Cvoice24.com


বায়ু দূষণে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি

প্রকাশিত: ১৫:৪৪, ১৭ নভেম্বর ২০১৯
বায়ু দূষণে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি

ছবি : সিভয়েস

যান্ত্রিক যুগের কারণে বাস, ট্রাক, ট্রাক্টর, স্যালো ইঞ্জিনবাহিত যানবাহন এমনকি ফিটনেসবিহীন গাড়ীর কালো ধোঁয়ার আগ্রাসনে বায়ুদূষণের মাত্রা অতীতের চেয়ে হাজার গুণ বেড়ে গেছে। এ কারণে বায়ুদূষণ এখন সকল শ্রেণির মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুকনো মৌসুমে বাতাসে ধুলা বেশি থাকে। কিন্তু শহর এলাকায় পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে মনুষ‌্যসৃষ্ট কারণে। যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে বড় বড় নির্মাণ কাজ চলায় সর্বত্রই এখন ধুলা।

দেশের উন্নয়নে রাস্তাঘাট, ভবন নির্মাণ, নগরায়ন, করতে হলে ইট ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য পুরোনো ও অপরিকল্পিত ইটভাটাগুলোর বদলে সরকার অনুমোদিত পরিবেশ বান্ধব জিগজাগ পদ্ধতির ইটভাটায় ইট পোড়ানো, শহরের ভিতরে রাস্তা খোড়াখুড়ির পর পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া এবং সিমেন্টের বর্জ্যদুষণ রোধে ঢেকে রেখে কাজ করলে ধুলিদুষণ অনেকাংশে কম হত।

গবেষকরা বলছেন, মাত্র ১০ মাইক্রন আয়তনের ক্ষুদ্র কণা সহজে ফুসফুসের অভ্যন্তরে ঢুকতে পারে। অথচ স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি এমন অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, যাদের আয়তন প্রায় আড়াই মাইক্রনের সমান। আর আড়াই মাইক্রন আয়তনের একটি কনা খুব সহজেই মানুষের ফুসফুস ভেদ করে রক্ত প্রবাহে মিশে যেতে পারে।

বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম) পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পিপিএম-পার্টস পার মিলিয়ন) এককে। এসব বস্তুকণাকে ১০ মাইক্রোমিটার ও ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস শ্রেণিতে ভাগ করে তার পরিমাণের ভিত্তিতে ঝুঁকি নিরূপণ করেন গবেষকরা।

বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার পরিমাণ (পিপিএম) যদি শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকে, তাহলে ওই বাতাসকে বায়ু মানের সূচকে (একিউআই) ‘ভালো’ বলা যায়।এই মাত্রা ৫১-১০০ হলে বাতাসকে ‘মধ্যম’ মানের এবং ১০১-১৫০ হলে ‘বিপদসীমায়’ আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। আর পিপিএম ১৫১-২০০ হলে বাতাসকে ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১-৩০০ হলে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০১-৫০০ হলে ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ‌্যকর’ বলা হয়।

গত শনিবার চট্টগ্রামের বাতাসে এর পরিমাণ ছিল ৩৫০ পিপিএম যেখানে বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার পরিমাণ ১০০ পিপিএম পার হলেই বিপদজনক মাত্রায় বলে ধরা হয়। এর ফলে শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে ঠাণ্ডাজনিত রোগ, শ্বাসনালীর ক্ষতসহ নানা ধরেন মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে শিশু ও বয়স্কদের।

বায়ু দূষণের কারণে স্বাস্থ‌্য ঝুঁকি কতটুকু বাড়ছে এ প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন) ডা. মো. সাইদুল আলম সিভয়েসকে বলেন, “হাঁচি-কাশি নিয়ে রোগী আসছে হরদম। কমন কোল্ড, সাইনোসাইটিস, গলাব্যথা, অ্যাজমা-অ্যালার্জি, শ্বাসতন্ত্রে ক্ষতসহ নানা ধরনের রোগী আসছে। বায়ু দূষণ এর বড় কারণ।”

তিনি বলেন, বয়স্কদের মতো শিশুরাও বায়ু দূষণের কারণে নানা অসুস্থতায় ভুগছে। আমাদের কাছে যে রোগীরা আসেন, তাদের অধিকাংশের সমস্যা শ্বাসকষ্টজনিত। ‘সিজনাল ডাস্টের’ কারণে শীত মৌসুমে এ ধরনের রোগীই বেশি আসে।

