Cvoice24.com


মালদ্বীপের সাহিত্যের নানাদিক

প্রকাশিত: ১১:০২, ১ আগস্ট ২০১৮
মালদ্বীপের সাহিত্যের নানাদিক

মালদ্বীপ, ইবনে বতুতা যাকে 'রাজপ্রাসাদের দ্বীপ' বলেছিলো, প্রায় বারশ' দ্বীপ নিয়ে গঠিত ভারত মহাসাগরের একটি দৃষ্টিনন্দন দ্বীপরাষ্ট্র, বিশ্বের সবচেয়ে নিচু দেশ। মালদ্বীপের প্রাচীন লিপি, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যগুলো থেকে ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে এখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিলো। বার শতকের শেষের দিকে মালদ্বীপে ইসলাম ধর্ম সম্প্রসারিত হতে থাকে এবং এ সময়ের ব্যবহৃত বইগুলিই এখন দেশটির ইতিহাসের মূলভিত্তি। ক্রমান্বয়ে পর্তুগিজ, ডাচ, ব্রিটিশ কর্তৃত্ব থেকে মুক্তির মাধ্যমে ১৯৬৫ সালের ২৬ জুলাই দ্বীপসমূহ পূর্ণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করে। এর রাষ্ট্রীয় ভাষা দিভেহি একটি ইন্দো-আর্য ভাষা। মালদ্বীপের প্রায় সকল সাহিত্যই গড়ে ওঠেছে এই ভাষার মাধ্যমে। একদিকে সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় পর্যটনশিল্পসমৃদ্ধ এ দেশটির সাহিত্য যেমন ভৌগোলিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় কারণে নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে অন্যদিকে লোককথাগুলোর পুনর্নির্মাণ এবং অনুবাদ মালদ্বীপের সাহিত্যকে নতুন আলোয় দেখতে শেখাচ্ছে।

মালদ্বীপ স্থানীয়দের কাছে 'দিভেহি রাজ' বা দ্বীপের রাজ্য নামে পরিচিত শতবছর ধরে। তাদের লোককথা অনেক প্রাচীন যদিও বহির্বিশ্বে খুব একটা পরিচিত নয়। মালদ্বীপের স্বাক্ষরতার হার দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি কিন্তু এখানকার লোককথাগুলো লিখিত নয়। আগে দ্বীপের ঘরে ঘরে গল্পকথককে আনা হতো যারা সরাসরি দর্শকের সামনে লোকগল্পগুলো শোনাতেন। কিন্তু বিশ শতকে মালদ্বীপকে 'ইসলামিক আধুনিক রাষ্ট্র' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে জীবনধারায় যে পরিবর্তন আনা হয়, তাতে টেলিভিশন,ইন্টারনেট ইত্যাদির জন্য লোকগল্প বলা ও শোনার ঐতিহ্য লোপ পেতে থাকে। এখন শুধুমাত্র কিছু লোকগল্প রয়ে গেছে যেগুলো ছাপার মাধ্যমে মালদ্বীপের জাতীয় পরিচয়কে ধরে রাখার চেষ্টা চলছে। মূল ফর্মে না থাকলেও 'দোন মহনু এন্ড দ্য শার্ক', 'দোন হিয়ালা অ্যান্ড আলিফুলু' ইত্যাদি এখনো টিকে আছে দিভেহি সাহিত্যের ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে। 'দোন হিয়ালা এন্ড আলিফুলু' হচ্ছে ইংরেজি রোমিও ও জুলিয়েট কিংবা লাইলী-মজনুর সমরূপী প্রেমের কাহিনি সম্বন্ধনীয় পুরাণ।

মালদ্বীপ শতভাগ সুন্নী-মুসলিমের দেশ, সকলকে অবশ্যই মুসলিম হতে হয়, অমুসলিমদের কোন ভোটাধিকার নেই। দ্বীপের প্রতিটি ঘরেই পাওয়া যায় ধর্মভিত্তিক বই। ইসলাম তাদের আদি সংস্কৃতির অংশ নয় কিন্তু এই ধর্মকে বিষয়বস্তু করে গড়ে ওঠেছে এখানকার প্রায় সকল লিখিত সাহিত্য। 'লোমাফানু' বার শতকে রচিত সবচেয়ে পুরোনো লিখিত সাহিত্য যেটি তামার পাতে রচিত এবং শ্রীলঙ্কার সিংহলি লিপির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর অন্যান্য ধর্মীয় রচনার মধ্যে মোহাম্মদ জামিলের রসুলের জীবনী নিয়ে লেখা 'সিরাত' সবচেয়ে জনপ্রিয় কাজের একটি। হোসেইন সালাউদ্দিন আরেকজন প্রভাবশালী লেখক,কবি,গদ্যসাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবী যার লেখা 'বদু টাকুরুফানো স্টোরি' মহাকাব্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। তাঁর ধর্মসম্বন্ধনীয় রচনা 'সীরাতুননাবাভীয়া'-তে আধুনিক মালদ্বীপ সাহিত্যের বীজ পাওয়া যায়। সালাউদ্দিন আরবি,ফারসি এবং উর্দু থেকে দিভেহিতে সাহিত্য অনুবাদের জন্যও বিখ্যাত। অন্যান্য দেশের লোককাহিনিগুলোকে মালদ্বীপীয় আবহে অনুবাদ করে তিনি তাঁর কাজে নিজস্বতা তৈরি করেছেন।

