Cvoice24.com


২৫ হাজার গ্রাহকের গ্যাস সংযোগ দিবে কে?

প্রকাশিত: ১৬:১৪, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯
২৫ হাজার গ্রাহকের গ্যাস সংযোগ দিবে কে?

ষোলশহর রহমান নগর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা নুরুল আলম। আবাসিক গ্যাস সংযোগের জন্য ২০১৫ সালে আবেদন করেন তিনি। কিন্তু সরকারি নিষেধাজ্ঞা দেখিয়ে গ্যাস সংযোগ দেননি কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। এদিকে ভবনের কাজ শেষ হলেও গ্যাসের সংযোগ পাননি নুরুল আলম। সিলিন্ডার গ্যাসের মাধ্যমে তার ভাড়াটিয়ারা রান্নার কাজ সেরে নিচ্ছেন। কিন্তু গ্যাস সংযোগ না থাকার ফলে ভবনের অর্ধেক ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া নেই, যা আছে সব অন্যান্য ভবনের চেয়ে অর্ধেক ভাড়ায় থাকছেন। এরকম আরও কয়েকজনে তাদের গ্যাস সংযোগ না পাওয়ার কথা প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরেন।

২০১৪ সালের শেষের দিকে কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড আবাসিক গ্রাহকের সব সংযোগ বন্ধ করে দেন। এতে আবেদনকারী রয়েছেন প্রায় ২৫ হাজার গ্রাহক। 

গ্রাহকদের অভিযোগ, বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) উচ্চপদস্থ কিছু কর্মকর্তা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে অপেক্ষমাণ গ্রাহকদের আবাসিক সংযোগ বন্ধ রেখেছে। এরই কারণে গ্রাহক সমাবেশ করে কয়েকবার আন্দোলন করলেও কোন সুরহা এখনো মিলেনি। তবে কেজিডিসিএল জানিয়েছেন, সরকারের নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত কোন কিছুই করা যাবে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেজিডিসিএল কর্তৃক অনুমোদন ও চাহিদাপত্র পাওয়ার পর গ্রাহকেরা ব্যাংকের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা জমা করেন। ছোট-বড় ভবন অনুযায়ী একেকজন গ্রাহক সর্বনিম্ন ২৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা দিয়েছেন। প্রতি গ্রাহক যদি প্রতিটি সংযোগের জন্য ২০ হাজার টাকা করেও দেয় তার পরিমাণ দাড়ায় ৫০ কোটি টাকা। আবার এ ৫০ কোটি টাকা গত পাঁচ বছর ধরে রয়েছে ব্যাংকের কোষাগারে। তার থেকে যে মুনাফা আসছে তাও ভোগ করছে কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি। সেই সাথে রাস্তা খননের জন্য এই গ্রাহকেরাই কোটি কোটি টাকা সিটি কর্পোরেশনকে ফি দিয়ে রাস্তা খননের অনুমোদন সংগ্রহ করেন। গ্রাহকের সঙ্গে চুক্তি করেও সংযোগ না দেওয়ার পিছনে সাবেক এমডি আইয়ুব খান চৌধুরীকে দায়ী করছেন গ্রাহকরা। 

গ্রাহকদের দাবী, ৪ বছর পূর্বে গ্রাহকের নিকট থেকে কোটি কোটি টাকা গ্রহণ করেও আজ পর্যন্ত আবাসিক সংযোগ প্রদান করেননি। এটা শুধু অমানবিক নয়, গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণাও বটে। কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি কর্তৃপক্ষের নিকট গ্রাহকগণ বার বার ধর্ণা দিয়েও গ্যাস সংযোগ না পেয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আবাসিক গ্যাস সংযোগের ব্যাপারে যদি সরকারের নিষেধাজ্ঞা থেকেই থাকে, তবে কেন হাজার হাজার গ্রাহককে গ্যাস সংযোগ কাজের অনুমোদন দিয়ে এবং কোটি কোটি টাকা জামানত সংগ্রহ করা হলো? এই রহস্য উন্মোচন করা আবশ্যক। কেজিডিসিএল এর সর্বশেষ প্রতারণা হচ্ছে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে অনুমোদন দিয়ে এবং প্রতিটি গ্রাহকের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে সংযোগ প্রদান বন্ধ রাখা।