বেশির ভাগ নির্মাণ কাজ চলছে পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা না রেখেই। অননুমোদিত ইটভাটাও চলছে বিভিন্ন এলাকায়। রাস্তায় মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া যানবাহন চলাচলও বন্ধ হচ্ছে না। সব মিলিয়েই বায়ু দূষণ দিনদিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউল হক সিভয়েসকে জানান,“সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ভাসমান ক্ষতিকর বস্তুকণা এখনকার বাতাসে বিরাজ করছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কিন্তু সমন্বিত উদ্যোগ থাকলে বায়ুদূষণ সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব। রাস্তাঘাটে নিয়ন্ত্রণহীন খোঁড়খুঁড়ি ও অপরিকল্পিত নির্মাণ কাজ বন্ধের পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টি করলে ফল পাওয়া যাবে।”

জিয়াউল হক বলেন, বায়ু দুষণকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করেছি। এক ভাগ হচ্ছে ঘরের বাইরের দুষণ, আর এক ভাগ হচ্ছে ঘরের ভিতরের দূষণ। গৃহ অভ্যন্তরে ব্যবহৃত কয়লা, কাঠ ও কেরোসিনের মতো জ্বালানি থেকে নির্গত ধোঁয়া বাতাসের গুণগত মান নষ্ট করে।

তিনি বলেন, ইটভাটা, নির্মাণ কাজ, যাবনাহন, শিল্পকারখানা ও বালুমহাল- এ পাঁচটি বিষয় বায়ুদূষণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে। ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ, মোটরযান আইন, ইমারত নির্মাণ আইন ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী এ ধরনের দূষণের জন্য সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমনা, সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড বা উভয়দণ্ডের বিধান রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে এ আইন প্রয়োগ করা হলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।

নগরের বায়ু দূষণ নিয়ে কারো দ্বিমত না থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তর এ নিয়ে আরও সমীক্ষার উদ্যোগ চায়। বায়ু দূষণ রোধে করণীয় নির্ধারণে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, পুলিশ, বিআরটিএসহ জড়িতদের নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।

বাতাসে ক্ষতিকর বস্তুকণা সহনীয় মাত্রায় রাখার জন‌্য এখনই অন্তত পাঁচটি বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন জিয়াউল হক।

১. নগরের আশপাশে গড়ে ওঠা অবৈধ ইটভাট বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব ইটভাটা নির্মাণে জোর দিতে হবে।

২. অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে খুঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে সকাল-দুপুর-বিকালে অন্তত তিন দফা নির্মাণাধীন রাস্তাঘাটে পানি ছিটাতে হবে।

৩. প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন রাস্তায় বালি, মাটিসহ নানা ধরনের সামগ্রী পরিবহনের সময় মালামাল ঢেকে স্থানান্তর করা প্রয়োজন।

৪. সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দশ থেকে ২০ বছরের পুরনো যানবহনের দূষিত ধোঁয়া বন্ধে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।

৫. আইনভঙ্গের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশাপাশি বিআরটিএ, পুলিশ-প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনকে আরও উদ‌্যোগী হতে হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের নিমর্ল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট-সিএএসই) প্রকল্প পাঁচ বছর ধরে প্রতিদিনের বায়ুমানের তথ‌্য প্রকাশ করে আসছে।

‘সিএএসই’ প্রকল্পের মাধ্যমে চট্টগ্রামের দুটি পয়েন্টসহ ৮ নগরীর বাতাসে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস পর্যন্ত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ নিয়মিত পরিমাপ করা হচ্ছে। বাতাসে বস্তুকণা ছাড়াও কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, ওজোন, সালফার ডাই অক্সাইডের মাত্রাও পরিমাপ করা হচ্ছে সিএএসই প্রকল্পে।
সিএএসই প্রকল্পের তথ‌্যে দেখা যায়, শীত মৌসুমে দেশের প্রধান নগরগুলোতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ থাকে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বা তারচেয়েও খারাপ মাত্রায়।

-সিভয়েস/এসসি

 

 

জোবায়েদ ইবনে শাহাদত

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়