১৯৭০ সালের পূর্বে অর্থাৎ পর্যটনশিল্প প্রসার হওয়ার আগে মালদ্বীপকে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশ বললে ভুল হতো না। পর্যটনশিল্প এখানকার ট্রাভেলবুক বা ভ্রমণসাহিত্যে অবদান রাখছে। বিশ্বায়নের ফলে মালদ্বীপ আর 'একাকী নির্জন দ্বীপ' থাকেনি। ব্রিটিশ রাজ্যের বাণিজ্যিক ছোঁয়ায় মালদ্বীপবাসী শিক্ষার জন্য কলকাতা, বোম্বে, কোচিনসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের সুযোগ পায় যেখানে তারা ইসলাম ধর্মের ভিন্ন এক রূপের সঙ্গে পরিচিত হয়। তারা প্রথমত উর্দু ও হিন্দি সাহিত্যের সঙ্গে সহজে পরিচিত হতে পারে যেহেতু তাদের ভাষা দিভেহি উর্দু ও হিন্দির সমগোত্রীয় ছিলো। এসময় উর্দু ভাষায় দীক্ষিত দিভেহি পণ্ডিত ধমানিকুজে ইসমাইল দিদি 'বিরুবলু ভাজিরু', 'জোহা', 'বদু গোহদা' ইত্যাদি গল্প রচনা করেন যা দিভেহি সাহিত্যের প্রথমদিকের ধর্মনিরপেক্ষ গল্প। মোহাম্মদ আমিনের মাধ্যমে মালদ্বীপের সাহিত্য সর্বপ্রথম আধুনিকায়নের সঙ্গে পরিচিত হয় যদিও তাঁর সময়ে তিনি কেবল কয়েকজন উঁচুস্তরের পাঠক ছাড়া আর কারো কাছে সমাদৃত হতে পারেননি। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত তাঁর 'দোনকামন' গল্পটি রোমান্টিক উপন্যাসের স্টাইলে রচিত যা পরে অনেক জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৮০ সাল থেকে জাতীয় লোককথা এবং কালেকটিভ অভিজ্ঞতাগুলোর পুনর্লিখন শুরু হয়। এটি মালদ্বীপের সাহিত্যের ইতিহাসের সবচেয়ে ইতিবাচক কাজগুলোর একটি।

বদুফেনভালহুগে সিদি (১৮৮৮-১৯৭০) দিভেহি ভাষায় রচিত কবিতায় অনন্য অবদান রাখেন। তিনি এ ভাষার কবিতার একটি স্টাইল রাইভারুতে লেখা শেষ কবি এবং আইহেন স্টাইলে লেখা প্রথম কবিদের একজন। তাঁর প্রথমদিকের লেখা কবিতাগুলো পলিটিকাল স্যাটায়ার বা রাজনৈতিক ব্যঙ্গরচনা। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইব্রাহীম নাসিরের অনুরোধে তিনি প্রাচীন মালদ্বীপীয় লিপি 'দিভেহি আকুরু'তেও লেখার চেষ্টা করেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় তাঁর বোনের মেয়ে অমিনাথ ফাইজা (১৯২৪-২০১১) একজন শক্তিমান কবি ও লেখক হিসেবে গড়ে ওঠেন যিনি ১৯৮০ এবং ১৯৯৬ দু'বার জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁকে অন্যান্য কবি ও লেখকরা 'ডেইজী মা' বা মালদ্বীপীয় কবিতার ডেইজী ফুল হিসেবে আখ্যা দেয়। সাইকুরা ইব্রাহীম নাঈম (১৯৩৫-২০০৮) আরেকজন জনপ্রিয় কবি, যিনি একইসঙ্গে  একজন সফল গীতিকার এবং গল্পকারও। এছাড়াও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কবিগণ হলেন সাইকুরা ইব্রাহীম নাঈম, ইব্রাহীম শিহাব, এধুরো উমারু মাফাইয়ি প্রমুখ। ২০০৮ সালে ভারতীয় সাহিত্য আকাদেমি মুন্সী প্রেমচাঁদ ফেলোশিপ পুরষ্কার এবং ২০১১ সালে সার্ক সাহিত্য পুরস্কার পান ইব্রাহীম ওয়াহীদ 'ওগারু'। মালদ্বীপের লেখক হিসেবে তিনিই একমাত্র সার্ক সাহিত্যপুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

