Cvoice24.com

সরকার মাসুদ
ধ্রুপদী সাহিত্যের পাঠকভাগ্য

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ২৫ জুলাই ২০১৮
ধ্রুপদী সাহিত্যের পাঠকভাগ্য

আত্মবিশ্বাসী সৃষ্টিশীল লেখকমাত্রই যতটা না তার সমকালের তার চেয়ে অনেক বেশি অনাগতকালের পাঠকের ওপর ভরসা করে থাকেন। এর অর্থ লেখক যেমন তার লেখালেখি নিয়ে মাথা ঘামান, তেমনি সেসব লেখার পাঠকভাগ্য নিয়েও ভাবেন।

 

জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ রাজনীতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা কিংবা রাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে সাধারণত চিন্তা করেন। এদের ভেতর ছোট একটি অংশ সাহিত্যের পাঠক। বাদবাকি লোকেরা সাহিত্যকে অবজ্ঞা করেন আমি তা বলব না; কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের উৎসাহ ক্ষীণ এবং ভাসাভাসা এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়।

 

সাহিত্যের প্রতি লোকজনের আগ্রহ কখনও কখনও তীব্র হতে পারে, হলেও তা হয় আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী। ধরা যাক, কুড়ি বছর আগে প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদের কোনো একটি উপন্যাসকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে তুলে দিয়েছিল যে পাঠকরা তাদের যদি জিজ্ঞেস করা যায় ওই বইটি সম্বন্ধে তারা এখন কী ভাবছেন, আমার মনে হয় না উচ্ছ্বাসপূর্ণ কোনো জবাব মিলবে। আবার এটা হওয়াও বিচিত্র নয় যে, ওই পাঠকদেরই একটা বড় অংশ ওই উপন্যাসটির কথা ভুলেই গেছে। জনপ্রিয়তা সংক্রামকব্যাধির মতো। ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগে না। কেননা জনপ্রিয় সাহিত্যের পাঠক কেবল তার ভোক্তাই নয়, মুগ্ধ প্রচারকও।

পাঠকের মধ্যেও রকমফের আছে। যারা সাহিত্যের পাঠক, আগেই লিখেছি, তারা সংখ্যালঘু। তো সাহিত্য নিয়ে এ সংখ্যালঘুদের এত মাতামাতির কারণ কী? কারণটা বোধ হয় এই যে, এরা সাহিত্য নামক পদার্থের ভেতর দীর্ঘস্থায়ী আনন্দের উপাদান খুঁজে পান।

আর এ প্রাপ্তিই তাদের সাহিত্যের প্রতি উৎসাহকে ধরে রাখে। জনপ্রিয় লেখক সম্বন্ধে হাসান আজিজুল হক একটি মজার কথা বলেছেন। তার মতে জনপ্রিয় লেখক হচ্ছেন ময়রার মতো। ময়রার মতো কেন? তার কারণ ময়রা সেই মিষ্টিই বারবার তৈরি করে যার চাহিদা ব্যাপক। অনুরূপভাবে জনপ্রিয় সাহিত্যিকও ওইসব বিষয়বস্তু নিয়ে লেখেন, লিখেই চলেন, পাঠক সাধারণ যেগুলো খুব পছন্দ করে।

জনপ্রিয় সাহিত্যের মধ্যেও পার্থক্য আছে। দেশ ও পরিবেশভেদে তার রূপ বেশ ভালো করেই বোঝা যায়। ডিএইচ লরেন্স ও গ্রাহাম গ্রিন উভয়েই গ্রেট ব্রিটেনের জনপ্রিয় উপন্যাসিক ছিলেন। ছিলেন আমাদের শরৎচন্দ্রও।

 

ইংল্যান্ডে শিক্ষিতের হার এবং গড়পড়তা পাঠরুচি আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত, এ যুগে এবং সে যুগেও। সুতরাং সিরিয়াস বিষয়বস্তুকে উপজীব্য করে সাহিত্য রচনা করলেও একজন লরেন্স কিংবা একজন গ্রিনের পক্ষে জনপ্রিয় লেখক হয়ে ওঠা সে দেশে সম্ভব ছিল। বাংলাদেশে তা সম্ভব নয়। এখানে তো প্রণব ভট্টের মতো লেখকের বইও বেশ বিক্রি হয়েছে এক সময়।

পুরোপুরি জনপ্রিয় হয়ে ওঠার আগেই তার অকালমৃত্যু হয়। নতুবা এতদিনে তাকেও হয়তো বইমেলায় অটোগ্রাফ শিকারিদের কবলে পড়তে হতো, হুমায়ূন আহমেদের মতোই। আর অটোগ্রাফ শিকারি পাঠকরা, বলতে বাধ্য হচ্ছি, বাস করেন এক অন্ধকার জগতে যেখানে চিরায়ত সাহিত্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। ফলে ওই পাঠকদের মধ্যে এক ধরনের অন্ধতা তৈরি হয়।

