Cvoice24.com


খুনের ১ বছর/ করোনার ফাঁদে আটকা অমিত মুহুরী হত্যা মামলার চার্জশীট

প্রকাশিত: ১২:৫১, ২৯ মে ২০২০
খুনের ১ বছর/ করোনার ফাঁদে আটকা অমিত মুহুরী হত্যা মামলার চার্জশীট

কারাগারের ভেতর খুন হওয়া দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী  অমিত মুহুরী হত্যা মামলার এক বছর পূর্ণ হলেও হত্যা রহস্য থমকে আছে কারবন্দি রিপন নাথেই। তদন্ত সংস্থা নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলাটির এক বছর তদন্ত করেও জমা দিতে পারেনি চার্জশীট। আর খুনের সাথে কারাবন্দি রিপনই একমাত্র সম্পৃক্ত বললেও নেপথ্যে আর কোনও শক্তি জড়িত কিনা সেটাও নিশ্চিত করে বলতে পারছে না ডিবি। 

তবে অমিতের পরিবারের দাবি, এটি পরকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তারা নেপথ্য রহস্য বের করার দাবি জানিয়ে আসছে শুরু থেকেই। অন্যদিকে তদন্ত সংস্থা বলছে, কারাগারে রিপন নাথ একাই খুন করেছেন অমিত মুহুরীকে। তদন্ত শেষ পর্যায়ে হলে বাকি শুধু পেপার ওয়ার্ক। করোনাকালে আটকে আছে চার্জশীট। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দেওয়া হবে চার্জশীট। 

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ২৯ মে রাতে অমিত মুহুরীকে কারাগারের ভেতর ইট দিয়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করেন সেলের অপর বন্দি রুমমেট রিপন নাথ। পরে জেল কর্তৃপক্ষ তাকে চমেক হাসপাতালে নিলে ২৯ মে দিবাগত রাত ১টা ৪৫ মিনিটে চিকিৎসকরা অমিত মুহুরীকে মৃত ঘোষণা করেন। এঘটনায় চট্টগ্রাম কারাগারের তৎকালীন জেলার নাশির আহমেদ বাদি হয়ে কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। পরে মামলাটির তদন্তভার পান ডিবির (দক্ষিণ) পরিদর্শক আজিজ আহমেদ। আর এই মামলার সুপার ভিশনের দায়িত্বে ছিলেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি (দক্ষিণ) আসিফ মহিউদ্দীন।

জানতে চাইলে আসিফ মহিউদ্দীন সিভয়েসকে বলেন, ‘রাগের মাথায় রুমমেট রিপন নাথই ইটের আঘাতে অমিত মুহুরীকে খুন করেছে। সেটা তদন্তে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এখানে অন্য কোনও রহস্য বা নেপথ্য কাহিনী পায়নি। এছাড়া কারাগারে ইট নেওয়া, সিসিটিভির ফুটেজ গায়েবসহ নানা অসঙ্গতির উত্তর আমরা খুঁজেছি। সব প্রশ্নের উত্তর চার্জশীটে থাকবে। চার্জশীট কখন দেওয়া হবে সেটা নির্ভর করছে তদন্ত কর্মকর্তার ওপর।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক আজিজ আহমেদ সিভয়েসকে বলেন, ‘তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। চার্জশীটের খসড়াও প্রস্তুত। এখন করোনাকালে আটকে গেছে সব প্রক্রিয়া। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এ মামলার চার্জশীট দেওয়া হবে।’

যা ঘটেছিল ২০১৯ মে 

ওই দিন কারাগারের ১ নম্বর সেল থেকে ৬ নম্বর সেলে যেখানে আগে থাকতেন অমিত। সেই সেলে রিপনকে পাঠায় কারা কর্তৃপক্ষ। তবে প্রথম দেখাতেই রিপনকে দেখে অমিত আপত্তি জানান। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ তাদের সেলে রিপনকে দেওয়ায় অমিতের কিছুই করার ছিল না। এরপর ইফতার সেরে ও রাত ৮টার দিকে খাওয়া-দাওয়া সেরে অমিত ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পর দিন ৩০ মে আদালতে হাজিরা ছিল অমিতের। সেজন্য ওই দিন একটু আগেই ঘুমাতে যাচ্ছিলেন অমিত।

এসময় আরেক রুমমেট বেলালকে অমিত বলেছিলেন তার শরীরটা একটু টিপে দিতে। বেলাল যথারীতি অমিতের শরীরটা টিপে দেন। পরে তারা পাশাপাশি শুয়ে পড়েন। এসময় বেলালের ওপাশে নতুন বন্দি রিপনও শুয়ে পড়েন। বেলাল মাঝখানে, আর রিপন ও অমিত বেলালের দুপাশে ঘুমিয়ে পড়েন। 