দীর্ঘ ত্রিশবছরের স্বৈরাচারী শাসন শেষে ২০০৮ সালের নভেম্বরে মোহাম্মদ নাশিদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মধ্য দিয়ে মালদ্বীপ প্রথম একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। মোহাম্মদ নাশিদ (১৯৬৭) দেশটির চতুর্থ প্রেসিডেন্ট। উইনস্টন চার্চিল কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলার মতো তিনিও রাজনীতিবিদ হওয়ার পাশাপাশি একজন লেখক ও সাংবাদিক। একে অন্যের পরিপূরক হয়ে সমানতালে চলেছে তাঁর দুই সত্ত্বা। এমনকি লেখালেখির জন্য তাঁকে একাধিকবার জেলও খাটতে হয়েছে। তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনার সময়ে মালদ্বীপে লেখার স্বাধীনতা থাকায় তরুণরা শিল্পী, গীতিকার, লেখক, কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সুবর্ণ সুযোগ পায়। কিন্তু ২০১২ সালে তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ২০১৩ সালে আবদুল্লা ইয়ামিন ক্ষমতায় আসেন। বর্তমান সময়ে সাহিত্য ও শিল্পধর্মী কাজগুলোতে অনুমোদনের নামে বাধাপ্রধান করা হচ্ছে। লেখকের বলার স্বাধীনতা মালদ্বীপের সংবিধান রহিত করছে। 'ন্যাশনাল ব্যুরো অব ক্লাসিফিকেইশন' সাহিত্যকর্মের অর্থ নির্ধারণ করে অনুমতি দেয়ার পরেই কেবল প্রকাশ করা যাবে। অনুমতি প্রদানের পূর্বে ছাপাখানা, রেকর্ডিং, ফিল্ম, ডকুমেন্টারি এমনকি ইন্টারনেটেও প্রকাশ করা যাবে না। সকল শিল্পকর্মের জন্য 'রেজিস্ট্রি অব লিটারেচার অর আর্ট অথরাইজার্স' থাকবে। এই রেজিস্ট্রির সদস্যের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কবিতা,গল্প ইত্যাদি প্রকাশিত হবে। কোনো সাহিত্য ইসলামের বিরুদ্ধে এবং সামাজিক নিয়মের বাইরে হতে পারবে না। এর ব্যতিক্রম হলে রয়েছে দণ্ডের বিধান।

সাহিত্য লেখকের চিন্তা ও অভিব্যক্তির স্বাধীনতাপ্রত্যাশী। শর্তের মাধ্যমে নিয়মের বেড়াজালে বন্দি সাহিত্য কীভাবে অগ্রসর হতে পারে! সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশগুলোর চেয়ে মালদ্বীপের সাহিত্যের অনগ্রসরতার বড় কারণ পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, ইসলামিক মৌলবাদ, রাজনৈতিক সংকট। আবার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ দেশের অধিবাসীদের রয়েছে জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়ার ভয়। এরকম বৈরী অবস্থায় কোনো দেশের সাহিত্যের জন্য নন্দনতাত্ত্বিক বিচারে এগিয়ে যাওয়া দুষ্কর। সে চিত্রই ধরা পড়ে সার্কের সর্বশেষ সাহিত্য গবেষণার ক্ষেত্রেও। ট্যালিতে সার্কভুক্ত দেশসমূহের মধ্যে সবচেয়ে নিচে অবস্থান করছে মালদ্বীপ। যেখানে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমউন্নতিসূচক, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কা অস্থিতিশীল, সেখানে মালদ্বীপের অবস্থা একই রকম। একটি জাতির প্রথা, সংস্কার ও কীর্তির সমষ্টিগত ফসলকে বলা যায় সংস্কৃতি। সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সাহিত্যিকদের প্রকাশ নির্ভর করবে স্বভাবতই। আবার চলমান প্রতিকূলতা থেকে সাহিত্য নিজেও ঘুরে যাওয়ার নজির দেখিয়েছে বহুবার, দেশ ও জাতিকেও ঘুরিয়ে দিতে পেরেছে সাহিত্য। সাহিত্য স্বয়ংশক্তি তাই এসব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে পুনঃর্নিমাণ, অনুবাদ ও মৌলিক সাহিত্য নির্মাণে মালদ্বীপের ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভবও নয়।

সিভয়েস/এএইচ

মাহমুদা স্বর্ণা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়