তারা দেখতে পান না তাদের আরাধ্য লেখকদের বাইরেও কিছু লেখক আছেন যারা পাঠকপ্রিয় নন; কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। এটা বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী অতিবাহিত হল; অথচ লেখাপড়া জানা বিশাল জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ এখনও সুরুচি অর্জন করতে পারল না, জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই।

 

খ্যাতি এবং লেখকের রচনার মূল্য দুটি আলাদা আলাদা জিনিস। একটি লেখার সাহিত্যমূল্য কখনই তার লেখকের বিখ্যাতি দ্বারা নিরূপিত হয় না। তা ছাড়া খ্যাতির বিড়ম্বনার শিকার শুধু লেখক হন না, হয় তার রচিত গ্রন্থও। সবাই জানি, পাঠকপ্রিয় লেখকদের গ্রন্থ প্রকাশিত হয় প্রতি বছরেই, অনেক সময় একই মৌসুমে একাধিক গ্রন্থও। এমন পরিস্থিতিতে লেখকের অন্ধ ভক্তরাও দ্বিধান্বিত হন, তারা কোনটা কিনবেন। পরন্ত, এ ক্ষেত্রে একটি বইয়ের বিক্রি হওয়া আরেকটি বইয়ের বিক্রি কম হওয়ার ওপর প্রভাব ফেলে।

অজনপ্রিয় লেখক এবং ধ্রুপদী সাহিত্যের স্রষ্টাদের বেলায় এ সমস্যা নেই। তাদের বইয়ের সংখ্যা তুলনামূলক হিসেবে অনেক কম। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে এত কমসংখ্যক বই নিয়ে একজন সিরিয়াস বা ক্লাসিক্যাল লেখক কীভাবে তার অর্জিত সুনাম রক্ষা করেন।

 

উত্তর হচ্ছে, এ ধরনের লেখকদের সুনাম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠকদের বিচারের ওপর নির্ভর করে না। সংখ্যা অনেক কম; কিন্তু আপন সুরুচি ও বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভরশীল পাঠকরাই বন্দনা করে চলেন ক্লাসিক লেখকদের রচনা। এভাবে তারা ওই লেখকদের উঁচু ইমেজটিকে টিকিয়ে রাখেন যুগের পর যুগ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে মনে পড়ছে।

তিনি যে বড় মাপের কথাসাহিত্যিক এটা দেশবাসী জানতে পারে তার অকালমৃত্যুর পর, তা-ও টেলিভিশনের কল্যাণে! জীবদ্দশায় তিনি সাফল্য পেয়েছেন; অন্যান্য গুণী লেখক এবং বিদগ্ধ পাঠক সমাজ তার সৃষ্টির গুণকীর্তন করেছেন এটা ঠিক।

আবার এটাও ঠিক, সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠক রাহাত খান কিংবা হাসনাত আবদুল হাইয়ের মতো দ্বিতীয় শ্রেণীর লেখকদের যতখানি প্রশংসা করেছেন, ইলিয়াসকে এতখানি করেননি। অনেকেই তো তাকে বুঝতেই পারেননি বা এখনও পারেন না।

এর ভেতর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলাসাহিত্য পড়ান এমন ব্যক্তিও আছেন! মেধাবী পাঠকশ্রেণীর গভীর ও সজীব আগ্রহই ধ্রুপদী লেখকদের গ্রন্থ পুনর্মুদ্রণে উৎসাহিত করে। এভাবে তাদের বারবার পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে। মননশীল পাঠকরা আরেকটি কাজ করেন, তা হচ্ছে প্রতিভাবান লেখক খুঁজে বের করে তাদের পুনর্মূল্যায়ন করা।

যে লেখকরা মৃত্যুর পর স্বীকৃত হয়েছেন অসাধারণ সাহিত্যিক হিসেবে, তাদের ক্ষেত্রেও ওই সংখ্যালঘু পরিশ্রমী পাঠকদের অবদান অস্বীকার্য। তারা যেমন কীর্তিমান লেখকদের ‘কাজ’কে নিজেরা ভোলেন না, তেমনি অন্যদেরও ভুলতে দেন না। তাদের অনিঃশেষ উদ্যম ও জেদের কারণে সাধারণ পাঠকরা কৃতী লেখকদের নাম শুনতে অভ্যস্ত হন, কখনও বা তাদের একটা-দুটো বই কেনেন। শেষ পর্যন্ত তাদের কীর্তির উচ্চতাকে মেনে নেন বিনা তর্কে।

 

সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠক সম্প্রদায় একজন মামুলি লেখককে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে বটে, তাদের জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ রাখার বেলায় তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। সেজন্য আমরা দেখি মৃত্যুর পর জনপ্রিয় লেখকদের ভাবমূর্তি ক্রমশ ফিকে হতে থাকে। চার্লস ডি-কেন্স, শরৎচন্দ্র কিংবা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো লেখকরা ব্যতিক্রম।

সাহিত্যের পাঠক সাহিত্য নামক বস্তুর মধ্যে পেয়ে যান স্বল্পস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী আনন্দ। একটি উৎকৃষ্ট গ্রন্থপাঠের মধুর স্মৃতি সাহিত্যের প্রতি তাদের উৎসাহকে বাঁচিয়ে রাখে। বয়স ও অভিজ্ঞতা বাড়ার সমান্তরালে তাদের রুচিবোধও উন্নত হয়।

