Cvoice24.com


ইসলামের দৃষ্টিতে হজের বিধান

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ২০ জুলাই ২০১৮
ইসলামের দৃষ্টিতে হজের বিধান

ইতিপূর্বে হজের ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। হজ সঠিকভাবে পালন করতে হলে হজের বিধি-বিধান, হুকুম আহকাম সম্পর্কে জানতে হয়। হজ যেহেতু জীবনে একবার ফরজ তাই আহকাম সম্পর্কে মানুষের সারাজীবন সচেতন থাকতে হয় না কিন্তু যারা হজে গমন করবে তাঁদের জানতে হবে মাসালা মাসায়েন। যে কাজ করবে সে কাজটির আগে বিধান জানা কর্তব্য। হজ তিন প্রকার- ১. হজে ইফরাদ : শুধুমাত্র হজ সম্পাদনের লক্ষেই ইহরাম পরিধান করে তালবিয়া পাঠ করাকে ‘হজ ইফরাদ’ বলে। ২. হজে তামাত্তু : হজের মাসে প্রথম ওমরা আদায় করে হালাক হয়ে ঘরে ফিরে আবার হজের ইহরাম পরিধান করে হজ আদায় করাকে ‘হজে তামাত্তু’ বলে। ৩. হজে কিরান : একই সাথে হজ ও ওমরা পালনের নিয়তে ইহরাম পরিধান করাকে ‘হজে কিরান’ বলে। এই তিন প্রকার হজ আদায় করা জায়েজ আছে। ফতোয়ায়ে শামী গ্রন্থে বর্ণনা আছে, ঈমাম আবু হানিফা (রা.)’র মাজহাব মতে ‘হজে কিরান’ সবচেয়ে উত্তম। তারপর ‘হজে তামাত্তু’, এরপর ‘হজে ইফরাদ’-এর অবস্থান।

হজ ও ওমরা পালনকারীদের জন্য ইহরাম পরিধান করা ফরজ। ‘ইহরাম’ আরবি শব্দ। আভিধানিক অর্থ হারাম বা নিষিদ্ধ করা। হজ ও ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে কোন মুসলমান যখন ইহরাম পরিধান করে তখন তার উপর কিছু হালাল কাজ হারাম হয়ে যায় বলে তাকে ইহরাম বলে। সাধারণ অর্থে আমরা হজ পালনরত অবস্থায় দু’টি পরিধানের চাদরকে ইহরাম বলি।

যে স্থান হতে ইহরাম বাঁধাতে হয় সে স্থানকে বলা হয় মীকাত। ইহরাম পরিধান অবস্থায় যেসব কাজ নিষিদ্ধ তাতে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে মীকাতের পূর্বে নিজ ঘর হতে ইহরাম বাঁধা উত্তম। তা না হলে মীকাত হতে ইহরাম বাঁধা ভালো। বাংলাদেশি হাজীদের জন্য মীকাতের স্থানের নাম ইয়ালামলাম। যারা বিমানযোগে হজ করবেন এবং মক্কা শরীফ পৌঁছবেন তাঁরা যেন বিমানে আরোহণে পূর্বেই ইহরাম পরিধান করেন। কারণ ইয়ালামলাম স্থানটি বিমানে অতিক্রম হয়ে যায়। আর যারা হজ আদায়ের পূর্বে মদিনা শরীফ গমন করবেন তারা ইহরাম ছাড়া মদিনায় গমন করবেন। অতঃপর মদিনার জিয়ারত শেষে যখন হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় গমন করবেন তখন মাসজিদে জুল হুলাইফা হতে ইহরাম পরিধান করবেন। বিমানেও ইহরাম পরিধান করা জায়েজ কিন্তু মীকাত অতিক্রম করার পূর্বেই পরিধান করতে হবে।