এর আগে কর্তৃপক্ষ বলেছিলো এলএনজি গ্যাসের সরবরাহ হলে গ্যাস সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু এলএনজি সরবরাহ হলেও নগরীতে চাহিদা রয়েছে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের। 

এদিকে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটও গ্যাস নিতে পারছেনা। কারণ চট্টগ্রামে যে গ্যাসের নেটওয়ার্ক রয়েছে তা দূর্বল। পুনঃ মেরামত করে গ্যাস নিতে হবে বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।

আবাসিক গ্যাসের আবেদনকারী জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সরকার তো সাধারণ মানুষদের কষ্ট দিতে চায় না। এগুলো এখানকার কর্মকর্তাদের বানানো কথা। দেশের জনগণ বাঁচলে দেশ বাঁচবে। এটা সরকার খুব ভালোকরেই জানে। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এটাকে ব্যবহার করে ফায়দা লুটছে। এমডি কিভাবে কোটি কোটি টাকা নিয়ে বসে আছেন? তার কি মৃত্যুর ভয় নেই? তার জবাব আমাদেরকে দিতে হবে। তিনি আমাদের কথা দিয়েছিলেন, গ্যাস সংযোগের ব্যাপারে তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত সংযোগ প্রদানের ব্যাপারে একটা শব্দও বলেননি।

২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্যাস সংযোগের আবেদন করেন পশ্চিম বাকলিয়ার নিরাপদ আবাসিক এলাকার বিষ্ণুপদ দত্ত। প্রাথমিকভাবে তিনি গ্যাস সংযোগ আবেদনের জন্য ২ লাখ ৭০ হাজার ৮০৯ টাকা প্রদান করেন। পরে আপগ্রেডেশনের কাজ বলে ২০১৫ সালের মে মাসে আরও ৫ হাজার ১৫ টাকা আদায় করেন গ্যাস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত গ্যাসের লাইন দেয়ার নাম নিশ্বাসও নেননি কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি।

হাসান বানু নামে আরেক গ্রাহক জানান, টাকা জমা নিয়ে সব প্রক্রিয়া শেষ করেও গ্যাস সংযোগ দিচ্ছে না কেজিডিসিএল। আজ দেবে-কাল দেবে বলে সময় নষ্ট করছেন তারা। নতুন সংযোগ না দিলেও আমরা যারা পুরাতন গ্রাহক আছি তাদের সংযোগ দেওয়া উচিত। সংযোগ না দিলে রাস্তা কাটিংসহ বিভিন্ন পর্যায়ে খরচ হওয়া গ্রাহকদের টাকাগুলো ফিরিয়ে দেবে কে? সরকারি কোষাগারে টাকা গেলে তো তা আর সহজে ফেরত আসেনা। এর আগে আমরা সংবাদ সম্মেলন, প্রতিবাদ সভা ও মিছিল করেছি। যার ফলাফল পেয়েছি শূণ্য।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে কিছু গ্রাহক দাবী করছেন, কর্ণফুলী গ্যাসের কিছু কর্মকর্তা সিলিন্ডার গ্যাস কোম্পানির সাথে আঁতাত করে আবাসিকে গ্রাহকদের সংযোগ দিচ্ছেন না। এতে করে গ্রাহকদের বাধ্য হয়ে এলপিজি গ্যাস কিনতে হচ্ছে। আবার এলএনজি গ্যাস আসলে এ সমস্যা সমাধান হওয়ার কথা থাকলেও তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গ্রাহকরা।

এদিকে যারা গ্যাস সংযোগ দেয়ার জন্যে ঠিকাদারীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তারাও আছে বেহাল দশায়। কোন কাজ করতে না পারাতে তাদেরও মানবেতর জীবন পার করতে হচ্ছে।

কথা হয় ঠিকাদার ও গ্রাহক ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলি উল্লাহ হক’র সাথে। তিনি সিভয়েসকে জানান, শিল্প প্রতিষ্ঠানে যদি গ্যাসের সংযোগ দিতে পারে তাহলে আবাসিকে দিলে সমস্যা কোথায়? আগে তো মানুষদের বাঁচতে হবে। আমরা কোথায় যাবো। আমাদের কিছু সদস্য চুলার কাজের জন্য টাকা নিয়েও তো বেকায়দায় পড়ে গেছে। টাকা ফিরিয়ে দেয়ার ওই মুখও তো নেই তাদের। এর একটা সমাধান করা দরকার। আবার গ্যাস না দিলেও তো কিছু গ্রাহক অবৈধ লাইন ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে। এতে তো সরকার প্রতিনিয়ত রাজস্বও হারাতে চলেছে।

