক ইতি-নেতির অনুভূতি ধারণ ও তা প্রকাশের বিপুল ক্ষমতা। দু’চারটি শব্দের যুৎসই প্রক্ষেপণে দুর্জ্ঞেয় মনোভাব দ্রুত অপরের মধ্যে সঞ্চালন করা সম্ভব এ মিশ্রভাষায়। সম্ভবত সে কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো বহু ভাষাভাষি অঞ্চলে সকলের সঙ্গে সহজ যোগাযোগের মাধ্যমে হিশেবে এ আঞ্চলিক ভাষাটি সর্বজনীনভাবে ব্যবহারযোগ্যতার পরিপ্রেক্ষিত অর্জন করেছে। প্রাতিষ্ঠানিতভাবে না-হলেও চট্টগ্রামি আঞ্চলিক ভাষা পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল আদিবাসী ও সমতলি মানুষের কাছে সুদীর্ঘকাল থেকে সুবিদিত ‘লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা’র (সর্বজনবোধ্য লোকভাষা) অবস্থান গ্রহণ করেছে।

কেন এমন হলো ...
আদিবাসীসমৃদ্ধ পাহাড়-অরণ্যবেষ্টিত বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলটি বঙ্গোপসাগরের কোল সংলগ্ন হয়ে আছে সুদূর ঐতিহাসিক কাল থেকে। সেকালের বার্মা বা বর্তমান মিয়ানমারের ইয়োমা পর্বতমালার সঙ্গে এ পার্বত্যভূমির লাগোয়া অবস্থানের কারণে বার্মায় ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে সংঘটিত জাতিগত সংঘর্ষে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অথবা কৌশলগত অবস্থান গ্রহণকারী ওখানকার ক্ষুদ্রজাতিগুলোর অনেকেই ওই পর্বতবাহিত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময়ে এই পাহাড় ও জঙ্গলাকীর্ণ স্থানটি ছিল জনবিরল, শ্বাপদসংকুল। স্বদেশ আরাকান (এটি ছিল সেকালের বার্মার সবচে বড় রাজ্য এবং বহু ক্ষুদ্রজাতির বসবাসস্থল। আনুমানিক ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে এখানকার ক্ষুদ্রজাতিগুলো সংখ্যাগুরু বর্মী জনগোষ্ঠীর আগ্রাসনের শিকার হলে ওই পরিব্রাজন শুরু হয়) থেকে অভিবাসীরা বহু সাধ্য-সাধনায় এখানে জনপদ গড়ে তোলে বলে বিভিন্ন ইতিহাস ও কিংবদন্তি সূত্রে জানা যায়।


এই পার্বত্য জনপদের পশ্চিমাংশ জুড়ে রয়েছে কক্সবাজার জেলা আর উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের সুপ্রাচীন, সমৃদ্ধ জনপদ। বিশেষ করে উত্তর চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ প্রণালী থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের কক্সবাজার জেলার শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত বঙ্গোপসাগর উপকূলের জনপদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত পার্বত্য চট্টগ্রাম এক বিস্ময়কর ভূবৈচিত্র্যের ভাণ্ডার। আর এ সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই ১৯৪৭ সালে ভারতভাগের সময় রেডক্লিফ মিশন পার্বত্য চট্টগ্রামকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (আজকের বাংলাদেশ) অন্তর্ভুক্ত করেছিল এ সিদ্ধান্ত থেকে যে, বন্দর সমুদ্রবেষ্টিত চট্টগ্রামের জন্যে এ ভূখণ্ড হল হিন্টারল্যান্ড-ঐরহঃবৎ খধহফ (কোনো দেশের উপকূল বা নদীতীরের পশ্চাৎবর্তী অঞ্চলবিশেষ, পশ্চাৎপ্রদেশ বা পশ্চাৎভূমি)। ১৯৪৭-এর ভারতবিভক্তির সময়ে ওই পার্বত্য জনপদের রাঙামাটি অঞ্চলের চাকমা সমাজের নেতৃস্থানীয়রা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের ও বান্দরবানের মারমা সমাজের নেতৃস্থানীয়রা বান্দরবান অঞ্চলকে সেকালের বার্মা বা বর্তমানের মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্ত ভূভাগ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। এ জন্যে ব্রিটিশ শাসক ও তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের কাছে তারা এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে ধর্ণা দিয়েছিলেন। এভাবে ইতিহাসের দীর্ঘ ঘাত-প্রতিঘাতপূর্ণ সময় পাড়ি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ বাংলাদেশের তিনটি স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদায় অভিষিক্ত এবং এখন এখানে প্রায় ১০ লক্ষের কাছাকাছি মানুষের জীবনধারা সংগ্রথিত।

এই পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় রাখলে এটি অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কোন্ পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ ও চট্টগ্রামের সমতল, নদী-সাগর-পাহাড়ময় ভূভাগের জনমানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিনের আর্থসামাজিক লোকায়তিক সম্পর্কটি গড়ে উঠেছিল। বৈষয়িক ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি এ সম্পর্ক প্রতিবেশিতা ও মানবিকতার গভীরতল পর্যন্ত স্পর্শ করে আছে বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। নানা লোককাহিনি, গল্পগাথা ও লৌকিক আচার-আচরণের সমিলতার মধ্যে এ বক্তব্যের সমর্থন মেলে। সেদিক থেকেও ভাষাগত গ্রহণ-বর্জনের বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে। আরও স্বীকার্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আরণ্যসম্পদ এবং তার বহুমাত্রিক উপযোগিতা চট্টগ্রামের বণিক ও ভাবপ্রবণ মানুষদের যেমন তার কাছে টেনে নিয়েছে, তেমনি এ মানুষগুলোর সহজ লোকায়ত জীবনাচার ও ধ্যান-ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এক ধরনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বাতাবরণ সৃষ্টি করে নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী লোকসমাজও। অন্যদিকে চট্টগ্রামের সুদৃঢ় ঐতিহাসিক অবস্থান ও উন্নততর ভাষা-সাংস্কৃতিক প্রভাবের বিষয়টি তো রয়েছেই। এই ভৌগোলিক ও জনচলাচলের মাধ্যম হিসেবে ভাষাগত নৈকট্যে চট্টগ্রামের উপভাষা এখনো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বিশেষ করে নানা গোত্রীয় বন্ধনে আবদ্ধ, নানা ভাষাভাষি পার্বত্য আদিবাসীদের কাছে এ মিশ্রভাষাটিই হয়ে ওঠেছে কালক্রমে পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে মৌরুসি সেতুবন্ধন। এ ভাষা ব্যবহারে বৃহত্তর চট্টগ্রামের অফিস-আদালত তথা জীবনের প্রয়োজনীয় সকল চৌহদ্দিতে এক পরিচিত, সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিপার্শ্বের সন্ধান পেয়ে আদিবাসীরাও নিজেদের গোত্রপর্যায়ের বাইরে যখনই পা রেখেছে কাজের অনুরোধে, তখনই এ ভাষার সাহচর্য গ্রহণকেই স্বস্তিদায়ী ও নিরাপদ ভেবে এসেছে।

এভাবে সকলের অজান্তে, অনেকটা নিরবে-নিভৃতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাটাই হয়ে ওঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল আদিবাসী  নৃ-গোষ্ঠী, ওখানকার সকল স্তরের অন্যান্য মানুষের ক্ষেত্রে লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা বা সর্বজনবোধ্য লোকভাষা।

হাফিজ রশিদ খান
কবি, সাংবাদিক

সিভয়েস/এস.আর

 

হাফিজ রশিদ খান

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়