Cvoice24.com


আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি

প্রকাশিত: ১৮:০২, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০
আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’ আজ ২১ শে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবস। জাতির বীর সন্তানদের মনে প্রাণে স্মরণ করার দিন। ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে এবং তাদেরকে স্মরণ করতেই পালন করা হয় অমর ২১ শে ফেব্রুয়ারির এ দিনটি। এই দিন রাষ্ট্রভাষার জবাবদিহিতা চাওয়ার সক্ষমতার দিন। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে পরিচিত করে তুলেছে জাতির বীর সন্তানেরা।

বীর সন্তানদের তাজাপ্রাণের বিনিময়ে এ বিশ্ব পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পিচঢালা রাজপথে তাজাপ্রাণ নিয়ে নেমেছিল রাষ্ট্রভাষার অধিকারের কথা জানাতে। অধিকার আদায়ের যুদ্ধে ঘাতকের গুলিতে ঝরে পড়েছিল হাজারো তাজাপ্রাণ। ‘আমাদের চেতনার সৈকতে মাথা কুটলো একুশের ঢেউ, শহীদের তাজাপ্রাণের বিনিময়ে কয়ফোঁটা জল চোখে জুটলো’- কিন্তু বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদের তাজাপ্রাণের বিনিময়ে শত-শোকের মাঝেই আমরা ফিরে পেয়েছি ভাষার অধিকার। 

ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম: ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকার পরে চট্টগ্রামের অবস্থান। ভাষা আন্দোলন গ্রামাঞ্চলে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত সংগ্রাম তুঙ্গপর্বে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক আন্দোলন দেশব্যাপী লেখক-বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের ব্যাপক অনুপ্রেরণা দেয়। চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক ও শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন এবং প্রতিবাদ প্রবল হয়ে ওঠে পাকিস্তানের শাসক-শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। 

আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ: চট্টগ্রামের আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের ভাষণে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার চিন্তা ও জাতির সাংস্কৃতিক আধারকে বেগবান করে তোলে। তিনি ওই ভাষণে বলেন, ‘মানুষে মানুষে বিভেদ আছে সত্য। এই বিভেদকে জয় করাই শক্তি। সংস্কৃতি ঐক্যের বাহন, বিভেদের চামুণ্ডা নয়।’ 

তমদ্দুন মজলিস সংগঠনের আন্দোলন: ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন চট্টগ্রামে তেমন সাংগঠনিক রূপ না পেলেও সক্রিয় প্রতিবাদে মুখর ছিল। তমদ্দুন মজলিসের চট্টগ্রাম শাখাই এ সময় ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। তমদ্দুন মজলিসের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সোলায়মান খান, এজাহারুল হক, সাদেক নবী, মঈনুল আহসান সিদ্দিকী (মন্টু), চৌধুরী শাহাবুদ্দীন আহমদ খালেদ, মাহফুজুল হক, মো. ইব্রাহীম, শাহ ওবায়দুর রহমান, মকসুদুর রহমান প্রমুখ এ আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।

চট্টগ্রামে তখন তমদ্দুন মজলিসের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। মোমিন রোডে অবস্থিত তমদ্দুন মজলিসের অফিসে সে সময় প্রায়ই সভা হতো। এমএ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী বিরোধীদলীয় যে কোন আন্দোলনে খুবই সক্রিয় ছিলেন। তমদ্দুন মজলিসের সাথে আদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সহযোগিতার হাত প্রসারের ক্ষেত্রে দ্বিধা করতেন না। 

নেতৃস্থানীয়দের ভূমিকা: চট্টগ্রামে ১৯৪৭-৪৮ সালেই তমদ্দুন মজলিসের শাখা গঠিত হয় চট্টগ্রাম ডিগ্রি কলেজের ছাত্র সোলায়মান খানের উদ্যোগে। সোলায়মান খান ছাড়াও চট্টগ্রাম তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক চৌধুরী শাহাবুদ্দীন খালেদ, ড. মাহফুজুল হক, ইব্রাহীম চৌধুরী, অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সোলায়মান প্রমুখ ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামে তমদ্দুন মজলিসের আজিজুর রহমানের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা ছিল। 

সংগ্রাম পরিষদ গঠন: মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পর ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমউদ্দিন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’-এ ঘোষণা দিলে সারা পূর্ব বাংলায় বিক্ষোভ শুরু হয়। চট্টগ্রামে ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও হরতাল পালিত হয়। আন্দরকিল্লায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তরুণ সাহিত্যিক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীকে আহ্বায়ক, আওয়ামী মুসলিম লিগ চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ ও রেল শ্রমিক নেতা চৌধুরী হারুনর রশিদকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়।

কমিটিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ক্লাব, যুব সম্প্রদায়, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শ্রমজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা অন্তর্ভুক্ত হন। সভায় বাংলা, ইংরেজি ও উর্দুতে পোস্টার লেখার সিদ্ধান্ত হয়। বিভিন্ন দোকানপাট থেকে দু আনা-এক আনা করে চাঁদা তুলে খরচ নির্বাহ করা হত। আওয়ামী লীগ অফিস থেকে প্রথমে প্রচার কাজে নামেন ওবায়দুল হক (বিশিষ্ট সাংবাদিক) ও চকবাজারের সালেহ আহমদ। 

জনসভার কর্মসূচি ও হরতাল পালন: কর্মসূচি অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি দেশের অন্যান্য জেলার মতো সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে চট্টগ্রামে হরতাল-মিটিং-মিছিল এবং লালদীঘি মাঠে জনসভার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।

১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি রাতদিন পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে পোস্টার লাগানো হয়। পাড়ায় পাড়ায় অবস্থিত ক্লাব ও সংগঠনগুলো হরতাল সফল করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। কর্মসূচি অনুযায়ী বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ও আরবি হরফে বাংলা প্রবর্তনের প্রচেষ্টার প্রতিবাদে ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সমস্ত দোকানপাট, যানবাহন, সরকারি অফিস-আদালত ও স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। ২১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে পূর্ণ দিবসে হরতাল পালিত হয়। 

আন্দোলনে ছাত্র-ছাত্রীদের ভূমিকা: চট্টগ্রামে ছাত্র-ছাত্রীদের ভূমিকাও ছিলো উল্লেখযোগ্য, ৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। আবদুল্লাহ আল হারুনকে আহ্বায়ক, মোহাম্মদ আলী (চবি প্রাক্তন ভিসি) ও ফরিদ উদ্দিন আহমদ (সাংবাদিক, কায়রো বিমান দুর্ঘটনায় নিহত) কে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। চট্টগ্রামের ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। 

বাঙলা ভাষা যেভাবে পেল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি: বাংলাদেশের জনগণের গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবেও সুপরিচিত। বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮) বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন তরুণ শহীদ হন। তাই এ দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

২০১০ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।

২০১০ সালের ২১ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে জাতিসংঘ। এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে উত্থাপন করে বাংলাদেশ। ১১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের তথ্যবিষয়ক কমিটিতে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।

 

সিভয়েস প্রতিবেদক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়