ইটভাটার প্রভাবে পরিবেশ-প্রকৃতি চরম হুমকির মুখে!
ছবি: সিভয়েস
সাতকানিয়ায় বিভিন্ন ইউনিয়নের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বনাঞ্চল ও চাষাবাদের জমিতে ৬১টি ইটভাটার প্রভাবে পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র চরম হুমকির মুখে পড়েছে। স্থানীয় প্রশাসনকে তোয়াক্কা না করে এসব ভাটায় কৃষিজমি, পাহাড়ের মাটি ব্যবহার ও বনের কাঠ পোড়ানোর কারণে পরিবেশ চরম হুমকির মুখে পড়ছে। এতকিছুর পরও রহস্যজনক কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর নীরব ভূমিকা পালন করছে।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, সাতকানিয়া-বাঁশখালী সীমান্তের এওচিয়া ইউনিয়নের চুড়ামণি এলাকায় গড়ে উঠা ১৩টি ইটভাটাগুলোর চারদিকে রয়েছে সবুজ পাহাড়। আর এসব পাহাড়ে রয়েছে সরকারি-বেসরকারীভাবে সৃজিত বিভিন্ন মূল্যবান প্রজাতির বাগান। অন্যদিকে ইটভাটাগুলো স্থাপন করা হয়েছে অসংখ্য পাহাড় ও টিলা কেটে। কয়লা দিয়ে ইটপোড়ানো নিয়ম থাকলেও এসব ভাটাগুলোতে দেদারছে পোড়ানো হচ্ছে পার্শ্ববর্তী সরকারী বেসরকারী বাগানের কাঠ।
অপরদিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সাতকানিয়া উপজেলাধীন মৌলভীর দোকান হতে শিশুতল পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার দুরত্বে রয়েছে ৩৫টি ইটভাটা। অবৈধভাবে এসব ভাটার সবগুলোই আবাদযোগ্য কৃষি জমি ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গা ঘেঁষে স্থাপন করা হয়েছে। যার ফলে ইট পোড়ানোর মৌসূমে ইটভাটা সংলগ্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষক শিক্ষার্থীরা শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়।
প্রতি বছরের ন্যায় চলতি মৌসূম শুরু হওয়ার সাথে সাথে উত্তর সাতকানিয়া জাফর আহমদ চৌধুরী কলেজ ও উত্তর সাতকানিয়া আলী আহমদ প্রাণ হরি উচ্চ বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী উপরোক্ত রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানান, প্রধান শিক্ষক মঞ্জুর কামাল।
৫ কিলোমিটারে অবৈধভাবে স্থাপিত ইটভাটা গুলোর আশপাশে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তা হচ্ছে রসুলাবাদ সরকরাী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সৈয়দ মক্কি (রাঃ) কিন্ডার গার্টেন, আসমা মফজল বালিকা বিদ্যালয়, রসুলবাদ সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা, উত্তর সাতকানিয়া জাফর আহম চৌধুরী কলেজ, উত্তর সাতকানিয়া আলী আহমদ প্রাণ হরি উচ্চ বিদ্যালয়, সাতকানিয়া পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, ওবাইদিয়া মাদ্রাসা, জনার কেওচিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও ছদাহা কে. কে. উচ্চ বিদ্যালয়। পরিবেশ, বন জলাবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কৃষিযোগ্য আবাদী জমি, বনাঞ্চল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশপাশে ইটভাটা স্থাপনে বিধি নিষেধ থাকলেও সাতকানিয়ায় এসব আইন ও বিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে নিষিদ্ধ জায়গায় ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে।
