Cvoice24.com

কথাসাহিত্যের শিল্পশৈলী : অ্যালিস মুনরোর সঙ্গে কথোপকথন

প্রকাশিত: ১১:২৪, ৭ এপ্রিল ২০১৮
কথাসাহিত্যের শিল্পশৈলী : অ্যালিস মুনরোর সঙ্গে কথোপকথন

কানাডার কথাসাহিত্যিক অ্যালিস মুনরো ২০১৩ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি মূলত ছোটগল্পকার। ছোটগল্প রচনায় অসাধারণ নৈপুণ্য তাঁকে এ-সম্মান এনে দিয়েছে। অবশ্য এর আগেও মুনরোর সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি এসেছে; নিজ দেশে তিনি তিনবার ‘Governor General Award’ লাভ করেছেন এবং ২০০৩ সালে তিনি Away From Her গল্পগ্রন্থের জন্য অর্জন করেছেন ‘Man Booker International Prize’। তাঁর ছোটগল্প The New Yorker, The Paris Review এবং The Atlantic Monthly-সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। মুনরোর গল্পের প্রেক্ষাপট জুড়ে আছে অন্টারিওর একটি ছোট মফস্বল শহর ‘Huron County’, যেখানে  তিনি তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। অনেক সমালোচক মুনরোর লেখনীকে স্মৃতিচারণের সঙ্গে তুলনা করছেন, কেননা তাঁর গল্পের বিষয়বস্ত্ততে প্রাধান্য পেয়েছে মুনরোর ব্যক্তিজীবনের নানাবিধ অভিজ্ঞতা। 

তিনি মূলত ১৯৫০ সাল থেকে ছোটগল্প রচনায় ব্যাপৃত এবং তাঁর প্রথম গল্প ছাপা হয় কলেজ শিক্ষার্থীদের সাহিত্য পত্রিকা Fliio-তে, শিরোনাম ছিল ‘The Dimension of Shadow’।১৯৯৪ সালে তিনি জ্য ম্যাকক্যলকে প্যারিস রিভিউ পত্রিকার জন্য একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। উলেস্নখ্য, প্যারিস রিভিউ পত্রিকার সাক্ষাৎকারগুলো একটি বিশেষ চরিত্র বহন করে; এখানে সাহিত্যিকরা তাঁদের রচনারীতি, অভ্যাস, সময়সূচি, লেখালেখির মূলমন্ত্র, দুর্বলতা, ব্যর্থতা এবং লেখালেখির সংকট ও উত্তরণের পন্থা নিয়ে খোলাখুলি আলাপ-আলোচনা করে থাকেন। মুনরোর এ-সাক্ষাৎকারে তার প্রমাণ মেলে। কেননা, এখানে উঠে এসেছে মুনরোর ব্যক্তিজীবন, পরিবার, সংসার, বিবাহ, প্রেম, প্রাত্যহিক সময়সূচি, লেখা নিয়ে সংকট এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর শঙ্কা ইত্যাদি প্রসঙ্গ।

সাহিত্য রচনায় সাফল্য অর্জনের জন্য তিনি কয়েকটি সরলসত্য প্রকাশ করেছেন, যেমন : কেউ যদি প্রচ- পরিশ্রম করে তাহলে সে সফল হতে পারবে। আরো কিছু অকপট সত্য তিনি স্বীকার করেছেন, যা আমরা সচরাচর এত বড়মাপের লেখকের কাছ থেকে শুনি না। যেমন – তিনি সবসময় সাহিত্য পরিম-ল এড়িয়ে চলতেন এবং কারণটা ছিল ‘ভয়’। মুনরো স্বীকার করেছেন যে, অন্যান্য লেখকের কথাবার্তা এবং আলোচনা শুনে যদিও তাঁর মনে হতো যে, তারা তাঁর চেয়ে বেশি জানে কিংবা তাঁর চেয়ে দক্ষ, তাহলে সেটা তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতে পারত। আরো একটি ব্যাপার নিয়ে তাঁর আতঙ্ক; বার্ধক্য। বার্ধক্য চলে এলে তখন তাঁর কী হবে, কিংবা লেখালেখির ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে তাঁর কী করার থাকবে?  

আদ্যন্ত তাঁর সাক্ষাৎকারটি পড়লে মনে হবে কোনো এক অনভিজ্ঞ সাহিত্যিকের মতামত শুনছি, জ্য ম্যাকক্যলকের কাছেও ব্যাপারটি সেরকমই মনে হয়েছে। পাঠকরা, বিশেষত তরুণ কথাসাহিত্যিকরা এ-কথোপকথন থেকে প্রেরণা পাবেন এমন প্রত্যাশায়।– লেখক নিউইয়র্ক সিটি থেকে অন্টারিওর ক্লিনটনে কোনো সরাসরি উড়োজাহাজ নেই, তিন হাজার বাসিন্দার একটি কানাডীয় শহর ক্লিনটন, যেখানে অ্যালিস মুনরো বছরের বেশিরভাগ সময় থাকেন। জুনের খুব সকালে, টরন্টোতে একটি গাড়ি ভাড়া করে, আমরা লাগার্দিয়া ছেড়ে তিন ঘণ্টার পথ পেরিয়ে এলাম, রাস্তা ক্রমশ সরু হয়ে অনেকটা গ্রামীণ রূপ নিচ্ছিল। সাঁঝের কাছাকাছি আমরা মুনরো যে-বাড়িতে তাঁর দ্বিতীয় স্বামী গ্যারি ফ্রেমলিনকে নিয়ে থাকেন তার কাছে থামলাম। বাড়িটার পেছনে একটি টানা উঠোন এবং একটি অগোছালো ফুলবাগিচা, এটাই হচ্ছে সেই বাড়ি, মুনরো খুলে বলেছিলেন, যেখানে গ্যারি জন্মেছিল। রান্নাঘরে তিনি সুবাসিত লতাপাতা দিয়ে একটি সাদামাটা পদ রাঁধছিলেন। খাবারঘরের চাতাল থেকে মাচা পর্যন্ত বইয়ের সারি; একপাশে ছোট টেবিলের ওপর একটি সেকেলে টাইপরাইটার। মুনরো এখানেই কাজ করেন।কিছুক্ষণ বাদে, তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন একটি বড় শহর এবং প্রশাসনিক কেন্দ্র গোদেরিচে, সেখানে আমাদের রাখলেন আদালত ভবন থেকে চত্বর বরাবর বেডফোর্ড হোটেলে। উনিশ শতকের একটি দালান, কামরাগুলো আরামদায়ক (দুটি বিছানা, কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই)। দেখলে মনে হবে যেন মুনরোর একটি গল্পের গ্রন্থাগারিক কিংবা ইশ্কুলের কোনো প–ত থাকেন। 

