Cvoice24.com

ফিরে দেখা ২০১৯!
ফ্লাইওভার ছাড়া সিডিএ’র কোনো উন্নয়নই দৃশ্যমান নয়

প্রকাশিত: ১০:০৩, ১ জানুয়ারি ২০২০
ফ্লাইওভার ছাড়া সিডিএ’র কোনো উন্নয়নই দৃশ্যমান নয়

ছবি : সিভয়েস

যানজট, জলাবদ্ধতা, অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণের ফলে দিন দিন ম্লান হচ্ছে চট্টগ্রাম নগরীর অতীত উজ্জ্বলতা। এতে একদিকে বাড়ছে জনদুর্ভোগ, অন্যদিকে কাঙ্ক্ষিত গতি আসছে না ব্যবসা-বাণিজ্যে।

বন্দরনগরীর উন্নয়নে অনেক কিছু করার পরিকল্পনা থাকলেও ফ্লাইওভারগুলো ছাড়া কোনো উন্নয়নই দৃশ্যমান নয়। ১০ বছরে চট্টগ্রামের অবকাঠামো উন্নয়নে যানজট নিরসনের সমাধান হিসেবে একের পর এক ফ্লাইওভার নির্মাণের মাধ্যমে চট্টগ্রামের দৃশ্যমান অবকাঠামো উন্নয়ন করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। তবে এসব ফ্লাইওভারেও সঠিক পরিকল্পনার অভাব রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত। ভারী বৃষ্টি হলেই ফ্লাইওভারে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা।

চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ নামে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ২০১৭ সালের ৯ অগাস্ট একনেকের অনুমোদন পায়। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) উদ্যোগে নেওয়া এ প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার, গণপূর্ত ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

ওই প্রকল্পের আওতায় খালের মাটি খনন, কাদা অপসারণ, নালা সংস্কার ও নির্মাণসহ বৈদ্যুতিক বাতি স্থাপনের মত কাজ কারার দায়ভার আসে সিডিএ’র ঘাড়ে। এই প্রকল্প অনুমোদনের পর নগরীর দখল হওয়া খাল উদ্ধারে সিটি করপোরেশনের শুরু করা উচ্ছেদ অভিযানে ভাটা পড়ে।

বড় ও ছোট ৫৮টি খাল রয়েছে নগরীতে। খালগুলোর অস্তিত্ব পুনরুদ্ধার, এগুলো থেকে মাটি উত্তোলন, খালের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধিসহ খালের উভয় পাশে রাস্তা নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা, যা সিডিএ’র মেগা প্রকল্পে কিছুটা অন্তরভুক্ত আছে। নতুন জলাশয় তৈরি ও জলাধার সৃষ্টির তাগিদ দিয়েছেন তারা।

জলাবদ্ধতা দূর করতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার যে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তাতে জলাবদ্ধতা নিরসন করা কতটুকু সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম ফোরামের সদস্য ও সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের চেয়ারম্যান নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী আলী আশরাফ।

বন্দর নগরীকে বদলে দিতে ১৫ হাজার কোটি টাকার ‘পরিকল্পিত উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ’ নিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। নগরকে বদলে দেয়ার উদ্যেশ্যে ৯টি বড় প্রকল্প মাধ্যমে ২০২৩ সালের মধ্যে বাস্তবায়নে কাজ করেছে সিডিএ।

এসব প্রকল্পের মধ্যে অনন্যা আবাসিক এলাকার উন্নয়ন (২য় পর্যায়), নতুন সড়ক নির্মাণ, সড়ক সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন, বেডিবাঁধ ও মার্কেট নির্মাণ অন্যতম। প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম নগরী সবক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে এমনটাই দাবি সিডিএর।

প্রকল্পগুলোর বিষয়ে সিডিএ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ১ হাজার ৩৬৮ টাকা ব্যয়ে চিটাগাং আউটার রিং রোড (২য় পর্যায়) প্রকল্পের ডিপিপি তৈরির কাজ চলছে। এ প্রকল্পের আওতায় ফিডার রোড-০২ (রিং রোড হতে বড়পোল পর্যন্ত) চিটাগাং সিটি আউটার রিং রোডের সাথে সিইপিজেডের ৪ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৮০ ফুট প্রস্থ সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হবে। এছাড়া নেভাল ওয়েস্ট পয়েন্টে ঢেউ প্রতিরোধক দেয়ালসহ বাঁধ নির্মাণের সংস্থান রয়েছে বলে জানা গেছে। এ প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।

দক্ষিণ কাট্টলী থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত আউটার রিং রোড নির্মাণে ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের ডিপিপি তৈরির কাজ করছে সিডিএর সংশ্লিষ্ট শাখা। একই সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের টার্গেট নেয়া এ প্রকল্পের আওতায় ৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ কাম সড়ক ও ফিডার রোড নির্মাণের সংস্থান রয়েছে।

৭৪৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকার আগ্রাবাদ এঙেস সড়ক থেকে বায়েজীদ বোস্তামি সংযোগ সড়ক পর্যন্ত গৃহীত এ প্রকল্পের ডিপিপি ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। নর্থ সাউথ-১ সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ২ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৮০ ফুট প্রশস্ত এ প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।

শাহ আমানত ব্রিজ কানেক্টিং রোড থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পর্যন্ত নর্থ সাউথ-২ রোডের উন্নয়নে ১ হাজার ৩৬১ কোটি ২৪ লাখ টাকার প্রকল্প ফিজিবিলিটি স্টাডি পর্যায়ে রয়েছে। ৪ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৮০ ফুট প্রশস্ত এ সড়ক উন্নয়নে বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০১৯ সালের জুলাই হতে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত।