এদিকে অবৈধ ভাবে গড়ে উঠা এসব ভাটাগুলোতে বনাঞ্চল উজাড় করে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। তাছাড়া বন ঘেঁষে স্থাপিত ভাটার চিমনী থেকে নির্গত কাঁলো ধোঁয়ায় সরকারী বেসরকারী বনাঞ্চলের মূল্যবান প্রজাতির গাছগুলো মরতে শুরু করেছে। শুধু তাই নয় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়েকর পাশে ইটভাটাগুলোর কালো ধোঁয়ার প্রভাবে মহাসড়কে সামাজিক বনায়নের সৃজিত বাগান প্রায় বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে মৌলভীর দোকান হতে কেরানীহাট পর্যন্ত ৩ কিলোমিটারের মধ্যে সামাজিত বনায়নের ১২৫টি মূল্যবান গাছ মরে গেছে। ইট পোড়ানো কাজে ব্যবহারের জন্য নির্বিচারে পাহাড়ী এলাকার গাছ নিধনের ফলে বন্যপ্রাণীরা বনাঞ্চল ছেড়ে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। এতে জানমাল ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে স্থানীয় গরীব কৃষক ও খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষগুলোর উপর। প্রতিবছর নতুন নতুন ইটভাটা গড়ে উঠায় সাতকানিয়ায় কমে যাচ্ছে কৃষি জমির পরিমাণ।
ইটভাটা নির্মাণের জন্য ভূমি ব্যবহার ও ইটভাটা নির্মাণ স্থানের দিক নির্দেশনামূলক সরকারি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত আইন অনুযায়ী ইটভাটা নির্মাণের জন্য কেবল অকৃষি জমি ব্যবহার করা যাবে। কয়লা মজুদ করা না হলে লাইসেন্স নবায়নে সরকারি বিধি-নিষেধ রয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ ফসলের মাঠে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। অথচ এখানকার ইটভাটাগুলো ফসলের মাঠ ও গ্রামের আশেপাশে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে এবং বনাঞ্চলের পাশে অবস্থিত। এসব বিধান থাকলেও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন রহস্যজনক কারণে অবৈধ ইটভাটার কাজের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
সাতকানিয়া উপজেলার কেওচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনির আহমদ উক্ত ইটভাটার কার্যক্রমে অতিষ্ট হয়ে বলেন, আমি চাই সাতকানিয়ার সমস্ত ইটভাটা বন্ধ হয়ে যাক। ইটভাটার মাটি কাটতে কাটতে কেরাণীহাটের উত্তর পশ্চিম পার্শ্বে বিশাল এলাকা গভীর গর্তে পরিণত হয়েছে। ইটভাটার স্তুপকৃত মাটির কারণে বর্ষার সময়ে বন্যার পানি দ্রুত নিষ্কাশন হতে না পেরে বন্যা দীর্ঘায়িত হয় এবং মানুষ দীর্ঘদিন পানিবন্দী জীবন যাপন করে।
উত্তর সাতকানিয়া জাফর আহমদ চৌধুরী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র মিজবাহ উদ্দিন বলেন, কলেজের ৩ পাশেই ইটভাটা। সকালের রোদ বাড়ার সাথে সাথে ইটভাটার ধুয়ার উৎকট গন্ধে ক্লাস করা খুব কষ্টকর।
সাতকানিয়া ব্রিকফিল্ড সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন এর নিকট এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা পাহাড় কাটে তাদের সাথে আমাদের সমিতির সম্পর্ক নেই।
সাতকানিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক মোহাম্মদ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ইটভাটার কালো ধুঁয়ার কারণে শিশুসহ সাধারণ জনগণের মুখে, চোখে প্রদাহ ও শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা হয়।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলা পরিদর্শক হারুন অর রশিদ পাঠান বলেন, সাতকানিয়ায় যেসব ইটভাটা পাহাড় কাটছে সেখানে আমাদের অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে শীঘ্রই অভিযান চালানো হবে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলা উপ-পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ারের মুঠোফোনে বারবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
যোগাযোগ করা হলে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবারক হোসেন জানান, পাহাড় কাটার বিষয়ে কোন ছাড় দেয়া হবে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের সাথে আমি কথা বলে তাদের সাথে সমন্বয় করে শীঘ্রই যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
-সিভয়েস/এমএম
সিভয়েস প্রতিবেদক