Cvoice24.com


পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরিবর্তনের বার্তা

প্রকাশিত: ১৭:১২, ৩১ জুলাই ২০১৮
পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরিবর্তনের বার্তা

ছবি : সিভয়েস

পাকিস্তানের প্রথাগত রাজনীতির ধারা ভেঙে দিয়েছেন অক্সফোর্ডে লেখাপড়া করা এবং একদার বিশ্বসেরা ক্রিকেট অলরাউন্ডার ইমরান খান। এটি এ কারণে বলছি, পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ শরীফ) যদিও এটি কয়েক ধারায় বিভক্ত হয়েছে তথাপি বলা যায়, এক শতাব্দীর অধিক বয়সী এই দল (১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠিত হয়) এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রতিষ্ঠিত অর্ধশতাব্দীর ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি’ এই ২টি দল পাকিস্তানের রাজনীতিতে কায়েমি ও সামন্ত স্বার্থ পুষ্ট করেছে দশকের পর দর্শক এই দুটি দলকে পরাস্ত করে পাকিস্তানের এবারের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে উঠে এসেছে দুই দশক আগে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) পার্টি। পাকিস্তানের সামন্ত ঐতিহ্যে এবং বদ্ধ সমাজ জলাশয়ে সাঁতরানো মানুষ এবার নতুন করে স্বস্তির আশায় ইমরান খান এর দলকে ভোট দিয়েছে।

এবারের নির্বাচনে নারীরা উৎসাহ নিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। এমন কি দুর্গম পাহাড়ি অ লে অনেক নারী এবারই প্রথম ভোট দিতে এসেছেন। তরুণদের উল্লাসমুখর প্রচারণা এবার চোখে পড়ার মতো। বাঁধভাঙা যে উচ্ছ্বাস নারী এবং তরুণদের মাঝে দেখা গেছে, কুসংস্কার আর ধর্মীয় উগ্রতা পরিহার করে তাঁরা কি পাকিস্তানে নয়া সামাজিক জাগরণের সূচনা করতে পারবেন?

এবার কিছু পরিসংখ্যান দিই। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে মোট আসন সংখ্যা ৩৪২। এর মধ্যে সরাসরি নির্বাচন ২৭২টি আসনে। বাকি ৭০টি আসন নারী ও সংখ্যালঘুর জন্য সংরক্ষিত। ২৭০টি আসনে নির্বাচন হয়েছে। ২টি আসনের ভোট গ্রহণ গোলযোগের কারণে স্থগিত করা হয়েছে নির্বাচনের আগেই। ভোট পড়েছে ৫৫.৮ শতাংশ। ১১৫টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে ইমরানের দল পিটিআই, দ্বিতীয় স্থানে নওয়াজ শরিফের পিএমএল পেয়েছে ৬৩টি আসন। তৃতীয় স্থানে রয়েছে পাকিস্তান পিপলস পার্টি, তাদের আসন সংখ্যা ৪৩। বাকি আসনগুলো পেয়েছে ইসলামি দলগুলির জোট, মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট, পারভেজ মোশাররফের মুসলিম লিগ ও স্বতন্ত্র সদস্যরা। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ১৩৭টি আসন। এক্ষেত্রে ইমরান খানের দলকে অন্যদল কিংবা স্বতন্ত্র সদস্যদের নিয়ে জোট গঠন করতে হবে। পিটিআই ইতিমধ্যে সরকারে যোগ দিতে মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্টকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। 

পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলি এ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের কথা বলেছে। পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান একে পাকিস্তানের নিকৃষ্টতম নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে প্রথমে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করলেও পরে মেনে নিয়েছে নওয়াজ শরীফের দল, তারা পার্লামেন্ট বর্জন করবে না বলেছে। ইসলামী দলগুলো নির্বাচন ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে।

নির্বাচনে বিজয়ের পর টেলিভিশনে প্রচারিত ভাষণে ইমরান খান পাকিস্তানকে বদলে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহম্মদ আলী জিন্নাহর নীতি বাস্তবায়নের কথা বলেন। ২৬ জুলাই টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, তাঁর সরকার কারো প্রতি কোন ধরণের প্রতিহিংসামূলক আচরণ করবে না। দুর্নীতিমুক্ত পাকিস্তান গড়তে এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করবেন, প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে সহঅবস্থানের ব্যাপারে জোরদার প্রচেষ্টা নেয়ার কথা বলেছেন ইমরান খান। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি ১ কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন বলেছেন।

বিরোধীরা ইমরান খানকে সেনাবাহিনীর সমর্থন ও মদদপুষ্ট বলেছেন, বিদেশী সমালোচকরাও এটি বলছেন। একা এই অভিযোগে ইমরান খান কেন দুষ্ট হবেন? পিপলস পার্টির প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাশা পূরণ করতে সেনাবাহিনীর সমর্থন চেয়েছেন, পেয়েছেন, পাকিস্তান খণ্ডিত করার পেছনে তাঁর উচ্চাভিলাষ দায়ী, একথা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের।

