Cvoice24.com


সক্রেটিসের ভাবনা

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ১৪ জুলাই ২০১৮
সক্রেটিসের ভাবনা

র্শনের ইতিহাসে তিনজন মহাজ্ঞানী রয়েছেন। তারা হলেন সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটল। যুগ যুগ ধরে তারা দর্শনের মহাকাশে নক্ষত্রের ন্যায় জ্বলছেন। যদিও প্লেটো ও এরিস্টটলের লিখিত বই রয়েছে, কিন্তু সক্রেটিসের লেখা কোনও বই নেই। তবুও এই মানুষটি কেমন করে বিশ্বে দর্শন আকাশের নক্ষত্র? অনেক কৌতূহল তাকে ঘিরে! সক্রেটিস কোনও বই লিখেননি, তাতে কি? তিনি তার ভাবশিষ্য প্লেটোকে তো রেখে গিয়েছিলেন। প্লেটোর লিখা বইগুলোতেই তার সম্পর্কে জানা যায়। তার জীবনের বিস্তৃত সূত্র হিসেবে বর্তমানে রয়েছে তিনটি উৎস। প্লেটোর ডায়ালগসমূহ, এরিস্টোফেনিসের নাটক সমূহ ও জেনোফেনোর ডায়ালগসমূহ।

সক্রেটিস খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০ অব্দে গ্রীসের এথেন্স এ জন্ম গ্রহন করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে রাষ্ট্রদ্রোহীতার কারণে হেমলক বিষ পানের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার পিতা একজন ভাস্কর ছিলেন ও মা ছিলেন ধাত্রী। শোনা যায়, তিনি প্রথমে পিতার পেশাকে বেছে নেন। পরে অজানাকে জানার নেশায় এই পেশা ছেড়ে দিয়ে দর্শনে মনোযোগী হন। এনাক্সাগোরাস ছিলেন তার ভাবগুরু।

 

‘নৌ দাইসেল্ফ’ এই উক্তির জন্য অমর হয়ে আছেন সক্রেটিস, যার অর্থ- ‘নিজেকে জানো।’ সত্যিই নিজেকে জানলেই তবে অন্য কিছু সম্পর্কে জানা সম্ভব। এই সত্যটিই তিনি আকরে ধরেছিলেন। এথেন্সের পথে পথে তিনি ঘুরতেন, আর সুযোগ পেলেই লোকজনকে নানা রকম অদ্ভুদ প্রশ্ন করতেন। প্রশ্নগুলোর উত্তর তিনি নিজে থেকেই উন্মোচন করতেন। আর জানতে চাইতেন অন্য লোকজন তার প্রশ্নের উত্তর কী দেয়। নিজের সঙ্গে অন্যের উত্তরের তুলনা করতেন। অর্থাৎ, তিনি জ্ঞান অন্বেষণ করতেন। লোকজন যদি তাকে জ্ঞানী বলতেন, তিনি বলতেন, ‘তোমরা আমাকে জ্ঞানী বলো না। কারন, আমি জ্ঞানী নই। আমি জ্ঞান অনুরাগী।’

পশ্চিমা দর্শনের এ জনকের চোখে মানুষের আসল সৌন্দর্য হলো তার জ্ঞান। আর সবচেয়ে খারাপ হলো অজ্ঞান। জ্ঞানী সর্বদাই জানে যে, সে কিছুই জানে না। সক্রেটিস বলতেন,` আই নৌ দ্যাট আই নৌ নাথিং`। অর্থাৎ আমি জানি যে আমি কিছুই জানি না। যদি কেউ মনে করে যে সে কিছুই জানে না, তাহলে সে জানতে আগ্রহী হবে। ফলে জ্ঞানের পরিধি বাড়বে। এটাই হয়ত এই উক্তির মূলমন্ত্র ছিলো। তার মতে বিস্ময় হলো জ্ঞানের শুরু। অর্থাৎ কোনকিছুর প্রতি বিস্ময় জন্মালে তবেই তা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন শুরু হয়। তার মতে জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রশ্ন-উত্তর অতি প্রয়োজনীয়। আর সেজন্যই হয়ত সবাইকে প্রশ্ন করত।