শিল্প-সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে তারা আরও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠেন। তখন কোনো গ্রন্থ যদি তাদের কাছে সস্তা ও একঘেয়ে মনে হয়, গড়পড়তা পাঠকদের নিরন্তর স্মৃতিও তাদের ওই বিশ্বাসে ফাটল ধরাতে পারবে না যে, বইটি মানসম্পন্ন এবং পাঠ্য।

 

একটি উৎকৃষ্ট বইয়ের অত্যাবশ্যক গুণগুলো কী কী? এক কথায় উত্তর দেয়া অসম্ভব। তবে এটা বলা যায়, সেই বইয়ে থাকা চাই সৌন্দর্যবোধ, প্রজ্ঞা, অন্তর্দৃষ্টি, কৌতুকচেতনা ও জ্ঞানের সারাৎসার। এসব কিছু থাকলেও বইটি ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি না শেষ পর্যন্ত তা সুলিখিত হয়। অনদিকে গদ্য বা কাব্যভাষা যদি আকর্ষণীয় হয়ও, প্রাগুক্ত ধারণাগুলোর যথাযথ প্রয়োগ না ঘটাতে পারলে একটি গ্রন্থ সমৃদ্ধ হতে পারে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠকদের এসব বিষয়ে ধারণা নেই বা থাকলেও তা ভাসাভাসা। মনে রাখতে হবে, জনপ্রিয় সাহিত্যের সমকালিক পাঠকরা প্রধানত আবেগী পাঠক। তারা নিচু মানের বই পড়ার ভেতর দিয়ে তাদের অশুভ আগ্রহের পরিচয় করে চলেন। খাটো লেখকদের প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে এরা ওস্তাদ।

আমি এমন অনেক ব্যক্তির কথা জানি যাদের পেশাগত ও সামাজিক ব্যস্ততা এত বেশি যে, তারা পড়ার সময় পান না; কিছুটা পেলেও আগ্রহের অভাব আছে। এ লোকগুলো সুশিক্ষিত নয়, অথচ তাদের সেলফে দেখা যাবে রবীন্দ্ররচনাবলি, শেকসপিয়রের নাটক বা জীবনানন্দসমগ্র। কারণ কী? কারণ যুগের পর যুগ এই লেখকদের গুণকীর্তন করা হয়েছে। আর ওই ব্যক্তিরা তা শুনেছেও। শুনতে শুনতে একসময় বিশ্বাস করেছে যে, এরা মহৎ লেখক। পড়া হোক না হোক এদের রচিত গ্রন্থ ড্রয়িংরুমে রাখাটাও একটা মর্যাদার বিষয়। তা আভিজাত্যের প্রতীকও বটে।

ধ্রুপদী সাহিত্যের সব বই-ই যে সবাইকে আনন্দ দেবে এমন কোনো কথা নেই। কেউ মার্শেল প্রস্ত পড়ে মজা পাবেন, কেউ বিভূতিভূষণ। হেনরি জেমস বা কমলকুমার মজুমদারের লেখার ভেতর যদি কেউ ঢুকতে না পারেন সেটা ওই লেখকদের দোষ নয়, দোষ পাঠকের। যথেষ্ট প্রস্তুতি না নিয়ে এ ধরনের লেখকদের রচনার দিকে অগ্রসর না হওয়াই উচিত তাদের। কৌতূহল না থাকলে মনোসংযোগ সম্ভব নয়। শিল্প-সাহিত্যে প্রকৃত কৌতূহল সৃষ্টি হয় বুদ্ধিবৃত্তিক এষণা থেকে এবং কৌতূহলের প্রেরণাশক্তি পাঠককে এগিয়ে দেয় নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের পথে।

ক্লাসিক্যাল সাহিত্য মানেই উঁচু দরের সাহিত্য। নতুবা বহু যুগ পাড়ি দেয়ার পরও তার সুনাম টিকে থাকে কী করে? ক্লাসিক সর্বদাই উঁচু দরের পাঠকদের নির্মল আনন্দ দেয়। সংখ্যাগুরু জনপ্রিয় সাহিত্যের বিশাল পাঠকগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্র অংশও ওই আনন্দের স্বরূপ উপলব্ধি করে। নিছক শিল্পের বা নৈতিকতার প্রয়োজন মেটাতে ক্লাসিক টিকে থাকে না। তা টিকে থাকে মুখ্যত চিরায়ত অনুভবের অনবদ্য রূপায়ণের জন্য। পাঠক ওইসব অনুভবকে নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে পারেন। তাদের সীমাহীন কৌতূহল ধ্রুপদী সাহিত্যের মূল্যবান গ্রন্থগুলো পুনরাবিষ্কার ও পুনর্মূল্যায়নে নিয়োজিত রাখে। সে জন্য তারা টিকে থাকে তাদের পাঠকভাগ্য নিয়ে।

সিভয়েস ডেস্ক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়