নওয়াজ শরীফও প্রথমে সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট ছিলেন। পরে তাঁকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। তিনি কোনবারই পুরো সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। এটা সত্যি যে, সামরিক সমর্থনপুষ্ট হয়ে বেসামরিক শাসন দীর্ঘদিন চালানো যায় না। সংঘর্ষে যেতেই হবে উভয় পক্ষকে। পাকিস্তান তার সত্তর বছরে অর্ধেকেরও বেশি সময় প্রত্যক্ষভাবে সামরিক শাসনের অধীনে থেকেছে। অন্য  সময়ও বেসামরিক সরকার তাদের পছন্দের বাইরে যেতে পারেনি, যখনই তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে বেসামরিক সরকার, তাদের বিদায় নিতে হয়েছে নানা ষড়যন্ত্রে। এসব ঘটনা পাকিস্তানের রাজনীতি ও সমাজকে এক অসহনীয় পরিস্থিতিতে নিক্ষেপ করেছে। দেশটি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ঊর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুন খাওয়া এই দুটি প্রদেশ তালেবান ও ধর্মীয় জঙ্গিদের বড় ঘাঁটি। প্রতিনিয়তই সন্ত্রাস, বোমা হামলায় নিরীহ নারী-পুরুষ শিশু প্রাণ হারাচ্ছে। ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় দেশটির নাম উঠেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পাকিস্তান এক অবিশ্বস্ত নাম।

ইমরান খানের উত্থানের পেছনে সেনাবাহিনীর সমর্থন আছে এটা মেনে নিয়েও বলা যায়, তাঁর রাজনৈতিক উত্থান পাকিস্তানে বংশানুক্রমিক রাজনীতির ধারাটিকে আঘাত করেছে। তিনি আর যাই হোন, পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মতো কায়েমি স্বার্থের পাহারাদার নন যদিও ধর্মীয় উগ্রবাদী দলগুলির সাহায্য নিয়ে তিনি রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন এমন কথাও আছে। ইমরান খানকে ‘সেনাবাহিনীর বশংবদ মানুষ’ এই অপবাদ ঘুচাতে হবে সেনাবাহিনীকে না চটিয়ে। তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতা। এটি যেমন স্বদেশের রাজনীতিতে তাঁর ইমেজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন তেমনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতেও গুরুত্বপূর্ণ। 

অন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পাকিস্তানকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। সন্ত্রাস ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং ধর্মীয় উগ্রবাদ রপ্তানি করার ক্ষেত্রে যে বদনাম পাকিস্তানের রয়েছে তা ঘুচাতে দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীদের অধিকারের প্রতি সম্মান, সকল মত ও পথের প্রতি উদার মনোভাব প্রদর্শন অর্থাৎ একটি উদার সহিষ্ণু শাসন মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এজন্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারে তাঁকে হাত দিতে হবে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির উচিত হবে তাঁকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে সহায়তা করা।

ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন তাঁর জন্যে আর একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ। বিজয়ের পর তিনি বলেছেন, ভারত এক পা এগোলে তিনি দুই পা  এগোবেন। ইমরান কাশ্মিরের বিষয় নিয়েও বলেছেন, সেই সাথে বেলুচিস্তানের ব্যাপারে ভারতের নাক গলানোরও সমালোচনা করেছেন। ভারতের গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক মহল ইমরান খানের বিজয়কে সুনজরে দেখছে না। তাঁর এই বিজয় বিজেপির জন্য স্বস্তিদায়ক নয় এজন্যে যে, সামনের বছর ভারতের জাতীয় সংসদের নির্বাচন। তবে ভারতের এমন কিছু করা উচিত হবে না যা পাকিস্তানের আগামী গণতান্ত্রিক সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে। এই ধরনের পরিস্থিতি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সুযোগ করে দিতে পারে সেটিও তাদের বিবেচনায় নিতে হবে। কাশ্মির প্রশ্নে দু দেশকেই নমনীয় এবং বোঝাপড়ার জায়গায় আসতে হবে।

দ্বিতীয় হচ্ছে তালেবান ইস্যু, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তালেবান প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রতি ক্ষুব্ধ ও রুষ্ট, যুক্তরাষ্ট্রের আস্থা অর্জনে পাকিস্তানের নতুন সরকারকে তালেবান নীতি পুনর্বিবেচনা না করে উপায় নেই।

আগামী দিনে বিরোধী দলগুলির তৎপরতা কি হবে সেটিও বিবেচ্য তবে প্রতিষ্ঠিত দুই দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা রয়েছে। এবার নির্বাচনে ইমরানের সাফল্যের একটি বড়ো কারণ তাঁর বিরোধী বড়ো দুই দলের শীর্ষ নেতাদের দুর্নীতি। পাকিস্তানের জনগণ ইমরানের কাছে একটি স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন ও সমাজব্যবস্থা চায়।

তবে ইমরান খানের সামনে বড়ো চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পাকিস্তানে সন্ত্রাস দমন ও ধর্মীয় উগ্রবাদিতা প্রশমন। এ কাজ সহজ নয়। পাকিস্তানের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে এই দুটিই প্রবল বাধা। তাঁকে রাজনৈতিক দলগুলির সহযোগিতা নিতে হবে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহত রেখেই তাঁকে এ লক্ষ্যে এর অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দাবি মেটাতে হবে। এ কাজে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা পাওয়া বড়ো শর্ত। তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে এর সাফল্যের ওপর।

লেখক : সাংবাদিক

সুভাষ দে

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়