পরের তিনদিন আমরা তাঁর বাড়িতে কথাবার্তা বলেছি – তবে কোনো টেপরেকর্ডার চালু না করেই। তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলাম আমাদের হোটেলের ছোট কক্ষে, যেহেতু তিনি চেয়েছিলেন ‘ব্যাপারটা বাড়ির বাইরে থাকুক’। মুনরো এবং তাঁর স্বামী দুজনেই বেড়ে উঠেছেন এখন যেখানে থাকেন সেখান থেকে কুড়ি মাইলের আওতায়; এখানের প্রায় প্রতিটি দালানকোঠার ইতিহাস তাঁদের জানা, যেগুলো আমরা পেরিয়ে এসেছি, যেগুলোর তারিফ করেছি, কিংবা যেগুলোর ভেতরে আমরা খাওয়া-দাওয়া করেছি। 

জিজ্ঞেস করলাম আশপাশের সাহিত্য পরিম-লটা কেমন পাওয়া যাবে। ‘যদিও গদেরিচে একটি গ্রন্থাগার আছে’, আমাদের বলা হলো, ‘কাছাকাছি বইয়ের দোকান হলো স্ট্রাফোর্ডে, প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে।’ এখানে আর কোনো স্থানীয় লেখক আছেন কিনা যখন জানতে চাইলাম, তিনি আমাদের একটি জরাজীর্ণ বাড়ির পাশ কাটিয়ে নিয়ে গেলেন, পেছনের বারান্দায় একটি লোক উদোম গায়ে বসে একটা টাইপরাইটারে নুয়ে আছেন, তাঁর চারপাশে বিড়াল। ‘প্রতিদিন তিনি ওখানটায় এসে বসেন’, মুনরো বললেন, ‘রোদ হোক আর বৃষ্টি হোক। আমি ওনাকে চিনি না, তবে আমার সাংঘাতিক জানার আগ্রহ, তিনি কী লিখছেন।’কানাডায় আমাদের শেষ সকালটিতে, পথঘাটের নির্দেশনা নিয়ে, আমরা সেই বাড়িটা খুঁজে বের করলাম, যেখানে মুনরো বড় হয়েছিলেন। 

বাড়িটা বানিয়েছিলেন তাঁর বাবা এবং সেখানে উদ পালন করতেন। অনেকগুলো কানাগলির পর, আমরা সে-বাড়িটা খুঁজে পেলাম – গাঁয়ের পথের একেবারে শেষ প্রামেত্ম – একটা সুন্দর ছিমছাম ইটের বাড়ি, খোলা প্রান্তরমুখী, যেখানে একটি উড়োজাহাজ থেমে আছে, মনে হয় যেন সাময়িক অবতরণ করেছে। আমাদের অবস্থান থেকে বাতাসের মোহনীয় আমেজ সহজেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। এক বৈমানিক গাঁয়ের বধূকে নিয়ে যাচ্ছিল, যেমনটি আছে, ‘White Dump’ গল্পে, কিংবা ‘How I Met My Husband’ গল্পের তরুণ, aviation stuntsman (যারা উড়োজাহাজের কসরত দেখায়) যে কিনা, এরকম একটি মাঠেই অবতরণ করেছিল।

যেমন বাড়িটি, যেমন অন্টারিওর দিগন্ত, যা আমেরিকার Midwest-এর অনুরূপ, মুনরো তেমন ভাবগম্ভীর নন, তিনি মার্জিত, যথেষ্ট রসিক। ছোটগল্পের সাতটি গ্রন্থের লেখিকা, সঙ্গে আছে প্রকাশিতব্য Open Secrets এবং একটি উপন্যাস Lives of Girls and Women। অর্জন করেছেন গভর্নর জেনারেল পুরস্কার (কানাডার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার) এবং নিয়মিত ছাপা হচ্ছে Best American Short Stories-এ (রিচার্ড ফোর্ড মুনরোর দুটি গল্প অন্তর্ভুক্ত করেছেন তাঁর সম্পাদিত খ–) এবং  Prize Stories : The O. Henry Awards; দি নিউ ইয়র্কার পত্রিকার নিয়মিত লেখিকা তো বটেই। এসব উলেস্নখযোগ্য অর্জন সত্ত্বেও তিনি এখনো লেখালেখি সম্পর্কে কথা বলেন, গভীর শ্রদ্ধা আর অনিশ্চয়তার সঙ্গে যা শোনা যাবে শিক্ষানবিশদের কাছে। 

তাঁর মধ্যে বিখ্যাত লেখকদের কোনো উচ্ছ্বাস, নৈপুণ্য বা হাঁকডাক নেই, তিনি যে কেউ একজন – সেটা সহজেই ভুলে যাওয়া যায়। নিজের রচনা সম্পর্কে বলতে, তিনি যা সৃজন করেন তা যে খুব সহজ তা তাঁর মনে হয় না। তবে সম্ভব, যেন কেউ এটা করতে পারবে যদি যথেষ্ট খাটাখাটুনি করে। আমরা যখন ফিরে আসি তখন আমাদের মধ্যে সেই সম্ভাব্যতার সংক্রমণ ঘটছে মালুম হলো। মনে হবে সাদামাটা – কিন্তু তাঁর লেখায় আছে যথাযথ সারল্য, যা মকশো করতে বছরের পর বছর লেগে যাবে এবং দরকার হবে প্রচুর খসড়ার। 

সিনথিয়া ওজিক যেমন বলেছেন, ‘আমাদের চেখভ এবং তাঁর সমসাময়িকদের বেশিরভাগের তুলনায় তিনি অনেকদিন টিকে থাকবেন।’

জ্য ম্যাকক্যলক, মোনা সিম্পসন, ১৯৯৪।

জ্য ম্যাকক্যলক : আপনি যে-বাড়িতে বড় হয়েছিলেন, আজ সকালে আমরা সে-বাড়িতে গিয়েছিলাম। আপনি কি আপনার পুরো শৈশবটা ওখানে কাটিয়েছেন? 

