Cvoice24.com

চট্টগ্রামে আজ, বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪

সময় ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড


‘সাউন্ড সিস্টেমের’ ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে পূজার বাদ্য-বাদক

প্রকাশিত: ১০:৪৩, ৭ অক্টোবর ২০১৯
‘সাউন্ড সিস্টেমের’ ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে পূজার বাদ্য-বাদক

ছবি: আকমাল হোসেন

পূজোতে ঢোল-কাঁসর, শঙ্খধ্বনি, বীণা, ঢোঙ্গর, কালোবাঁশি, জোরখাই ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন থাকলেও আধুনিক সভ্যতার কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে এসব বাদ্যযন্ত্র। বর্তমানে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারের কারণে এসবের প্রচলন দিন দিন অনেকটা কমে গেছে। বছরব্যাপী কাজ না থাকায় বংশানুক্রমিক এসব পেশা পরিবর্তন করে নতুন উপার্জনের পথ ধরেছে এসব বাদ্যবাজক।

হিন্দু ধর্মালম্বীদের ঐতিহ্যে ঢোল-কাঁসর-শঙ্খধ্বনি পূজার অত্যাবশকীয় উপাদান। কোনো কোনো দেবতার মূর্তিকল্পনায়ও বাদ্যযন্ত্রের যোগসূত্র লক্ষ করা যায়। শঙ্খধারী ‘বিষ্ণু’, ডমরুধারী ‘শিব’, মুরলীধারী ‘কৃষ্ণ’ এবং বীণাধারিণী ‘সরস্বতীর’ মূর্তি এভাবেই কল্পিত হয়েছে। বাদ্যযন্ত্রের প্রভাবে সরস্বতী ‘বীণাপাণি’ এবং কৃষ্ণ ‘মুরলীধর’ নামে পরিচিত। 

প্রচীন ভারতীয় উপমহাদেশে খননকার্য ও প্রাচীন সাহিত্য থেকে অতি উন্নতমানের এক সাঙ্গীতিক সভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। সেই সূত্রে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রেরও পরিচয় মেলে। সিন্ধুসভ্যতায়ও বেণু, বীণা ও মৃদঙ্গের ব্যবহার ছিল। বাংলাদেশে এসব লোকবাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বহু প্রাচীন। আনুমানিক ত্রয়োদশ শতকে রচিত ধর্মপূজার গ্রন্থ শূন্যপুরাণে  ঢাক, ঢোল, কাড়া, মৃদঙ্গ, মন্দিরা, ডম্বরু, দুন্দুভি, বরঙ্গ, ভোর, ধীরকালি, শঙ্খ, শিঙ্গা, ঘণ্টা, জয়ঢাক, দামামা সহ নাম না জানা বিভিন্ন সংগীত যন্ত্রের কথা উল্লেখ আছে। এগুলোর অধিকাংশই ধর্মপূজা উপলক্ষে বাজানো হতো। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার কালের বিবর্তনে হারিয়ে গিয়েছে এসব বাদ্যযন্ত্র। এখন পূজায় ব্যবহার হয় না হিন্দু সভ্যতার ঐতিহ্যবাহী এসব  বাদ্যযন্ত্র, যার স্থান দখল করে নিয়েছে হালের জনপ্রিয় সাউন্ডবক্স।

সরেজমিনে নগরের আলকরণ, পাথারঘাটা, বাকলিয়া সহ বিভিন্ন পূজা মণ্ডপ পরিদর্শনে দেখা যায় সাউন্ডবক্সের শব্দেই আনন্দে মেতেছে তরুণ প্রজম্ম। এদের অনেকেই জানে না ধর্মীয় বাদ্যযন্ত্রের এসব আচার-রীতি আর ঐতিহ্য।

নগরের পাথরঘাটা সতীশ বাবু লেইনে ‘তাল তরঙ্গ’, ‘মৃদঙ্গ ভাণ্ডার’, ‘তাল বিতান’ , ‘সুবর্ণা সুর’, ‘চিটাগাং ব্যান্ড’ সহ প্রায় ২০ টি বাদ্যযন্ত্রের দোকান রয়েছে। এক সময় পূজা-পার্বণে নতুন রুপে সেঁজে উঠতো এসব দোকান। ঢুলীদের সাড়া পড়ে যেত দোকানে দোকানে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসব দোকানে ঢাক-বাজনা ওয়ালাদের এসব ডাক হাক আর নেই। বাদ্যযন্ত্র মেরামত করার দোকানগুলোতে পূজা উপলক্ষে কিছু কাজ আসে। বিলুপ্তপ্রায় কিছু বাদ্যযন্ত্রের যন্ত্রাংশের সহজলভ্যতা না থাকায় এসব গ্রাহক আবার ফেরতও যায়।


