Cvoice24.com


খাগড়াছড়িতে সেভেন মার্ডার : এক বছরেও হয়নি চার্জশিট

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১৮ আগস্ট ২০১৯
খাগড়াছড়িতে সেভেন মার্ডার : এক বছরেও হয়নি চার্জশিট

২০১৮ সালে আজকের দিনে ভাঙেনি সব মানুষের ঘুম এবং খুলেনি সব দোকানপাট। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে জেলাশহরের স্বনির্ভর এলাকায় ‘ইউপিডিএফ’ সমর্থিত তিনটি সহযোগী সংগঠনের নির্ধারিত সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিবিরোধী সমাবেশের প্রস্ততি চলছিল। এরইমধ্যে কমান্ডো স্টাইলে সশস্ত্র হামলা চালানো হয় তিনদিক থেকে। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় ছয়জন মানুষ। এর একটু পরই সন্ত্রাসীরা হামলা চালান পেরাছড়া এলাকায় সমাবেশমুখী একটি যাত্রাবাহী পিকআপে। সেখানে মৃত্যু ঘটে আরও একজনের।
সেদিনের ঘটনায় নিহতরা হলেন, ইউপিডিএফ সমর্থিত পিসিপি খাগড়াছড়ি শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তপন চাকমা, সহ-সাধারণ সম্পাদক এলটন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুবফোরামের সহ-সভাপতি পলাশ চাকমা, মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য সহকারী জীতায়ন চাকমা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র রূপন চাকমা, খাগড়াছড়ি সদরের পেরাছড়া এলাকার বাসিন্দা শন কুমার চাকমা ও বিএসসি প্রকৌশলী পানছড়ি উপজেলার উল্টাছড়ি গ্রামের ধীরাজ চাকমা। আহতরা হলো, পিসিপি কর্মী সোহেল চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কর্মী সমর চাকমা ও সখীধন চাকমা।

দুর্বৃত্তের এলোপাথাড়ি ব্রাশ ফায়ারে প্রাণ হারান আরো তিনজন নিরীহ ব্যক্তি। এরমধ্যে টেক্সটাইল প্রকৌশলী ধীরাজ চাকমা ঢাকা থেকে নৈশবাসে নেমে স্বনির্ভরস্থ পানছড়ি স্টপেজে গাড়ির জন্য অপেক্ষারত ছিলেন। মেধাবী এই প্রকৌশলীর বাড়ি পানছড়ি উপজেলার উগলছড়ি গ্রামে। মূলত: ঈদ-উল-আযহার বন্ধে পরিবার ও স্বজনদের সাথে সময় কাটানোর জন্য তিনি বাড়ি ফিরছিলেন।
নিহত রুপন চাকমা স্বনির্ভর এলাকার বাসিন্দা সুগত চাকমার সন্তান। দীঘিনালা ডিগ্রি কলেজের উন্মুক্ত শাখায় উচ্চ মাধ্যমিক অধ্যয়রত এই ছাত্র প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ফটোকপি করার জন্য বাসা থেকে বেরোবার মাত্র ২০ মিনিটের মাথায় লাশ হয়ে যান।
আর মহালছড়ি উপজেলায় স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে কর্মরত জিতায়ন চাকমা ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন স্বনির্ভর বাজার থেকে শাক-সবজি কেনার জন্য। সন্ত্রাসীদের বিষাক্ত বুলেট তার বুক ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।

