Cvoice24.com

চট্টগ্রামে আজ, বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪

সময় ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড


নির্যাতিত নারী-শিশুদের বাতিঘর চট্টগ্রাম ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ২৬ নভেম্বর ২০১৯
নির্যাতিত নারী-শিশুদের বাতিঘর চট্টগ্রাম ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার

ছবি: সিভয়েস

দোতলা একটি ভবনে অত্যন্ত পরিপাটি করে সাজানো রয়েছে বেশ কিছু বিছানা। বিনোদনের জন্য রঙিন টেলিভিশন। শিশুদের জন্য বেশ কিছু খেলনাসহ রয়েছে ছোট একটি পার্ক, সাথে শরীর চর্চার আধুনিক সব সরঞ্জাম। প্রত্যেক রুমের মধ্যে রয়েছে আধুনিক শৌচাগারের ব্যবস্থা।

এখান থেকে নির্যাতিত নারী ও শিশুদের সব ধরনের আইনি সহায়তা দিচ্ছে নগরীর ডাবলমুরিং থানায় অবস্থিত ‘ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার’। নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের আশ্রয় বা থাকার জন্য পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির সহায়তায় পুলিশ এ ব্যবস্থা চালু করেছে।

একজন সহকারী পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে সাপোর্ট সেন্টারে কর্মরত আছেন ১৪ জন প্রশিক্ষিত মহিলা পুলিশ কর্মকর্তা। এছাড়া সংশ্লিষ্ট এনজিও সংস্থার জনপ্রতিনিধিরা ভুক্তভোগীদের তাৎক্ষণিক সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা, আইনি পরামর্শ, আইনি সহায়তা ও মানসিক পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে আসছে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার।

এনজিও সংস্থাগুলো হলো- আইন ও সালিশ কেন্দ্র, অপরাজেয় বাংলাদেশ, কমিউনিটি ডেভেলেপমেন্ট অ্যাসেসিয়েশন, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও এসিড সার্ভাইভার ফাউন্ডেশন।

চট্টগ্রাম ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের উপপুলিশ পরিদর্শক ইয়াসমিন আরা সিভয়েসকে বলেন, ‘এ সেন্টারে সহযোগিতা পাচ্ছে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুরা। ব্যস্ততা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্তদের থানায় সহযোগিতা পেতে বিলম্ব হয়। ফলে দুর্ভোগের শিকার হতে হয় ক্ষতিগ্রস্তদের। সেক্ষেত্রে নারী ও শিশুদের এসব দুর্ভোগ অনেকাংশ লাঘব করছে এই ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার।’

ভিকটিমদের সেবা দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন মামলার ভিকটিম, হারিয়ে যাওয়া শিশু, বাসা হতে রাগ করে বের হয়ে যাওয়া নারী ও শিশু, নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মী, প্রতিবন্ধী নারী ও শিশুদের ভিকটিম হিসেবে আমরা গণ্য করি এবং তাদেরই আমরা সেবা দিয়ে থাকি।’

ইয়াসমিন আরা বলেন, ২০১৪ সাল থেকে এই পর্যন্ত ১১৩৪ জন ভিকটিমকে আমরা সেবা দিয়েছি। যার মধ্যে ২০১৮ সালে ২৫২ জন এবং চলতি বছরে এ পর্যন্ত ২৪৯ জন সেবা নিয়েছেন। এ বছরে ভিকটিমদের মধ্যে ৩৮ জনকে পরিবারের কাছে,  ৬ জন এনজিওর কাছে ও ১১৬ জনকে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আইনগত সহায়তা দেয়া হয়েছে ৮৫ জনকে।’

ভিকটিমদের যেসকল সেবা প্রদান করা হচ্ছে: ভিকটিমকে সাদরে ও সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করে, নির্যাতিত নারী ও শিশুদের তথ্য প্রদানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা। জরুরি চিকিৎসাসেবা প্রদান করা এবং প্রয়োজনে ভিকটিমকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্রে যাওয়া। ভিকটিমের কথা মনোযোগ সহকারে শোনা ও সমস্যা চিহ্নিতকরণে সহায়তা করা। ভিকটিমের অভিযোগ লিপিবদ্ধ করাসহ এফআইআর করার ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করা। আইনগত প্রক্রিয়া সম্পর্কে ভিকটিমকে সঙ্গে অবহিত করা। তদন্ত কার্যক্রমে সহায়তা করা এবং অগ্রগতি সম্পর্কে ভিকটিমকে অবহিত করা। ভিকটিমকে প্রয়োজনে ফোনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করা। মনোসামাজিক কাউন্সেলিং প্রদান করা। দীর্ঘমেয়াদি (শেল্টার, লিগ্যাল এইড, শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা, পরিবারে একত্রকরণ) সহায়তার জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় রেফার করা। 

ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে সেবা গ্রহণকারী বেগম নিলুফার আক্তার সিভয়েসকে বলেন, ‘অনেক দিন যাবৎ শ্বশুর  বাড়ির লোকেরা আমাকে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন করে আসছে। ২ বছর ধরে সহ্য করেছি এই পৈশাচিক নির্যাতন। নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে, তাই নিজেকে বাঁচাতে এখানে এসেছি।’

সাপোর্ট সেন্টারের সেবায় সন্তুষ্ট জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে প্রথমে আমাকে জরুরি চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়েছে। সকল ধরনের আইনি সহযোগিতা আমি এখান থেকে পাচ্ছি। তবে সবচেয়ে মুগ্ধ হয়েছি তাদের আন্তরিকতায়। সব মিলে দারুণ একটি পরিবেশ পেয়েছি।’

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার (সিএমপি) মো. মাহাবুবর রহমান সিভয়েসকে বলেন, অভিযোগ হেলপ লাইন ‘৯৯৯’ সার্ভিস এর মাধ্যমে অনেক নির্যাতিত নারী অভিযোগ দিতে পারেন। নারী ও শিশু নির্যাতনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে অভিযোগ হেলপ লাইনের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে। এমন কিছু হলে সেখানে আমরা সাথে সাথে মুভ করি।

তিনি আরো বলেন, হারানো নারী ও শিশুদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টিও আমরা নিশ্চিত করি। তবে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অর্থাৎ মারাত্মক ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা সঙ্গে সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। সব মিলিয়ে আমরা টিমওয়ার্কের মতো কাজ করি।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নির্যাতিত নারী ও শিশুদের সর্বোচ্চ পাঁচ দিন পর্যন্ত থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এর পরও যদি কোনো ভিকটিমকে থাকতে হয়, তাহলে তাকে সংশ্লিষ্ট কোনো এনজিওতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তিনি যতদিন প্রয়োজন ততদিন থাকতে পারবেন। এ সেন্টারে এনজিও রুটিন অনুযায়ী কাজ করে। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের ডেপুটি গভর্নর আমিনুল হক বাবু সিভয়েসকে বলেন, ‘নগরীতে এরকম একটি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থাকা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক। এ সেন্টারকে কাজের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের পাশাপাশি পুলিশ-ভীতি দূর করতে হবে। আসলে এটা শুধু পুলিশের একার কাজ নয়। এ ব্যাপারে অন্যান্য আইনি সেবা প্রতিষ্ঠান ও মানবাধিকার সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি শুধু বিভাগভিত্তিক না হয়ে প্রত্যেকটি থানাতে একটি করে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থাকা দরকার। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নিয়মিত তদারকি করা হলে ভিকটিমরা খুবই সহজে তাদের সমস্যার সহজ সমাধান পাবেন। এক্ষেত্রে সরকারেরও আন্তরিক সহায়তা প্রয়োজন।’

নগর পুলিশ কমিশনারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে সাপোর্ট সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে। নারী ও শিশু পাচার, এসিড নিক্ষেপ, যৌন হয়রানি কিংবা ধর্ষণের শিকার- এমন নারীদের এ সাপোর্ট সেন্টার থেকে সহযোগিতা করা হয়।

ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের মুখ্য উদ্দেশ্যগুলো হলো- সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা দূর করে নারী ও শিশুর প্রতি সংঘটিত অপরাধ প্রতিবেদনের সুযোগ নিশ্চিত করা, ভিকটিমকে সময়োপযোগী ও পেশাগত সেবা প্রদান করা, ভিকটিমের সুরক্ষা ও আইনগত অধিকার রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করা, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে ভিকটিমের সর্বোত্তম সেবা নিশ্চিত করা, ভিকটিমকে বারবার নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করা, নারী ও শিশুর প্রতি সংঘটিত অপরাধের তথ্য সংরক্ষণ করা এবং অপরাধ নিরোধে কার্যকর নীতি তৈরি করা।

প্রসঙ্গত, নারী ও শিশুদের সমন্বিত সেবা নিশ্চিত করতে ২০০৮ সালে ১০টি এনজিওর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ পুলিশ। তারই ফলে ২০০৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার তেজগাঁও থানায় স্থাপন করা হয় দেশের প্রথম ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার। ২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামে ডবলমুরিং থানা কম্পাউন্ডে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার স্থাপন করা হয়।

-সিভয়েস/আই

জোবায়েদ ইবনে শাহাদত

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়