কীভাবে রাজস্ব হারাবে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ধরুন আপনার দ্বিতল ভবনের জন্য একটি লাইন নিয়েছেন, বর্তমানে আপনি ভবনটি পাঁচ তলা করলেন। কিন্তু গ্যাস কর্তৃপক্ষ তো আপনাকে আর সংযোগ দিচ্ছে না। তখন ভবনের মালিকরা কি করছে, কোন অবৈধ মিস্ত্রি দিয়ে তারা কাজ করিয়ে নিচ্ছে। এতে তো সরকার রাজস্বও হারাচ্ছে।

কেজিডিসিএল ঠিকাদার ও গ্রাহক ঐক্য পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক এম আলী নেওয়াজ বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রামে এলএনজি গ্যাস মিলিয়ে গ্যাসের পর্যাপ্ত প্রবাহ রয়েছে। কিন্তু সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বলে গ্যাস সংযোগ প্রদান করছেন না তারা। এখন আমার প্রশ্ন হলো, টাকা নেয়ার অনেকদিন পরে সরকারি নিষেধাজ্ঞা আসে। তাহলে কোন নোটিশ এবং কথা বার্তা ছাড়া কিভাবে সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। আবার ২৫ হাজার আবাসিক গ্যাস সংযোগ প্রদান করা হলে মাত্র ৪ মিলিয়ন গ্যাস ব্যয় হবে। যা বর্তমান গ্যাস প্রবাহে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

তিনি আরও বলেন, কিছুদিন আগে আমরা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে স্মারকলিপি পাঠিয়েছি। ওখানে সব কথা বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছি। তার কয়েকদিন পরে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সচিব মহোদয়ের সাথে কথা বলেছি। তিনিও জানালেন আমরা মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি। কিন্তু আমাদেরকে তারা কিছু জানায়নি।

অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু কুচক্রী মহলের কাজ হচ্ছে অবৈধ লাইন পাইয়ে দেয়া। তারা কিছু কর্মকর্তার সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে সংযোগ প্রদান করেন। কিন্তু যারা সত্যিকারের আবেদন করেছে তারা গ্যাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

চট্টগ্রাম মহানগরে আবাসিক গ্যাস সংযোগ আছে ৬ লক্ষ গ্রাহকের। তবে এ ব্যাপারে কোন তথ্য দিতে রাজি হননি মহাব্যবস্থাপক (বিপনন) প্রকৌশলী মো. আজিজুল হক। উনার কার্যালয়ে প্রবেশ করলে উনি ব্যস্ত আছেন এবং দিতে পারবে না বলে প্রতিবেদককে জানিয়ে দেন। 

এ ব্যাপারে কেজিডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) ফিরোজ খান বলেন, সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে চার-পাঁচ বছর ধরে গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন আছে। আমরা এ নিয়ে অনেকবার জানিয়েছি। সরকারের নির্দেশনা ছাড়া তো আমরা সংযোগ দিতে পারি না। মন্ত্রণালয় থেকে যেভাবে নির্দেশনা দিবে আমরা সেভাবে কাজ করে যাবো।

গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়ার কোন চিন্তাভাবনা আছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় হা বা না কোন কিছুই আমাদেরকে এখনো জানায়নি। যদি টাকা ফেরত দেয়ার কথা বলে দেয় তাহলে অবশ্যই আমরা টাকা দিয়ে দিবো।

এলএনজি’র বিষয়ে তিনি বলেন, এলএনজি’র দাম অন্যান্য গ্যাসের তুলনায় বেশি। আমরা শুধুমাত্র বাণিজ্যিকভাবে দেয়ার জন্যে এলএনজি নিচ্ছি। আবাসিকে এলএনজি দিলে অন্যান্য গ্যাস কোম্পানি আর এলএনজি পাবে না। মোটামুটি ব্যাকআপ দেয়ার জন্যে এলএনজি নেয়া হচ্ছে।

সিভয়েস/এএস

সিভয়েস প্রতিবেদক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়