মীকাতের বাইরে বসবাসকারী কোন সুস্থ, প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান মক্কা বা হেরাম শরীফে প্রবেশ করতে চায়; সে হজ ও ওমরার উদ্দেশ্যে হোক বা অন্য কোন কাজে হোক, যদি ইহরাম বাঁধা ছাড়া মীকাত অতিক্রম করে তাহলে গুণাহগার হবে। সে ব্যক্তি মীকাতে ফিরে আসা ওয়াজিব। যদি মীকাতে ফিরে না আসে সেখানেই ইহরাম বেঁধে তাহলে তাঁর উপর দম (পশু কোরবানি) ওয়াজিব। মীকাতে ফিরে গিয়ে ইহরাম বাঁধলে দম দিতে হবে না। আর যদি বিনা ইহরাম মক্কায় বা হেরেম প্রবেশ করে তাহলে তাঁর উপর হজ অথবা একটি ওমরা ওয়াজিব হবে। (আলমগীরী ১ম খন্ড)

ইহরাম পরিধান করার পূর্বে শারীরিক পবিত্রতা অর্জন করতে হয়। হাত ও পায়ের নক কেটে, গোঁফ কেটে, মাথার চুল ছোট বগলের পশম ও নাভীর নিচে পরিষ্কার করতে হয়। ইহরামের পূর্বে গোসল করা উত্তম সম্ভব না হলে ওজু করে নেওয়া জরুরি। সেলাইবিহীন দুটি কাপড়, একটি লুঙ্গি অন্যটি চাদর হিসেবে ব্যবহার করবে। সুগন্ধী বা আতর ব্যবহার করতে পারেন অতঃপর মাথায় টুপি পরিধান করে দুই রাকাত সালাতুল ইহরাম (ইহরামের নামাজ) আদায় করবে। প্রথম রাকাতে সূরা কাফেরূন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ইখলাস পড়া উত্তম। নামাজ শেষে বসা অবস্থায় টুপি খুলে হজ বা ওমরার নিয়ত করা হয়। নিয়ত করার ফরজ কিন্তু পড়া ফরজ নয়। নিয়ত না করলে ইহরাম সহীহ হবে না। নিয়ত ছাড়া তালবিয়া পাঠ করলে ইহরাম সহীহ হবে না। ইহরামের জন্য নিয়ত ও তালবিয়া উভয়টি জরুরি (ফতোয়ায়ে আলমগীরী)
হজ বা ওমরা সম্পাদন না করে হইরাম খোলা যাবে না যদি ইহরাম ভেঙে যায় তবুও ইহরাম অবস্থাতেই বহাল থেকে হজ ও ওমরার বাকি কাজ সম্পাদন করতে হবে। কোন ব্যক্তি যদি ইহরাম বাঁধার পরে কোন কারণে হজ পালন করতে না পারে তবে ওমরা পালন করা হালাল হবে। কেউ যদি ইহরাম বাঁধার পর হজ পালনে বাধাগ্রস্ত হয় তখন হেরেম এলাকায় কোরবানির পশু প্রেরণ করতে হবে এবং সেখানে কারো দ্বারা কোরবানি করাতে হবে। ঐ কোরবানি সম্পন্ন হওয়ার পরে ইহরাম খুলতে পারবে।

ইহরামের সুন্নাত এবং মুস্তাহাবসমূহঃ ১. হজের মাসসমূহে ইহরাম বাঁধা, ২. ইহরামের নিয়তে ইহরামের পূর্বে গোসল ও অজু করা, ৩. সেলাইবিহীন একটি চাদর গায়ে দেয়া এবং অন্যটি পরিধান করা, ৪. দুই রাকাত ইহরামের সালাত আদায় করা, ৫. তালবিয়া পাঠ করা, ৬. তিনবার তালবিয়া পাঠ করা, ৭. পুরুষদের উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করা, ৮. ইহরামের নিয়ত করার পূর্বে সুগন্ধী ব্যবহার করা, ৯. ইহরামের পূর্বে উত্তমরূপে দেহের ময়লা পরিষ্কার করা ১০. নক কাটা, ১১. বগল পরিষ্কার করা, ১২. নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করা, ১৩. নতুন বা ধৌত করা সাদা কাপড় (চাদর) পরিধান করা, ১৪. পুরুষদের দুই ফিতাওয়ালা চপ্পল পায়ে পরা, ১৫. ইহরামের নিয়ত পুরুষেরা উচ্চস্বরে পড়া, ১৬. সালাতের পর বসা অবস্থায় নিয়ত করা। (আলমগীরী ১ম খন্ড)

ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ হারামঃ ১. চিবুক বা থুতনি হতে উপরের অংশ মাথার অংশ হিসেবে গণ্য। তাই ইহরামরত ব্যক্তি তা আবৃত করবে না। (মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ) ২. পুরুষরা সেলাইযুক্ত কাপড় পরিধান করা। ৩. ইহরামরত মহিলার জন্য মুখে নেকার পরিধান বা মুখ আবৃত রাখা। ৪. জাফরান, কুসুম বা সুগন্ধি দ্রব্য দ্বারা রং করা কাপড় পরিধান করা। যদি কাপড়টি ধোয়ার কারণে গন্ধ দূর হয় তাহলে পরিধান বৈধ। ৫. পুরুষদের জন্য ঘুমে অথবা জাগ্রত অবস্থায়, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় যেভাবে হোক মাথা কিংবা চেহারা ঢেকে রাখা। ৬. এমন জুতা পায়ে পরা যাতে পায়ের মধ্যবর্তী উঁচু হাড় ঢেকে যায়। ৭. মুখ, চুল ও গোঁফ কাটা অথবা কাউকে দিয়ে কাটানো এবং শরীরের লোম কাটা বা ছিঁড়ে ফেলা। ৮. মাথায় ও দাঁড়িতে এমনভাবে হাত ঝুলানো, যাতে চুল পড়ে যায়। ৯. প্রাণী শিকার করা অথবা শিকারের সহযোগিতা করা। মশা-মাছি, উকুন, পোকামাকড় মারা। ১০. প্রাণী শিকারের হাতিয়ার দিয়ে সহযোগিতা করা ১১. প্রাণী তাড়ানো, প্রাণীর ডিম ভাঙা, পালক ও ডানা তুলে ফেলা, শিকারের দুধ দোহন করা, শিকারের ডিম অথবা গোস্ত রান্না করা। ১২. চুল দাঁড়িতে খেযাব লাগানো। ১৩. সাবান দ্বারা মাথার চুল, দাঁড়ি ইত্যাদি ধোয়া। ১৪. ইহরাম অবস্থায় মাথা চুলকানো জায়েজ নয়। তবে বেশি প্রয়োজন হলে খুব আস্তে আস্তে চুলকাবেন যাতে চুল না উঠে এবং উকুন ঝড়ে না পড়ে। ১৫. গাছপালা কর্তন করা। ১৬. কারো সাথে ঝগড়া-বিবাধ, রাগারাগি, গীবত, অপবাদ, হাসি-তামাসা, অশ্লীল কথা এবং পাপাচার করা। ১৭. ঘাস বা গাছের পাতা বা ডাল ভাঙা। ১৮. সুগন্ধিযুক্ত জর্দা খাওয়া ও ধ‚মপান করা এবং সুগন্ধিযুক্ত টিস্যু ব্যবহার করা। ১৯. পুরুষদের সামনে মহিলাদের বেপর্দায় থাকা বা চলাফেরা করা। ২০. কাপড় ও শরীরে সুগন্ধিযুক্ত দ্রব্য ব্যবহার করা। (ফতোয়ায়ে আলমগীরী, ১ম খন্ড, হিদায়া ১ম খন্ড, শামী ২য় খন্ড)
উল্লিখিত নিষিদ্ধ কাজগুলোর কোনটি সংগঠিত হরে দম (একটি বকরী) কোরবানি করা ওয়াজিব। 
(চলবে)

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়