ফিরিঙ্গিবাজার মোড় থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ১০৩ কোটি টাকা প্রকল্প বাস্তবায়নে ডিপিপি তৈরির কাজ চলছে বলে সিডিএ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে। কাজী নজরুল ইসলাম সড়কের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে গৃহীত এ প্রকল্পে ৬২৬ মিটার দীর্ঘ ও ৬০ ফুট প্রশস্ত সড়কের সংস্কার ও উন্নয়ন হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সময় ধরা হয়েছে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।

বহদ্দারহাট থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পর্যন্ত সড়কের (চাঁন্দমিয়া সওদাগর রোড সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন) জন্য গৃহীত ৩৪১ কোটি টাকার প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধন করে দ্রুত মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের দৌঁড়ে আছে সিডিএ। উল্লেখিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটিও বাস্তবায়ন করার টার্গেট ধরা হয়েছে। ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৪০ ফুট প্রশস্ত এ সড়ক।

এদিকে, ২ হাজার ৫৬৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ডেভেলপমেন্ট অব ফতেয়াবাদ নিউটাউন ইন চট্টগ্রাম প্রকল্প বাস্তবায়নে ডিপিপি তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। ৩৫৪ একর জমির উপর আবাসন গড়ে তোলার এ প্রকল্পে ৫ লাখ লোকের আবাসনের ব্যবস্থা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে।

আগ্রাবাদ এলাকায় কন্সট্রাকশন অফ সিডিএ কর্ণফুলী কমপ্লেক্স প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ৪০১ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পে রয়েছে সিডিএর নিজস্ব ৩ দশমিক ২১ একর জমিতে ৪তলা বিশিষ্ট মার্কেট ব্লক, ২০ তলার অফিস টাওয়ার ব্লক, ২৪০টি এপার্টমেন্টের ব্যবস্থা রেখে ১৭ তলার আবাসিক ব্লক ও ৬ তলা বিশিষ্ট একটি কমিউনিটি ব্লকসহ মাল্টিকমপ্লেঙ নির্মাণ।

অনন্যা আবাসিক এলাকার উন্নয়নে (২য় পর্যায়) ২ হাজার ৮৩২ কোটি ৯৭ লাখ টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যাচাই বাছাই চলছে। এ প্রকল্পে ২ হাজার ৮২৫টি আবাসিক প্লট ও ১১০ টি বাণিজ্যিক প্লট নির্মাণে করার কথা বলছে সিডিএ কর্তৃপক্ষ। ৪১৮ দশমিক ৭৩ একর জমিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানা গেছে। সবমিলে ৯ প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ১৪ হাজার ৮৮৭ কোটি ১৬ লাখ টাকার হাতে নিলেও মেগা প্রকল্প ঘিরে সিডিএ এবং সিটি করপোরেশনের কাজে সমন্বয়হীনতা নিয়ে অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি চট্টগ্রাম বন্দর। বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে বহুল ব্যবহৃত সড়কটি (বারিক বিল্ডিং থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত) এখনো দুই লেইনে চলছে। ফলে বন্দরে প্রবেশ ও বের হওয়া যানবাহনগুলোই চট্টগ্রাম শহরের যানজট ও দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিদিন প্রায় ছয় হাজার ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লরি প্রবেশ করে চট্টগ্রাম বন্দরে। এছাড়াও চট্টগ্রামসহ সারাদেশের পণ্য পরিবহনে আরো কয়েক হাজার ভারী যানবাহন চলাচল করে চট্টগ্রাম নগরী দিয়ে। কিন্তু এসব যানবাহন রাখার জন্য নামমাত্র দুটি টার্মিনাল রয়েছে। বন্দরের মালিকানাধীন এসব টার্মিনালে মাত্র ৫৫০ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান রাখা সম্ভব। বাকি যানবাহনগুলো চট্টগ্রামের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের দুই পাশেই রেখে দেয়া হয়। একাধিকবার চট্টগ্রামে বৃহৎ কয়েকটি ট্রাক টার্মিনাল স্থাপনের প্রস্তাব এলেও একটিও আলোর মুখ দেখেনি। ফলে সড়কের দুই ধারে ট্রাক রাখার ফলে সম্প্রসারণকৃত সড়কও অপ্রশস্ত হয়ে পড়ছে।

নিয়ম অনুযায়ী সরকার সিডিএ’র মাধ্যমে সরাসরি উন্নয়ন কাজ করে। কোনও প্রকল্প করার পর স্থানীয় সরকার বিভাগের সংস্থা সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদকে হস্তান্তর করার নিয়ম রয়েছে। তবে ৪টি ফ্লাইওভার নির্মাণের ২-৩ বছর হয়ে পর যাওয়ার গত বছরের ১লা  ডিসেম্বর নাটকীয়ভাবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে হস্তান্তর করার প্রয়োজন বোধ করে সিডিএ।
কিন্তু গত তিন বছর ধরে আইন লঙঘন করে চট্টগ্রাম নগরীর চারটি ফ্লাইওভার কব্জায় রেখেছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ)। ফ্লাইওভারগুলো হচ্ছে মুরাদপুর আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার, বহদ্দারহাট এমএ মান্নান ফ্লাইওভার, কদমতলী ও দেওয়ানহাট ফ্লাইওভার।

সিডিএ’র ভাষ্য অনুযায়ী, ফ্লাইওভার নির্মাণ করলেও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ও লোকবল না থাকায় এসব ফ্লাইওভার আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চসিককে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যায়, পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ও লোকবল অভাব যদি থেকেই থাকে তাহলে এতো বছর কেন এই ফ্লাইওভারগুলো নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল সিডিএ।

-সিভয়েস/এসসি

জোবায়েদ ইবনে শাহাদত

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়