রাত দশটার দিকে বেলাল ও অমিত যখন ঘুমন্ত অবস্থায়, ঠিক তখনই অতর্কিতভাবে অমিত মুহুরীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রিপন নাথ। সেখানে আগে থেকে থাকা তিন কোণাকৃতির ইট দিয়ে অমিতের মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকেন রিপন। বিষয়টি টের পেয়ে বেলাল উঠে রিপনকে জড়িয়ে ধরে নিবৃত্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু রিপনের শক্তির কাছে বেলালও তখন অসহায়। ঘুমন্ত অবস্থায় উপর্যুপরি ইটের আঘাতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে অমিতও। বেলালের চিৎকারে ওয়ার্ডে দায়িত্বরত দুজন কারারক্ষী দৌড়ে এসে সেলে প্রবেশ করেন। এ সময়ও রিপন অমিতের মাথায় ক্রমাগত আঘাত করেই চলছিলেন। কারারক্ষীদের বাধাও তিনি মানছিলেন না। এ সময় মাথার পর অমিতের মুখেও আঘাত করতে থাকেন রিপন। পরে তাকে লাঠিপেটা করে জোর করে সেল থেকে বের করা হয়। এসময় ধস্তাধস্তিতে রিপনের লুঙ্গি খুলে যাওয়ায় তাকে উলঙ্গ অবস্থাতেই বের করা হয়।

অমিতকে ৬ নম্বর সেল থেকে উদ্ধার করে প্রথমে কারা মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া হয়। সেখান থেকে প্রাথমিকভাবে কারাগারে চিকিৎসা দিয়ে গোপনে অমিতকে সুস্থ করার চেষ্টা চালান কারা হাসপাতালের চিকিৎসকরা। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে কারা হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) নেওয়ার পরামর্শ দেন। কারাগার থেকে অমিতকে রাত ১১টায় বের করা হয়। রাত ১১টা ২০ মিনিটে অমিত মুহুরীকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হলে নিউরোসার্জারি বিভাগের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। পরে চিকিৎসকরা ২৯ মে দিবাগত রাত ১টা ৪৫ মিনিটে অমিত মুহুরীকে মৃত ঘোষণা করেন। মেডিকেলে নেওয়ার আগেই কারাগারে অমিতের মাথায় ২৬টি সেলাই দেওয়া হয়।

পরিবারের দাবি চুক্তিতে খুন

যদিও খুনের দিন থেকে অমিতের পরিবার থেকে দাবি করা হচ্ছে, রিপন নাথ অমিতকে হত্যা করেছেন চুক্তি ভিত্তিতে। এ জন্য অমিতের রাজনৈতিক বলয়ের সহকর্মীদের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলছেন। তাদের দাবি, এ খুনের জন্য কোটি টাকার বিনিময় হয়েছে। শুধু রিপন নয় জেলের অনেকেও জড়িত এ হত্যাকাণ্ডে। যদিও তদন্ত সংস্থা বলছে, রিপন নাথই অমিতকে রাগের মাথায় খুন করেছেন। সেখানে অন্য কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। 

এরআগে গেল বছর জুন মাসে আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতেও একই দাবি করেছেন রিপন নাথ। ২০১৯ সালের ১১ জুন চট্টগ্রাম অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মহিউদ্দিন মুরাদের আদালতের খাস খামরায় রিপন এ স্বীকারোক্তি দেন। দুই পৃষ্ঠার লিখিত স্বীকারোক্তিতে অমিতের ওপর রাগের মাথায় নিজ হাতে ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে খুন করেছেন বলে স্বীকার করেন তিনি।

তদন্তকারী কর্মকর্তার জিজ্ঞাসাবাদেও রিপন নাথ দাবি করেছিলেন, ৬ নম্বর সেলে ঘুমের স্থান পরিবর্তন করতে অমিতের চাপ, অপমান ও গালিগালাজ করায় প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে রাগের মাথায় অমিতকে ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে খুন করেছেন। তবে নিজের খুনের বাইরেও কারাগারের অনেক অনিয়ম ও অমিতের নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন রিপন।

কে এই রিপন নাথ?

রিপন নাথ সীতাকুণ্ড উপজেলার ফেদানগর এলাকার হেমন্ত সরকার বাড়ির মৃত নারায়ণ চন্দ্র নাথের ছেলে। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় নগরীর পাহাড়তলীর অর্গানিক জিন্স নামে একটি পোশাক কারখানায় কাগজে মোড়ানো একটি ছুরি নিয়ে কারখানায় ঢুকে পড়েন এ রিপন নাথ। কারখানার নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে বাধা দিলে এক নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে তার ধস্তাধস্তিও হয়। পরে তিনি কারখানার কনফারেন্স রুমে ঢুকে যান। তখন রুমে পোশাক ক্রেতাদের সঙ্গে কারখানার কর্মকর্তাদের সভা চলছিল। এ অবস্থায় রিপন রুমে ঢুকে তার হাতে থাকা ছুরি নিয়ে সবাইকে জিম্মি করে ফেলেন।

জিম্মি ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের আলোচিত সন্ত্রাসী অমিত মুহুরীর খুনি রিপন নাথ। পেশায় পোশাক কারখানার কর্মী রিপন চট্টগ্রামের অপরাধজগতে আলোচিত কেউ ছিলেন না। বর্তমানে চট্টগ্রাম কারাগারে ৩২ নম্বর সেলে থাকা রিপন নাথের বন্দি নম্বর ৭১৩২/১৯। অস্ত্র আইনের ১৯ (এফ) ধারা এবং ৩৬ (১) ১০ ধারায় রিপন নাথের বিরুদ্ধে দুটি মামলার খোঁজ মিলেছে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানায়। এর একটির নম্বর ১৯ (৪) ১৯ এবং অন্যটি ২০ (৪) ১৯। এছাড়া তার বিরুদ্ধে অমিত হত্যা মামলার চার্জও যুক্ত হয়েছে।

-সিভয়েস/এমএম

সিভয়েস প্রতিবেদক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়