সেই ঘটনায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ-ই যখন মামলা করতে রাজী হচ্ছিল না তখন খাগড়াছড়ি সদর থানার কর্মকর্তা গৌতম চন্দ্র দে বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ১০/১৫ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। সেসময় খাগড়াছড়ির তৎকালীন পুলিশ সুপার আলী আহম্মদ খান সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছিলেন, ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে অপরাধীদের চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু তিনি বদলি হবার পর পর মামলাটিও চলে যায় ‘পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)’-এর হাতে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মামলাটি এখনও তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে। তবে নিহতদের স্বজনদের দাবি, তাদের কাছে ঘটনার পর পর প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকে খোঁজ খবর নিলেও দীর্ঘ সময় ধরে কারো কোনো দেখা নেই।
প্রকাশ্যে দিনে-দুপুরে প্রতিপক্ষের ব্রাশফায়ারে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের স্বনির্ভর এলাকায় পিসিপি নেতা ও সরকারি চাকরিজীবীসহ নিহত ৭ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার এক সপ্তাহ পর ৩ সদস্যের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছিল।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সেই তদন্ত কমিটি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কমিশনের সদস্য ও তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক নুরুন নাহার ওসমানি (সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ), সদস্য বাঞ্চিতা চাকমা (সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ) ও তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব এম রবিউল ইসলাম (উপ-পরিচালক)। এতে পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রশাসনের নেতৃবৃন্দরা উপস্থিত ছিলেন।
অবশ্য এর আগে আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির তদন্ত রিপোর্টে ঘটনার জন্য সাথে জড়িতদের সনাক্ত করা না গেলেও এই ধরনের ঘটনার কারণ এবং প্রতিরোধে কিছু পরামর্শমূলক সুপারিশ করা হয়েছিল।

খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের নেতা নির্মলেন্দু চৌধুরী মনে করেন, অবৈধ অস্ত্রের কারণেই একের পর এক প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে।
তিনি আঞ্চলিক দলগুলোকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে হত্যা-সংঘাত ও চাঁদাবাজি বন্ধ করে সরকারের চলমান উন্নয়নে সম্পৃক্ত হবারও আহ্বান জানান।

‘সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র)-খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি ও নারীনেত্রী নমিতা চাকমা বিগত ছয় মাসে খুনোখুনি বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, জেলা ও উপজেলা শহরে দিনে-দুপুরে জনপ্রতিনিধি-ছাত্র-যুবকদের প্রাণহানির ঘটনার পর থেকেই আমরা শংকিত। সাধারণ নিরীহ মানুষও হত্যার শিকার হচ্ছে। পাহাড়ে জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের পক্ষেই সম্ভব। সরকার ইচ্ছে করলেই এসব গুরুতর অপরাধ বন্ধ করতে পারে। আর যদি এটিকে পাহাড়িদের অভ্যন্তরীন সমস্যা বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়, তাহলে তা কারোর জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।

‘সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’ খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এড. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, কোন মৃত্যুই কাম্য নয়। কিন্তু পাহাড়ে প্রতিনিয়ত হত্যা বেড়ে চলেছে। একের পর এক সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে না বলেই সন্ত্রাসের প্রবণতা বেড়ে চলেছে। প্রশাসনের উচিত সব স্টেকহোল্ডারদের সাথে বসে এই শ্বাসরুদ্ধকর এবং অনিরাপদ অবস্থার উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা।

খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মোহা. আহমার উজ্জামান বলেন, মামলাটি পুলিশের বিশেশায়িত তদন্ত সংস্থা ‘পিবিআই’-এর হাতে। এ ঘটনার পর থেকেই যৌথবাহিনী পুরো জেলায় অপরাধ দমনে যথেষ্ট কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। বেশ কয়েকজন সন্ধিগ্ধ অপরাধীকে আটক করা হয়েছে। ভৌগলিক দুর্গমতা এবং জনসচেতনতার অভাবে সব অপরাধীদের আটক করতে সময় লাগছে। তবে হত্যাকাণ্ডসহ অন্যসব জঘন্য অপরাধের ঘটনায় জড়িত অপরাধীরা কোনো দিনই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত থেকে পার পাবে না।

খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলাম জানান, এই ঘটনার পর পরই প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ উদ্যোগে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী প্রশাসন এগোচ্ছে। ফলে জেলায় গত এক বছরে এ ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা অনেক কমে এসেছে।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর ইউপিডিএফর দলছুট কিছু নেতা জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের সাথে মিলে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ করে। এর পর থেকে পাহাড়ে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা ভ্রাতৃঘাতী শুরু হয়। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর আত্মপ্রকাশ করে চুক্তিবিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফ। চুক্তি পরবর্তী ২২ বছরে  ৫ শ’র মতো নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণ বিবদমান সশস্ত্র পক্ষগুলোর গুলি ও হামলায় নিহত হয়েছে।

সিভয়েস/এএইচ

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়