মুনরো : হ্যাঁ, যখন বাবা মারা যান, তিনি তখনো ওই খামারবাড়িতেই থাকতেন, ওটা ছিল একটা শিয়াল আর উদ পালনের খামার। যদিও বাড়িটা অনেক বদলেছে। এখন ওটা বিউটি পার্লার, নাম Total Indulgence। আমার মনে হয় ওরা পার্লারটা করেছে পেছনের দিকটায়, আর রান্নাঘরটা পুরোপুরি ভেঙে ফেলেছে।

জ্য ম্যাকক্যলক : তারপর কি আপনি কখনো ভেতরে গেছেন?মুনরো : না, যাইনি, যদি যেতাম তাহলে বৈঠকখানাটা দেখতে চাইতাম, সেখানে বাবার বানানো একটা ফায়ারপেস্নস ছিল, সেটা দেখতাম। মাঝেমধ্যে ভাবতাম যাই, গিয়ে একটু ম্যানিকিউর করাই।

জ্য ম্যাকক্যলক : রাস্তার ওধারের মাঠে আমরা একটা উড়োজাহাজ দেখলাম, মনে পড়ল ‘White Dump’ এবং ‘How I Met My Husband’ গল্পের কথা।

মুনরো : হ্যাঁ, কিছুকালের জন্য ওটা একটা এয়ারপোর্ট ছিল। ওই খামারের যিনি মালিক তাঁর উড়োজাহাজ চালানোর শখ ছিল, এবং তাঁর নিজের একটা ছোট উড়োজাহাজ ছিল। তিনি কখনোই ক্ষেতখামারি পছন্দ করতেন না। ফলে ওসব ছেড়েছুড়ে উড়োজাহাজ চালানোর প্রশিক্ষক হলেন। এখনো বহালতবিয়তে আছেন, এবং আমার এ-যাবৎ দেখা সুপুরুষদের অন্যতম। সম্ভবত অবসর গ্রহণের তিন মাসের মতো হবে, তিনি ভ্রমণে গিয়ে কিছুটা অস্বাভাবিক রোগে আক্রান্ত হন, যা গুহায় থাকা বাদুড়ের মাধ্যমে হয়ে থাকে।

জ্য ম্যাকক্যলক : আপনার প্রথম বই Dance of the Happy   Shades-র গল্পগুলোয় ওই এলাকার ছাপ লক্ষ করা যায়, আপনার শৈশবের জগৎ। আপনার জীবনের কোন সময়টায় এই গল্পগুলো লেখা?

মুনরো : এগুলো লেখার সময়ের ব্যাপ্তি পনেরো বছর। ‘The Day of Butterfly’ ছিল একেবারে গোড়ার দিকের। সম্ভবত লেখা হয়েছিল যখন আমার বয়স একুশ। খুব ভালোভাবে স্মরণ করতে পারি ‘Thanks for the Ride’ লেখার কথা, কেননা আমার প্রথম সমত্মান আমার পাশে ওর ছোট শয্যায় শুয়ে থাকত। তখন আমি ছিলাম বাইশ বছরের। বেশ পরের দিকের গল্পগুলো লেখা হয়েছিল যখন আমার বয়স ত্রিশের কোঠায়। ‘Dance of the Happy Shades’ হলো একটি; আরেকটি ছিল ‘The Peace of Utrecht’। ‘Image’ হচ্ছে একদম সম্প্রতি। ‘Walker Brothers Cowboy’ও লেখা হয়েছিল আমার ত্রিশের পরে। ফলে রচনার ব্যাপ্তিটা বেশ ছড়ানো।

জ্য ম্যাকক্যলক : ওই গল্পগুলো এখন আপনাকে কীভাবে আকর্ষণ করে? আপনি কি ওগুলো আবার পড়েন?

মুনরো : ওই সংকলনের শুরুর দিকের একটি গল্প, নাম ‘The Shinning House’ আমাকে টরন্টোর হার্বরফ্রন্টে দু-তিন বছর আগে পড়তে হয়েছিল Tamarack Review-র ইতিহাস উদযাপনের একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের সময়। যেহেতু গল্পটা ওই পত্রিকার প্রথম  দিকের একটি সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল; অতএব পড়ার জন্য আমাকেই উঠে দাঁড়াতে হলো, তবে কাজটা ছিল খুব কঠিন। মনে হয় আমি ওই গল্পটা লিখেছিলাম যখন আমার বয়স বাইশ। পড়ার সময়েই আমি কাটছাঁট চালিয়ে গেলাম, সে-সময়ের খাটানো সব ফন্দিফিকির ধরে ফেলতে ফেলতে, যা এখন মনে হয় খুবই সেকেলে। পরের অনুচ্ছেদ পড়ার আগেই আমি চোখ বুলিয়ে আগেভাগেই সেগুলো দ্রুত ঠিক করার চেষ্টা করছিলাম, কেননা আমি তো ওটা আগেভাগে পড়িনি। আমি কোনো লেখাই আগেভাগে পড়ি না। যখন আমি পুরনো গল্পগুলো পড়ি, তখন অনেক ব্যাপার আমার চোখে পড়ে, যা আমি এখন করতাম না, পঞ্চাশের দিকে লোকে যা করত।

জ্য ম্যাকক্যলক : ছাপা হওয়ার পরে আপনি কি কোনো গল্প পরিমার্জন করেছেন? প্রম্নস্ত যেমন মৃত্যুর আগে Remembrance of Things Past-এর প্রথম খ- আবার লিখেছিলেন।

