Cvoice24.com


সংস্কৃতিমনাদের আশার আলো মুসলিম হলের নতুন কমপ্লেক্স

প্রকাশিত: ০৮:৪৫, ৯ নভেম্বর ২০১৯
 সংস্কৃতিমনাদের আশার আলো মুসলিম হলের নতুন কমপ্লেক্স

ছবি : আকমাল হোসেন

আধুনিক, মানসম্মত এবং সাংস্কৃতিক অনুকূল পরিবেশ সম্পন্ন মিলানায়াতনের স্বল্পতার কারণে বিমুখ হয়ে উঠছে সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যক্রম। চট্টগ্রামে ৩ শতাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে।

সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বরা বলছেন, মুসলিম ইনস্টিটিউট কমপ্লেক্স বাস্তবায়ন হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গবেষকদের বই এবং তথ্যের চাহিদা যেমন পূরণ হবে তেমনি নগরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আসবে নতুন  গতি।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন সর্বশেষ ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ এ চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্প কাজের অগ্রগতি পরিদর্শন করেন এবং দ্রুত কাজ সম্পন্ন করার বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন।

এ বিষয়ে তিনি সিভয়েসকে বলেন, ’একটি বিকাশমান আধুনিক নগরের চাহিদা বিবেচনা করে এই কমপ্লেক্স নির্মিত হচ্ছে। আমি প্রত্যাশা করি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম যেন সাংস্কৃতিকভাবে জেগে উঠে এবং এই কমপ্লেক্স নির্মানের মাধ্যমে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে বলে আমি মনে করি।

গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১৫ তলা বিশিষ্ট লাইব্রেরি ভবনে থাকছে অফিস স্পেস, সেমিনার, মিটিং রুম, জেনারেল লাইব্রেরী, চিলড্রেন লাইব্রেরী,নিউজ পেপার লাইব্রেরী, রেফারেন্স লাইব্রেরী, সাইন্স লাইব্রেরী, ট্রেনিং ইউনিট, আইসিটি ইউনিট, গেষ্ট হাউস ইত্যাদি।

আধুনিক তথ্যবহুল যুগে বিভিন্ন স্তরের মানুষের জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন লাইব্রেরি যেমন শিশুলাইব্রেরী, সায়েন্স লাইব্রেরি, রেফারেন্স লাইব্রেরি প্রভৃতি সংযোজন করায় এ অঞ্চরের সর্বস্তরের লোক উপকৃত হবে।

নির্মাধীন অডিটোরিয়াম ভবটিরতে থাকছে দু’টি সেমিনার হল। তম্মোধ্য ১টি হলের ধারণ ক্ষমতা ১শ জন এবং অন্যটির ২শ জন। ২টি থিয়েটার হলের মধ্য একটি ৩৫০ জন, অপরটি ৮৮০ জন ধারণ ক্ষমতার থিয়েটার নির্মিত হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষটরা।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার কথা রয়েছে এবং সেই লক্ষে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করা হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব সর্বাধুনিক দৃষ্টিনন্দন একটি কমপ্লেক্স করতে যা যা দরকার সবই রাখা হচ্ছে এ প্রকল্পে। তবে মূল সড়কে গ্যাস, বিদ্যুৎ, ওয়াসার নতুন পাইপ লাইন ইত্যাদি ইউটিলিটি লাইন সরানো নিয়ে কিছুটা সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। প্রথমে আন্ডারপাসের মাধ্যমে শহীদ মিনারে যাতায়াতের পরিকল্পনা করা হলেও পরে তা বাতিল করা হয়।

চটগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ গ্রপ থিয়েটার ফেডারেশনের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু বলেন, চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক চর্চা দিন দিন তুলনামূলক বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবে মিলনায়তনের স্বল্পতার কারণে সাংস্কৃতিক কর্মীগণ প্রতিনিয়ত শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মূখিন হচ্ছেন।

সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশের স্বল্পতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে  চটগ্রামে ৩শ'র অধিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্যে থিয়েটার ইনস্টিটিউট ও শিল্পকলা একাডেমি ছাড়া কোনো মিতলনায়তন নেই। মাত্র দুটি মিতলনায়তন দিয়ে এত সংগঠনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা খুবই কঠিন। দ্রুত এই কমপ্লেক্স নির্মাণের মাধ্যমে চট্টগ্রামের সংস্কৃতি কর্মীদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নতুন মাত্রা যোগ হবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।

২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রকল্পটি একনেকে পাস হয়। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গণগ্রন্থাগার অধিদফতর, গণপূর্ত অধিদফতর ও স্থাপত্য অধিদফতর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ২৩২ কোটি ৫২ লাখ টাকার এ প্রকল্পে প্রথম পর্যায়ে ১৬৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা চুক্তিমূল্যে কাজ করছে জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড ও এনডিই ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (জেভি)।