প্রশ্নের মাধ্যমেই দর্শনগত আলোচনা চালিয়ে যেতেন। প্রথমে যুক্তির ফাঁদ পাততেন। তারপর যতক্ষন প্রতিপক্ষ পরাজিত হয়ে ভুল স্বীকার না করত, ততক্ষন প্রশ্ন করতেই থাকতেন। এই পদ্ধতিটিকে ` সক্রেটিসের শ্লেষ` বা ` সক্রেটিক আইরোনি` বলা হয়। এর মাধ্যমে উত্তরদাতা তার চেষ্টার সর্বোচ্চ স্তরে পৌছে যান। ব্যক্তির থেকে উত্তর বের করে তাকে দেখিয়ে দিতেন যে, জ্ঞানটা তার মধ্যেই ছিলো। এভাবেই তিনি মানুষের মাঝে জ্ঞান চর্চা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

সক্রেটিস দেখতে সুন্দর ছিলেন না। প্রসস্ত টাক বিশিষ্ট মাথা, বৃহদাকার শরীর, চ্যাপ্টা নাক, ছোট চোখ। এরকমই ছিলো তার দৈহিক কাঠামো। কিন্তু দৈহিক সৌন্দর্যই কি সব? মনটা ছিলো তার রসে ভরপুর। রসিকতা করেই শিক্ষা দিতেন। পথ-ঘাটকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিনত করেছিলেন। উদাসীন হয়েছিলেন সংসারের প্রতি। আর তাই স্ত্রী জানথপির রোষানলে বারবার পুড়েছেন। কিন্তু যার মন রসে পরিপূর্ণ, সে কি দগ্ধ হতে পারে? কথিত আছে যে, একদিন জানথপি অনেক বেশি রেগে যায়। কিন্তু সক্রেটিস সেদিকে কর্ণপাত না করে আপন মনে বই পড়ে যায়। তা দেখে জানথপি আরও রেগে যায়। সে এক বালতি পানি নিয়ে যায় ও সক্রেটিসের মাথায় ঢেলে দেয়। এতেও তিনি রেগে যাননি। বরং কৌতুক করে বলেছিলেন, `মেঘ গর্জন করার পর এক পশলা হওয়াটাই স্বাভাবিক।` এই বলে তিনি বাইরে চলে যান।

এই সহজ সরল মানুষটির পেছনে এক সময় শত্রু লেগে যায়। তারা হলো তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী ও জ্ঞানী বলে যারা পরিচিত ছিলো। তারা সক্রেটিসকে দেখলে তাদের মুখ শুকিয়ে যেতো। কারণ তারাও তার প্রশ্নে বিদ্ধ হয়ে হার মানত। তাই তার পেছনে শত্রুতা শুরু হয়। প্রচলিত দেব-দেবীর মূর্তির বিরোধিতা করার অভিযোগ যা রাষ্ট্রদ্রোহীতার সঙ্গে তুলনা হতো। আর তিনি যুব সমাজকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন। যুব সমাজের মধ্যে দুর্নীতি ও চরিত্রহীনতা প্রবেশ করানোর অভিযোগেও অভিযুক্ত করা হয়। তার শাস্তি স্বরূপ মৃত্যুদণ্ড স্থির করা হয়। প্লেটোর `ফিডো` গ্রন্থে সক্রেটিসের মৃত্যুর কথা বলা আছে। তার মৃত্যুর জন্য হেমলক বিষ আনা হয়। কারাগার থেকে পালানোর জন্য তিনি ক্রিটোর অজুহাত প্রত্যাখান করেন। বিষ পান করানোর পর কর্তৃপক্ষের আদেশে তাকে হাটতে বলা হয়।শরীর অবশ হয়ে আসা পর্যন্ত হাটতে থাকেন। তারপর শুয়ে পরেন। মৃত্যুর সময় ক্রিটোকে বলেছিলেন, " অ্যাসক্লেপিয়াস ( প্রচীন গ্রীসের আরোগ্যলাভের দেবতা) একটি মোরগ পায়, ওইটা পরিশোধ করে দিও।" এর থেকে কি বুঝা যায়? তিনি মৃত্যুকেই `আরোগ্যলাভ` বলে ইঙ্গিত করেছেন। তারপর ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ হয়ে যায় তার। দর্শন আকাশের জ্বলন্ত একটি তারকা খসে যায়। কিন্তু তার জ্যোতি আজও আমাদেরকে আলোকিত করে।

সূত্র: উইকিপিডিয়া, প্লেটোর ‘ফিডো’ ও ডায়ালগ সমূহ

লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী।

সিভয়েস ডেস্ক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়