মুনরো : হ্যাঁ, হেনরি জেমস তাঁর সহজবোধ্য লেখাগুলো আবার লিখেছিলেন, ফলে সেগুলো জটিল আর দুর্বোধ্য হয়ে যায়। আসলে সম্প্রতি আমি এমনটি করেছি। ‘Carried Away’ গল্পটা Best American Short Stories ১৯৯১-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। আমি সংকলনের ভেতর থেকে এটা আবার পড়লাম, কেননা আমি দেখতে চেয়েছিলাম গল্পটা কেমন ছিল এবং একটা অনুচ্ছেদ খুঁজে পেলাম, যেটা মনে হয়েছে খুবই নাজুক। একটা গুরুত্বপূর্ণ ছোট অনুচ্ছেদ ছিল, দুটো বাক্যের মতো হবে। আমি শুধু কলমটা নিয়ে সংকলনের কিনারায় আবার লিখলাম এজন্য যে, যখন আমি গল্পগুলো বই আকারে প্রকাশ করব, তখন যেন এটা ওখানে উল্লেখ করার জন্য পাই। মাঝেমধ্যেই আমি পরিমার্জন করি ওই পর্যায়ে গেলে, যখন লেখায় ভুল ধরা পড়ে, এ-কারণে যে, আমি আসলেই গল্পের ছন্দের ভেতরে মোটেও ছিলাম না। কিছু কিছু লেখা দেখি যেগুলো মনে হয় খুব একটা কাজ করে না, যতটা করার কথা, এবং পড়া শেষ হলেই আমি তা পরিমার্জনের জন্য বেছে ফেলি। তারপর যখন আমি চূড়ান্তভাবে গল্পটি আবার পড়ি, তখন মনে হয় একটু খাপছাড়া লাগছে যেন। ফলে এ-ধরনের কাজে আমি যথেষ্ট নিশ্চিত নই।

জ্য ম্যাকক্যলক : আপনি না বলেছিলেন, আপনার চলতি লেখা কখনো বন্ধুদের দেখান না।

মুনরো : না। আমি কাউকেই কোনো চলমান লেখা দেখাই না।জ্য ম্যাকক্যলক : সম্পাদকের ওপর আপনি কতখানি ভরসা করেন?

মুনরো : গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদনার ক্ষেত্রে The New Yorker ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। আমি কমবেশি পাঠ-সম্পাদনা করতাম, সঙ্গে বেশি না, সামান্য কিছু পরামর্শ থাকত। আমার এবং সম্পাদকের মধ্যে একটা বোঝাপড়া থাকতে হবে কী ধরনের ব্যাপার ঘটবে। ধরা যাক, একজন সম্পাদক যিনি ভাবলেন উইলিয়াম মাক্সওয়েলের গল্পে কোনো কিছুর দরকার হবে না, তিনি আমার ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসবেন না। সম্পাদকের খুব প্রখর দৃষ্টি থাকতে হবে – আমি যেসব উপায়ে নিজেকে ফাঁকি দিতে পারি। The New Yorker-এর চিফ ম্যাকগ্রা ছিলেন আমার প্রথম সম্পাদক, তিনি খুব ভালো। আমি তাজ্জব হয়ে যেতাম যে কেউ অতটা গভীরভাবে নজর দিতে পারে, আমি যা করতে চাইতাম। কখনো কখনো আমরা খুব একটা কিছু করতাম না, তবে মাঝেমধ্যে তিনি আমাকে যথেষ্ট নির্দেশনা দিতেন। একটা গল্প আমি আবার লিখেছিলাম, শিরোনাম ছিল ‘The Turkey Season’, যে-গল্পটি তিনি ইতোমধ্যে কিনে ফেলেছিলেন। ভেবেছিলাম গল্পের নয়া সংস্করণটি তিনি অকপটে গ্রহণ করবেন, কিন্তু তিনি তা করলেন না। বললেন, উ-ম-ম-ম, নয়া সংস্করণে অনেক জিনিস আছে, যা আমার খুব ভালো লেগেছে, এবং আগের সংস্করণেও অনেক জিনিস আমার খুব ভালো লেগেছে। তো আমরা কেন সেটা দেখছি না? তিনি কখনো এমন করে বলতেন না যে, আমরা করব। অতএব, আমরা দুটোকে জুড়ে দিলাম, এবং সেভাবে একটা ভালো গল্প পেয়েছিলাম, মনে হয়।

জ্য ম্যাকক্যলক : ব্যাপারটা কীভাবে ঘটল? ফোনে, নাকি চিঠিতে? আপনি কি কখনো The New Yorker-এ গিয়েছিলেন এটা ঠিকঠাক করতে?

মুনরো : চিঠির মাধ্যমে। আমাদের মধ্যে ফোনে যোগাযোগের সম্পর্কটি খুব কার্যকর, তবে আমাদের মাত্র কয়েকবার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে।

জ্য ম্যাকক্যলক : The New Yorker-এ কখন আপনার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়?মুনরো : আমার প্রথম গল্প, ‘Royal Beatings’ ছাপা হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। তবে আমি পঞ্চাশের দশকে আমার প্রথম দিকের সব গল্পই The NewYorker-এ পাঠিয়েছিলাম, এবং তারপর অনেকদিন আমি পাঠানো বন্ধ রাখি এবং শুধু কানাডার পত্রিকাগুলোতে পাঠাতাম। The New Yorker যদিও আমাকে সুন্দর সুন্দর চিরকুট পাঠাত – পেনসিলে লেখা, অনানুষ্ঠানিক বার্তা। তারা কখনো ওতে স্বাক্ষর করত না। চিরকুটগুলো মোটেও উৎসাহব্যঞ্জক ছিল না। একটার কথা আমার এখনো মনে পড়ে : লেখা অত্যন্ত চমৎকার, কিন্তু থিমটা হচ্ছে একেবারে সেকেলে। সেটা অবশ্য ছিলও বটে। দুজন বর্ষীয়ান মানুষের ভেতরে অনুরাগ – এক প্রবীণ আইবুড়ি ব্যাপারটা যে তার জন্য, সেটা জানল যখন এক বয়স্ক চাষি তাকে প্রেমের প্রস্তাব করল। আমার গল্পে প্রচুর আইবুড়ো-বুড়ি আছে। গল্পটার শিরোনাম ছিল, ‘The Day the Asters Bloomed’, সত্যিই ভয়াবহ ছিল। তাছাড়া যখন আমার বয়স ছিল সতেরো তখন তো আমি ওটা লিখিনি; আমি ছিলাম পঁচিশ। জানি না কেন যে আমি আইবুড়ো-বুড়িদের নিয়ে লিখতাম।

জ্য ম্যাকক্যলক : আপনার যখন বিয়ে হয় তখন তো আপনার অল্প বয়স। এমন তো নয় যে, আপনি একজন আইবুড়ির জীবনযাপন করছিলেন।

মুনরো : আমার ধারণা, মনের দিক থেকে আমি যে একজন আইবুড়ি সেটা জানতাম।

জ্য ম্যাকক্যলক : আপনি সবসময়ই লিখতেন?

মুনরো : সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণি থেকেই লিখতাম।

জ্য ম্যাকক্যলক : যখন কলেজে ঢুকলেন তখন কি আপনি পুরোদস্ত্তর লেখক?