চিটাগাং ব্যান্ডের কর্ণধার মো. আল আমিন সিভয়েসকে জানান, পরিবার সূত্রেই বর্তমানে এ ব্যবসায়ের ধারক তিনি। পারিবারিক ব্যাবসাটি দেখা-শুনা করছেন প্রায় ১০ বছর ধরে। কিন্তু বিগত ১০ বছরের তুলনায় বর্তমানে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছেন। কেননা এখন পূজায় আর আগের মত ঢাক-ঢোলের ব্যবহার হয় না।

চিটাগাং ব্যান্ডের তরুণ এ কর্ণধার আরোও জানান, ১০ বছর আগেও পূজায় ব্যস্ত সময় পার করতেন ঢুলীরা (ঢোল বাদক)। দৈনিক সাত থেকে আট জনের কমপক্ষে ৫টি দল পূজায় কাজ করতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে দৈনিক ১টি দলের কাজের অর্ডারও নেই। তবে চট্টগ্রামের বাইরে কুমিল্লা জেলায় ব্যান্ড দলের খুব ভালো চাহিদা আছে বলে জানান তিনি।

সতীশ বাবু লেইনের প্রায় ৭০ বছরের পুরানো দোকান মৃদঙ্গ ভান্ডার। এ দোকানের ঢুলি রোহিত দাশ জানান, এ শিল্পের উপাদান এখনো পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি। কিন্তু ধীরে ধীরে সংকীর্ণ হয়ে আসছে। চট্টগ্রাম জেলা শহরের বাইরে পটিয়া, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, সীতাকুন্ডসহ বিভিন্ন উপজেলায় মণ্ডপে মণ্ডপে এখনো ডাক পরে তাদের। তবে আগের তুলনায় কাজ অনেক কম।

এ গোত্রের ঢুলি কানুঙ্গ দাশ জানান, প্রায় ৪০ বছর ধরে এ পেশায় আছেন । এ শিল্পের হারানো জৌলুস আর ফিরে আসবেনা মনে করেন তিনি। হতাশা ব্যক্ত করে তিনি জানান, আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্তমানে হারিয়ে যাচ্ছে জোরখাই (হাতের আঙ্গুলে কাঠির সাহায্যে বাজানো ঢোল), কালো বাঁশি (ক্লাইনেট), ঢোঙ্গর সহ ঐহিত্যবাহী পূজার আরোও অনেক বাদ্যযন্ত্র। 

বাদ্যের পাশাপাশি বিলুপ্ত এসব যন্ত্রের বাদকও। মিতালী সুরের কর্ণধার, ক্লিংকন দাশ জানান, সুরের মূছনা তোলা ক্লাইনেট বাদক শহরে নেই বললেই চলে। হাতগোনা ২/১ জন জোরখাই বাদক রয়েছে চট্টগ্রাম শহরে। পুরাতন বাদ্যযন্ত্রের দোকান ঘুরে দু’একটি ঢোঙ্গর পাওয়া গেলেও বর্তমানে নেই কোন ঢোঙ্গর বাদক। তবে পূজার বাইরেও বিভিন্ন মিছিল-মিটিং, লগ্ন, ওরশ এবং গ্রামীণ জনপদে ব্যান্ডদলের (ঢোল বাদকের দল) মোটামুটি চাহিদা থাকায় কোন রকমে টিকে রয়েছে ঢুলিরা। তবে এসব কাজ সারা বছর না থাকায় ঢুলি পেশায় আগ্রহ নেই ঢুলিদের। বছরের ৩/৪ মাস কাজ থাকে এ পেশায়। তাই বাধ্য হয়েই ঢুলিরা জড়িয়ে পড়ছেন অন্যান্য পেশায়। বেশির ভাগ ঢুলিই সারা বছর নাপিত (চুল কাটার) কাজ করেন, কেউ করেন চৌকিদারি আবার কেউ চালায় রিকশা বা অটো-রিকশা। তবে কাজের মৌসুম এলেই এরা সবাই ‘ঢুলি’।

সিভয়েস/এএস

আসিফ আহমেদ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়