প্রকল্পের অধীনে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৮০০ বর্গফুটের ১৫ তলা লাইব্রেরি ভবন, ৭৭ হাজার ৪৯২ বর্গফুটের আট তলা অডিটোরিয়াম, ৬৫ হাজার বর্গফুটের বেসমেন্টসহ ১১২টি গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা, নতুন শহীদ মিনার তৈরি, মূল সড়কের ওপর শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের যাতায়াতের জন্য টানেলের মতো ওভারপাস তৈরি, ১ লাখ ৩১ হাজার ২৭৫ বর্গফুট জুড়ে পাবলিক প্লাজা, ২৫০ জনের ওপেন এয়ার থিয়েটার, মসজিদ, মার্কেট, পুকুর, ল্যান্ডস্কেপ, ফুড গার্ডেন, ক্যাফেটেরিয়া, মিউজিয়াম নির্মাণ করা হবে।

প্রকল্পে ট্রেনিং ইউনিট, আইসিটি ইউনিট, গেস্ট হাউস থাকবে। অডিটরিয়ামের প্রতি তলায় রিহার্সেল কক্ষ, অফিস, স্টোর, গ্রিন রুম, ক্যফেটরিয়া, জিমনেসিয়াম ইত্যাদিও থাকছে।

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে ২টি ১২৫০ কেভি সাবস্টেশন, ২৫০ কেভিএ’র ২টি জেনারেটর থাকবে। ৮টি লিফট ও ৯৭৩ টন এয়ারকুলারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে মূল পরিকল্পনায়।

২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু হওয়া প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর। যদিও পুরোনো বিভাগীয় সরকারি গণগ্রন্থাগার ভবন ভাঙার কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল।

প্রকল্পে ২ ফুট ব্যাসের ৪৮ ফুট লম্বা মোট শোর পাইল করা হচ্ছে ৫৭৬টি। ইতোমধ্যে ৩০০ শোর পাইল ড্রাইভ এর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ১৪ বাই ১৪ ইঞ্চির ৫৮ ফুট দীর্ঘ সার্ভিস পাইল হবে ১ হাজার ৩৪৭টি।

জানা গেছে,  প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে নেয়ার জন্যে হাইড্রোলিক রোটারি রিগ মেশিন, স্ট্যাটিক পাইল ড্রাইভার, স্কেভেটার, ক্রেন ইত্যাদি আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রায় ১ শতাধিক শ্রমিক প্রতিদিন কাজ করছেন এ প্রকল্পে এবং এই পর্যন্ত ১৪ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে । তবে শহীদ মিনারের ডিজাইনগত জটিলতার কারণে প্রকল্পটি শেষ হতে ২০২১ নাগাদ সময় লাগতে পারে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম জানান, একটি জায়গায় নতুন ভবন তৈরির চেয়ে পুরোনো ভবন ভেঙে নতুন করে তৈরি করা অনেক বেশি কঠিন। সেই কঠিন কাজটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি আমরা। এটি হবে চট্টগ্রামের একটি আইকনিক স্থাপনা।

লাইব্রেরির পাশে মুসলিম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রেখে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হবে। এবং এখানেই গড়ে তোলা হবে মুসলিম ইনস্টিটিউটের মাল্টিপারপাস হল। হলটির প্রথম ও দ্বিতীয় ফ্লোরে সেমিনার ও এঙপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল, তৃতীয় ফ্লোরে ক্যাফেটারিয়া ও প্রজেকশন হল, চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় মিলনায়তন থাকবে। মুসলিম ইনস্টিটিউট অংশে ৭৫০ আসনের মিলনায়তন, ৩০০ থেকে ৩৫০ আসনের মিনি অডিটরিয়াম থাকবে। ২০০ ও ১০০ আসনের দুটি সেমিনার কক্ষ, ১টি আর্ট গ্যালারি ও স্যুভেনির শপও থাকবে।

শহীদ মিনারের একপাশে থাকবে ফুড প্লাজা অন্য পাশে মুক্ত মঞ্চ। সেখানে ব্যবস্থা থাকবে সাংস্কৃতিক আয়োজনের পাশাপাশি সভা-সেমিনার আয়োজনের।

জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়া মুসলিম হল অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুপযোগী হয়ে পড়লে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীদের দাবির মুখে সরকার প্রকল্পটি গ্রহণ করে। এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক কর্মীরা চট্টগ্রামে একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কমপ্লেঙ গড়ে তোলার দাবি জানিয়ে আসছিলেন দীর্ঘদিন ধরে।  

২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মুসলিম হল ভেঙে আধুনিক কালচারাল কমপ্লেঙ করার লিখিত নির্দেশনা দেয়া হয়।

২০১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর তীর্যক নাট্যদলের ৪ দিনব্যাপী নাট্যমেলায় প্রথমবার সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর মুসলিম ইনস্টিটিউট ভেঙে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কমপ্লেঙ তৈরি করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানিয়েছিলেন।

এর আগে একই বছরের ৬ মে চট্টগ্রামে এসেছিলেন মন্ত্রী। তখন তিনি বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রিসভায় আলোচনার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছিলেন।

উল্লেখ্য ১৯২৫ সালে চট্টগ্রামের কিছু সংস্কৃতি এবং সমাজসেবীর উদ্যোগে চট্টগ্রাম নগরীর প্রাণকেন্দ্রে চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট নামে প্রতিষ্ঠানটি নির্মিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে সরকার মুসলিম ইনস্টিটিউট অধ্যাদেশের মাধ্যমে হলটি অধিগ্রহণ করে।

সিভয়েস/এসসি

জোবায়েদ ইবনে শাহাদত

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়