মুনরো : হ্যাঁ। আমার অন্য কিছু হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না, কেননা আমার কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। আমি জানতাম যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে দুবছর পড়তে পারব, কেননা সে-সময়ে যে-বৃত্তিটা দেওয়া হতো তার মেয়াদ ছিল দুবছর। আমার জীবনে এই দুবছর ছিল একটা স্বল্প ছুটি, খুব চমৎকার সময়। তেরো-চোদ্দ থেকেই আমার ওপর গৃহস্থালির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টা ছিল আমার জীবনের একমাত্র সময়, যখন আমাকে বাড়িঘর সামলানোর কাজ করতে হয়নি।

জ্য ম্যাকক্যলক : সেই দুবছরের পরপরই কি আপনি বিয়ে করেন?

মুনরো : দ্বিতীয় বর্ষের একদম পরেই আমি বিয়ে করি। আমার বয়স তখন কুড়ি। আমরা ভ্যানকুভার গেলাম। বিয়েটাই ছিল একটা বিশাল ব্যাপার – বিস্তর অ্যাডভেঞ্চার, ছুটে চলা। আমরা যতদূর যেতে পারতাম যেতাম এবং থাকতাম গাঁয়ের দিকটায়। তখন আমরা কেবল কুড়ি আর বাইশ। তাড়াতাড়িই আমরা নিজেদের যথাযথ মধ্যবিত্তের সংসারে থিতু করলাম। ভাবতাম একটা বাড়ি হবে, একটা বাচ্চা নেব, এবং এগুলো আমরা খুব তাড়াতাড়িই করে ফেললাম। আমার প্রথম সন্তান হয় একুশ বছরে। 

জ্য ম্যাকক্যলক : এতকিছুর মধ্যেও কি আপনি লিখছিলেন?

মুনরো : গর্ভকালে আমি মরিয়া হয়ে লিখছিলাম, কেননা আমি ভাবতাম, পরে আর কখনোই লিখতে পারব না। প্রতিটি গর্ভধারণ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে সমত্মান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে বড় কিছু একটা করার। আসলে আমার বড় কোনো কিছুই করা হয়নি।

জ্য ম্যাকক্যলক : ‘Thanks for the Ride’ গল্পটি আপনি একটি শহুরে উদাসীন ছেলের দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখছেন, যে একটি গরিব মফস্বলের মেয়েকে রাত কাটানোর জন্য নিয়ে আসে এবং তার সঙ্গে শূয় এবং তার দীনতায় যেমন কৌতূহল বোধ করে, তেমনি বিরক্তও হয়। এটা লক্ষণীয় যে, গল্পটা যখন এসেছে তখন আপনার জীবনটা ছিল একদম স্থির, পরিপূর্ণ।

মুনরো : আমার বড় মেয়ে যখন পেটে তখন আমার স্বামীর এক বন্ধু গ্রীষ্মে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি মাসখানেকের বেশি সময় আমাদের সঙ্গে ছিলেন। কাজ করতেন ন্যাশনাল ফিল্ম বোর্ডে (National Film Board), ওদিকে একটা চলচ্চিত্রের কাজ করছিলেন। তিনি আমাদের অনেক কাহিনি বলেছিলেন; আমাদের জীবনের ছোটখাটো মজার মজার ঘটনা নিয়ে আমরা – শুধু গল্পস্বল্প করতাম, আপনারা যেমন করছেন। সেই বন্ধুটি আমাদের ‘জর্জেন বে’র (Georgian Bay) একটি ছোট শহরে থাকাকালে একটি স্থানীয় মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার গল্প বলেছিলেন। একটা মধ্যবিত্ত ছেলের কিছু একটার মুখোমুখি হওয়া, যা আমাদের কাছে খুব পরিচিত, কিন্তু তাঁর কাছে নয়। ফলে তখনই আমি ওই মেয়েটি এবং তাঁর পরিবার-পরিস্থিতি গভীরভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলাম। আমার ধারণা, খুব তাড়াতাড়িই গল্পটি লিখে ফেলেছিলাম। কেননা, আমার মেয়েটা তখন ওর শয্যা থেকে তাকিয়ে আমাকে দেখছিল।

জ্য ম্যাকক্যলক : প্রথম বই যখন বের হয় তখন আপনার বয়স কত হবে? 

মুনরো : এই ছত্রিশের মতো। অনেক বছর ধরেই এই গল্পগুলো আমি লিখছিলাম এবং শেষমেশ রায়ারসন প্রেস, একটি কানাডীয় প্রকাশনা, যা কিনা তখন মাত্র ম্যাকগ্রহিল অধিগ্রহণ করেছে, এর সম্পাদক আমাকে লিখে জানালেন যে, একটা বইয়ের জন্য আমার যথেষ্ট গল্প আছে কিনা। আসলে তিনি একটি বইতে আরো দু-তিনজন লেখকের সঙ্গে আমার গল্প ছাপতে চেয়েছিলেন। সেটা হয়ে উঠল না, কিন্তু তখনো তাঁর কাছে আমার একগুচ্ছ গল্প ছিল। তারপর তিনি চাকরি ছেড়ে দিলেন, তবে আমাকে আরেক সম্পাদকের কাছে পাঠালেন, তিনি বললেন, আপনি যদি আরো তিনটি গল্প লিখতে পারতেন তাহলে আমাদের একটা বই হতো। অতএব বই প্রকাশের আগে আমি – লিখলাম ‘Images’, ‘Walker Brothers Cowboy’ এবং ‘Postcard’।

জ্য ম্যাকক্যলক : পত্রিকায় ওই গল্পগুলো কি ছাপা হয়েছিল?

মুনরো : অধিকাংশই ছাপা হয়েছিল Tamarack Review-তে। চমৎকার ছোট কাগজ এবং খুব নির্ভীক। সম্পাদক আমাকে বলেছিলেন, কানাডায় তিনিই হচ্ছেন একমাত্র সম্পাদক, যিনি তাঁর সমস্ত পাঠককে মূল নামে চেনেন।

জ্য ম্যাকক্যলক : লেখালেখির জন্য আপনার কি বিশেষ কোনো সময় ছিল?

মুনরো : বাচ্চারা যখন ছোট তখন আমার লেখার সময় ছিল – যেই না ওরা স্কুলের জন্য বেরিয়ে যেত। ফলে আমি ওই বছরগুলোতে অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করেছি। আমার স্বামী আর আমার একটা বইয়ের দোকান ছিল এবং যখন আমি সেখানে কাজ করি তখনো আমি দুপুর পর্যন্ত বাসায় থাকতাম – গৃহস্থালির কাজ করতাম, আবার লেখালেখির কাজও করতাম। পরে যখন আমি নিয়মিত দোকানে কাজ করতাম না, তখন লিখতাম – যতক্ষণ না ওরা দুপুরের খাবার খেতে আসে এবং তারপর আবার ওরা চলে গেলে, সম্ভবত আড়াইটা পর্যন্ত আমি ঝটপট এক কাপ কফি খেয়ে ঘর গোছানোর কাজ শুরু করে দিতাম। চেষ্টা করতাম বিকেল নামার আগেই যেন সবকিছু গোছগাছ হয়ে যায়। 

জ্য ম্যাকক্যলক : যখন মেয়েদের স্কুলের বয়স হয়নি তখন?

মুনরো : ওরা যখন তন্দ্রা যেত।জ্য ম্যাকক্যলক : যখন ওরা তন্দ্রা যেত তখন লিখতেন?

মুনরো : হ্যাঁ, দুপুরে একটা থেকে তিনটে পর্যন্ত। প্রচুর লিখতাম, খুব একটা ভালো হতো না, কিন্তু আমার মস্তিষ্ক ছিল পুরোপুরি উর্বর। যে-বছর আমি আমার দ্বিতীয় বই Lives of Girls and Women লিখলাম তখন আমি ছিলাম যথেষ্ট উর্বর। চারটে বাচ্চা ছিল আমার, কেননা মেয়েদের একটি বন্ধুও আমাদের সঙ্গে থাকত, এবং আমি সপ্তাহে দুদিন দোকানে কাজ করতাম। রাত একটা পর্যন্ত সম্ভবত লিখতাম, এবং তারপর আবার ছটায় উঠতাম। জানেন, আমার মনে পড়ে, আমি কি ভাবতাম, আমি হয়তো মারা যাব, আমার হার্ট অ্যাটাক হবে, কী যে ভয়ানক। তখন আমার বয়স ছিল কেবল উনচল্লিশ বা এরকম, কিন্তু আমি এসব ভাবতাম। পরে ভাবলাম, বেশ, যদি তা-ই হয়, আমার এখনো অনেক পাতা লেখার আছে, ওরা দেখতে তো পাবে এগুলো কেমন হলো। ব্যাপারটা ছিল একধরনের মরিয়া হয়ে ছোটা। এখন আর তেমন হিম্মত নেই।

জ্য ম্যাকক্যলক : Lives লেখার ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রক্রিয়া কাজ করেছে?

মুনরো : Lives লেখা শুরুর দিনটি মনে পড়ে। জানুয়ারিতে, দিনটা ছিল রোববার। আমি বইয়ের দোকানে গিয়ে, রোববারে খোলা থাকত না, ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আমার স্বামী বলেছিল, ও ডিনারে আসবে, তো আমার হাতে বিকেলটা ছিল। মনে পড়ে, আমি আমার চারপাশের মহৎ সাহিত্যকর্মগুলো দেখছিলাম আর ভাবছিলাম ‘ওই গর্দভ! এখানে তুই কী করছিস?’ আমি তখন ওপরে অফিসে গিয়ে ‘Princess Ida’ অধ্যায়টি লিখতে শুরু করলাম, যা ছিল আমার মাকে নিয়ে। আমার মা-বিষয়ক উপাদানগুলো হচ্ছে আমার জীবনের মূল উপাদান, আর এগুলো সবসময় অত্যন্ত তৈরি অবস্থায়ই আমার কাছে আসে। আমি যদি কেবল আরামও করি, তাহলেও ওটা আসবে। তো, একসময় যেই না আমি লেখা শুরু করলাম, আমি খেই হারিয়ে ফেললাম। তারপর করলাম বড় একটা ভুল। লেখাটাকে একটা মামুলি উপন্যাসে রূপ দিতে  চাইলাম, একটা সাদামাটা বালখিল্যগোছের উপন্যাস। মার্চের দিকে খেয়াল করলাম এটা কাজ করছে না। আমার কাছে যথাযথ মনে হলো না, অতএব ভাবলাম আমার এটা বাদ দিতে হবে। আমি খুব বিষণ্ণ হয়ে পড়লাম। পরে মনে হলো, আমার যা করতে হবে তা হলো, এটাকে কেটেছেঁটে গল্পের কাঠামোয় দাঁড় করানো। তখন আমি এটা সামলাতে পারলাম। সেই তখনই বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমি কখনো সত্যিকারের উপন্যাস লিখতে পারব না। কেননা আমি ওভাবে ভাবতে পারি না।

জ্য ম্যাকক্যলক : ‘The Beggar Maid’ তো হচ্ছে একরকমের উপন্যাস, কেননা গল্পগুলো তো আত্ম-সম্পর্কিত।

মুনরো : ভবিষ্যতে কী হবে তা নিয়ে খুব ভাবি না, তবে মাঝেমধ্যেই আরেকটি গল্প পরম্পরা তৈরি করতে ইচ্ছা হয়। আমার নতুন বই Open Secret-এ অনেক চরিত্র আছে, যেগুলো আবার ফিরে আসে। ‘Vandals’-এর ‘Bea Doud’-এর উল্লেখ আছে ‘Crried Away’-তে একটি বাচ্চা মেয়ে হিসেবে, সংকলনের জন্য প্রথম গল্প ছিল ওটি। ‘Billy Doud’ হলো গ্রন্থাগারিকের ছেলে, তারা সবাই ‘Spaceship Have Landed’-এ উপস্থিত। তবে এ-ধরনের পরিকল্পনা আমার গল্পকে গ্রাস করুক, তা হতে দিই না। একটা গল্প দাঁড় করতে গিয়ে আমি যদি দেখি যে, এটা আরেকটি গল্পের সঙ্গে মিল খেয়ে যাবে, তার অর্থ আমি সম্ভবত কিছু একটা ভুল করছি, এটার ওপর জোর খাটাচ্ছি, যা অনুচিত। অতএব, আমি জানি না ওরকম ধারাবাহিক গল্পের পরম্পরা আবার সৃষ্টি করতে পারব কিনা। যদিও ধারণাটা আমার ভালো লাগে। ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড তাঁর একটি চিঠিতে এমনটি বলেছিলেন যে, ‘ইস, আমার ইচ্ছে একটা উপন্যাস লিখি, আশা করি আমি কেবল এসব ছোটখাটো জিনিস রেখে মরে যাব না। নিজেকে এই ‘ছোটখাটো’র অনুভব থেকে মুক্তি দেওয়া অত্যন্ত কঠিন, যদি আপনি কেবল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গল্প রেখে মরে যান। আমি নিশ্চিত, আপনি ভাবছেন চেখভের কথা কিংবা অন্য কারো কথা ভাবছেন, তবে এখনো মুশকিল।’

জ্য ম্যাকক্যলক : চেখভ তো সবসময় একটা উপন্যাস লিখতে চাইতেন। তার শিরোনাম দিতে চেয়েছিলেন ‘Stories from the Lives of My Friends’।

মুনরো : জানি। সবকিছু একটার মধ্যে সন্নিবেশ ঘটিয়ে যে কাজ সম্পন্ন করা যায়, ওই অনুভূতিটাও আমার জানা আছে।

জ্য ম্যাকক্যলক : যখন আপনি কোনো গল্প আরম্ভ করেন, আপনার কি জানা থাকে গল্পটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে? গাঁথুনিটা কি আগেভাগেই ঠিক হয়ে যায়?

মুনরো : পুরোপুরি নয়। কোনো গল্পের ভালো গল্প হতে হলে সচরাচর পরিবর্তন থাকবেই। এখন আমি একটা গল্প লেখা শুরু করেছি, এবং সেটা আহামরি কিছু নয়। রোজ সকালে আমি গল্পটা নিয়ে কাজ করছি, এবং গল্পটা বেশ নাজুক। আমার আসলে ওটা ভালো লাগছে না, তবে আমার ধারণা হয়তো কোনো একপর্যায়ে আমি এটার ভেতরে ঢুকতে পারব। সচরাচর, কোনো গল্প লেখা শুরুর আগে এটার ব্যাপারে যথেষ্ট জানাশোনা থাকে, লেখার জন্য যখন আমার নিয়মিত সময় থাকে না, তখন গল্পগুলো আমার মাথায় অতটা সময় কাজ করতে থাকবে যে, যেই না আমি লেখা শুরু করব, এর গভীরে ডুবে যাব। এখন আমি সে-কাজটা করছি খেরোখাতা ভরে ফেলে।

জ্য ম্যাকক্যলক : আপনি খেরোখাতা ব্যবহার করেন?

মুনরো : আমার খেরোখাতার টাল হয়ে গেছে, যার ভেতরে আছে এই সাংঘাতিক হিবিজিবি লেখাজোখা, আসলে সবকিছু টুকে রাখা আর কী। যখন আমি এই প্রাথমিক খসড়াগুলোয় চোখ বুলাই তখন মাঝেমধ্যেই ভেবে অবাক হই এজন্য যে, এগুলো লেখার আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কিনা। জানেন, আমি সহজাত প্রতিভাবান লেখকদের ঠিক উলটো, যারা কিনা এগুলো অনায়াসেই ভেতরে নিতে পারে। কোনো গল্প আমি একদম তৈরি অবস্থায় মোটেও উপলব্ধি করি না, গল্পটা হচ্ছে তা-ই, যা আমি করতে চাচ্ছি। আমি হরদম বিপথে চলে যাই এবং নিজেকে আবার আগের পথে ফিরিয়ে আনতে হয়।

জ্য ম্যাকক্যলক : কীভাবে টের পান যে আপনি বিপথে চলে গেছেন?

মুনরো : একদিন লিখতে লিখতে আমি হয়তো ভাবলাম বেশ ভালোই তো করলাম, সচরাচর যা লিখি তার চেয়ে তো বেশি পৃষ্ঠা লিখে ফেলেছি। পরের দিন সকালে উঠে আমার মনে হলো এটার ওপর আর কাজ করার ইচ্ছা নেই। যখন সাংঘাতিক অনীহা এটার ধারেকাছে যেতে, যখন নিজেকে লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দেব, আমি সচরাচর বুঝি যে কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে। মাঝেমধ্যে কোনো লেখার চার ভাগের তিন ভাগ কাজ হয়ে গেলেই, কোনো একটা লক্ষ্যে কিছুটা আগেভাগেই  হয়তো পৌঁছলাম, তখন মনে হবে যে গল্পটা বাদ দিই। দু-একদিন আমার খুব মন খারাপ লাগে, গড়গড় করে বেড়াই, ভাবি অন্য কিছু লেখা যাক। ব্যাপারটা একরকম প্রেম-পরিণয়ের মতো আর কি; আপনি সবরকমের বিরক্তি এবং যাতনা থেকে মুক্তি পেতে কোনো নয়া মানুষের সঙ্গে বেরোতে চাইছেন, যাকে আপনার মোটেও পছন্দ নয়, কিন্তু সেটা এখনো আপনি খেয়াল করেননি। তখন হঠাৎ করে পরিত্যক্ত গল্পটা সম্পর্কে আমার ভেতরে একটা কিছু চলে আসবে; দেখতে পাব কীভাবে কাজটা করতে হবে। তবে ব্যাপারটা মনে হয় শুধু তখনই ঘটে যখন বলি, না, এটা কাজ করছে না, বাদ দেওয়া যাক।

জ্য ম্যাকক্যলক : ব্যাপারটা কি সবসময় করতে পারেন?

মুনরো : কখনো কখনো পারি না, এবং পুরো দিনটা খারাপ মেজাজে কাটাই। কেবল ওই সময়টাতেই আমি খিটখিটে হয়ে যাই, গ্যারি যদি আমার সঙ্গে কথা বলে কিংবা রুমের ভেতরে আসা-যাওয়া করে, অথবা যথেষ্ট শব্দ করে, আমার তখন রেগে যাওয়া বাকি। যদি গান গায় বা ওরকম কিছু করে, তাহলে তো কথাই নেই। আমি কিছু একটা ভেবে বের করার চেষ্টা করছি, আর গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছি পাথুরে দেয়ালে, বের হতে পারছি না। সাধারণত বাদ দেওয়ার আগে কিছুকালের জন্য আমি এটা করি। এই পুরো প্রক্রিয়াটায় সপ্তাহখানেক লেগে যায় – এটা নিয়ে ভাবা, ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করা, তারপর হাল ছেড়ে দেওয়া এবং অন্য কিছু নিয়ে ভাবার সময়, এবং একদম অপ্রত্যাশিতভাবে ফিরে পাওয়া – এই যখন আমি মুদিখানায়, কিংবা গাড়ি চালাতে বাইরে বেরিয়েছি। তখন ভেবে নিই, বেশ তো, আমি এই এই দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখব, এই চরিত্র ছেঁটে ফেলব, এবং এ-মানুষগুলো অবিবাহিত, কিংবা যা-ই হোক না কেন। ব্যাপক রদবদল ঘটে, যা সচরাচর আসলে মৌলিক রদবদল।

জ্য ম্যাকক্যলক : এতে কি গল্পটা ঠিকঠাক হতো?

মুনরো : এতে গল্পের মানোন্নয়ন ঘটল কিনা এমনকি তাও জানি না। তবে যা হয় তা হলো, আমার লেখালেখি সচল রাখা সম্ভব হয়। তার অর্থ এই বলছি না যে, আমার পর্যাপ্ত জিনিস আছে যা বেরিয়ে এসেছে এবং আমাকে পথের দিশা দিচ্ছে। মনে হয় আমি শুধু একটা চেতনা লাভ করি যে, যে-লেখাটা নিয়ে খুব জটিলতায় পড়েছি সেটায় কী লিখতে চাই। এবং এটা কদাচিৎ ঘটে।

জ্য ম্যাকক্যলক : আপনি কি সচরাচর গল্পের পরিপ্রেক্ষিত কিংবা ধরনটা বদলান?

মুনরো : ও হ্যাঁ, কখনো কখনো আমি বুঝে উঠতে পারি না। আমি ফার্স্ট পারসন থেকে থার্ড পারসনে বারবার চলে যাই। আমার অন্যতম সমস্যাগুলোর ভেতরে এটা একটা। আমি মাঝেমধ্যে ফার্স্ট পারসনে বর্ণনা দিই নিজেকে গল্পের ভেতরে প্রবেশ করানোর জন্য। এবং তারপর মনে হয় কোনো কারণে এটা কাজ করছে না। ও ব্যাপারটায় কিছু করতে বললে আমি একেবারে ক্ষেপে যাই। আমার প্রতিনিধির ‘The Albanian Virgin’ গল্পটি ফার্স্ট পারসনে বর্ণনা ভালো লাগেনি, তিনি আমাকে দিয়ে এটা বদলালেন, হয়তো আমি সঠিকভাবে নিশ্চিত ছিলাম না বলেই। কিন্তু পরে আমি আবার আগের সেই ফার্স্ট পারসনেই ফিরে এসেছি।

জ্য ম্যাকক্যলক : কতটা সচেতনতার সঙ্গে আপনি যা করছেন, থিমের স্তরটায়, তা বুঝতে পারেন?

মুনরো : উম, খুব একটা সচেতনভাবে নয়। একটা গল্পের বিচ্যুতির রাস্তাগুলো আমি দেখতে পাই। ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক জিনিসগুলো খুব সহজেই দেখি। কিছু কিছু গল্প অন্যগুলোর মতো কাজ করে না। আবার কিছু কিছু গল্প থিমের দিক থেকে অন্যগুলোর চেয়ে ঠুনকো।

জ্য ম্যাকক্যলক : ঠুনকো?

মুনরো : সেগুলো আমার কাছে ঠুনকো মনে হয়। ওগুলোর প্রতি যে খুব একটা নিষ্ঠা ছিল, তা মনে করি না। মুরিয়েল স্পার্কের আত্মজীবনী পড়ছিলাম। তাঁর ধারণা, যেহেতু তিনি খ্রিষ্টান, ক্যাথলিক, ঈশ্বরই হচ্ছেন আসল লেখক। এবং এটা আমাদের সেই মাতববরিটা নিজের হাতে নেওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত রাখে, বিরত রাখে জীবনের মর্মকথা নিয়ে কল্পকাহিনি লিখতে; যে-কাহিনি অনুধাবনের চেষ্টা করে একমাত্র ঈশ্বর যা উপলব্ধি করে। তাই তো কেউ কেউ চিত্তবিনোদন নিয়ে লেখে। মনে হয় তিনি এটাই বলেছেন। আমার ধারণা, আমিও কখনো কখনো গল্প লিখি বিনোদনের লক্ষ্যেই।

জ্য ম্যাকক্যলক : একটা উদাহরণ দিতে পারবেন?

মুনরো : উম, মনে হয় ‘The Jack Randa Hotel’ আমার খুব পছন্দ, বিনোদনের কাজটাই করে। আমি অবশ্য তাই-ই চাই। যদিও ‘Friend of My Youth’ গল্পটি বিনোদন জোগায় না, কিছুটা অন্যভাবে কাজ করে, কাজ করে আমার অন্তস্তল থেকে।

জ্য ম্যাকক্যলক : যে-কাজগুলো আপনি বিনোদন বিবেচনা করেন সেগুলো নিয়ে কি আপনি উদ্বিগ্ন থাকেন, যতটা থাকেন আপনার কেন্দ্রীয় উপাদানগুলো নিয়ে?

মুনরো : হ্যাঁ, তা তো বটেই।

জ্য ম্যাকক্যলক : এমন কোনো গল্প কি আছে, যা লিখতে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি?

মুনরো : ‘Friends of My Youth’ আসলে খুব দ্রম্নত লিখেছিলাম। একটা ছোট্ট ঘটনা থেকে। আমি এক যুবককে চিনি, যে গদেরিচ লাইব্রেরিতে কাজ করে এবং আমার জন্য তথ্য-উপাত্ত ঘাঁটাঘাঁটি করে। এক রাতে ও আমাদের বাড়িতে ছিল এবং ওদের বাড়ির পড়শিদের ব্যাপারে বলতে শুরু করল, ওদের পাশের খামারবাড়িতে যে পড়শিরা থাকত। তারা নাকি এমন ধর্মাবলম্বী যে তাদের তাস খেলা বারণ ছিল, তাই তারা খেলত ক্রোকিনলে, এক ধরনের বোর্ড গেম। ও শুধু আমাকে এটুকুই বলেছিল, তারপর আমি ওকে সেই পড়শিদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম; পরিবার, ধর্ম, তারা দেখতে

22

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়