Cvoice24.com


সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যা ঘটেছিল

প্রকাশিত: ১৬:৩৯, ১৪ আগস্ট ২০১৯
সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যা ঘটেছিল

ফাইল ছবি।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সুবেহ সাদিকের সময় যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নিজ বাসভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে বুলেটের বৃষ্টিতে ঘাতকরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, তখন যে বৃষ্টি ঝরছিল, তা যেন ছিল প্রকৃতিরই অশ্রুপাত। ভেজা বাতাস কেঁদেছে সমগ্র বাংলায়। ঘাতকদের উদ্যত অস্ত্রের সামনে ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল শোকে আর অভাবিত ঘটনার আকস্মিকতায়। কাল থেকে কালান্তরে জ্বলবে এ শোকের আগুন। ১৫ আগস্ট শোকার্দ্র বাণী পাঠের দিন, স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহাদাতবার্ষিকী।

সেই রাতে যা ঘটেছিল :

বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি আড়াই তলা। দুই রুমবিশিষ্ট দোতলায় ছিলেন তিনি। বিপথগামী হিংস্র সেনাসদস্যদের হামলার খবর পেয়েই তিনি নিজ কক্ষ থেকে ইন্টারকম টেলিফোনে তার ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মুহিতুল ইসলামকে বলেন, 'সেরনিয়াবাতের (তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত) বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন লাগা।' কিন্তু কন্ট্রোল রুমের লাইনে সংযোগ হচ্ছিল না। একটু পরে বঙ্গবন্ধু নিজেই তার কক্ষের দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন।

এ সময় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কথায় গৃহকর্মী আবদুর রহমান শেখ রমা নিচে নেমে বাড়ির প্রধান ফটকের বাইরে আসেন। দেখেন, সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। আবদুর রহমান শেখ রমা বাড়ির ভেতরে ফিরে দেখেন, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু নিচে অভ্যর্থনা কক্ষে নেমে এসেছেন। আ ফ ম মুহিতুল ইসলামকে বলছেন, 'পুলিশ কন্ট্রোল রুমে লাগাতে বললাম। লাগালি না?'

আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম জানান, তিনি চেষ্টা করেও লাইন পাচ্ছেন না। একপর্যায়ে গণভবন এক্সচেঞ্জের লাইন পাওয়া গেলেও অপর প্রান্ত থেকে কেউ কথা না বলায় বঙ্গবন্ধু নিজেই টেলিফোন হাতে নিয়ে বলেন, 'আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি।' কিন্তু জাতির পিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই একঝাঁক গুলি বাড়িটির দক্ষিণ দিকের জানালার কাচ ভেঙে অফিস কক্ষের দেয়ালে বিদ্ধ হয়। এরপর অবিরত গুলি আসতেই থাকে।

এ সময় বঙ্গবন্ধু টেবিলের ওপর শুয়ে পড়ে আ ফ ম মুহিতুল ইসলামকেও হাত ধরে কাছে টেনে শুইয়ে দেন। গুলি একটু থেমে এলে দোতলা থেকে কাজের ছেলে মোহাম্মদ সেলিমের এনে দেওয়া পাঞ্জাবি ও চশমা পরে গাড়ি রাখার বারান্দায় আসেন বঙ্গবন্ধু। তিনি পাহারারত সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, 'এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছ?' এরপর দোতলায় নিজের কক্ষে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান।

এরপর বঙ্গবন্ধু তার মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল উদ্দিনকে ফোনে বলেন, 'জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোক আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।' তিনি সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহকেও ফোন করে বলেন, 'সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে (শেখ কামাল) বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।' এর কিছুক্ষণ পরই শহীদ হন জাতির পিতা।

এর আগে মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ ও কর্নেল জামিল উদ্দিনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর বন্ধ দরজা খুলে বাইরে আসেন অকুতোভয় বঙ্গবন্ধু। ওই সময়ে মেজর এ কে এম মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে বিপথগামী সেনাসদস্যরা তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে রাখে। একপর্যায়ে তারা বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে যেতে থাকে। ওই সময় সিঁড়িবারান্দায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘাতকদের তর্ক-বিতর্ক হয়। মেজর এ কে এম মহিউদ্দিনকে বঙ্গবন্ধু চড়া সুরে ধমক দিয়ে এসবের কারণ জানতে চান।

বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বপূর্ণ আচরণে খুব ঘাবড়ে যায় মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন। আক্রমণও ঝিমিয়ে আসে। এ কে এম মহিউদ্দিন দুর্বল কণ্ঠে রাষ্ট্রপতিকে বন্দি করে বাইরে নিয়ে যেতে চায়। ওই সময় মেজর বজলুল হুদা এসে ঔদ্ধত্যপূর্ণ স্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলে। রাষ্ট্রপতিকে নিচে নেমে আসতে বাধ্য করে। বঙ্গবন্ধু সিঁড়িবারান্দার মুখে এসে দাঁড়ান। ঠিক সে সময়ই মেজর নূর চৌধুরী সিঁড়ির গোড়ায় উপস্থিত হলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। একজন ঘাতক উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে, 'কেন সময় নষ্ট করা হচ্ছে?'

এ সময় বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও স্বাভাবিক কণ্ঠে ঘৃণিত খুনি সেনাসদস্যদের কাছে জানতে চান, 'তোরা কী চাস? তোরা কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে? কী করবি? বেয়াদবি করছস কেন?' এরপর তিনি সিঁড়ির কয়েক ধাপ নামার পরই নিচের দিক হতে সাত থেকে আট ফুট দূরে অবস্থানরত দুই ঘৃণিত ঘাতক মেজর নূর চৌধুরী ও মেজর বজলুল হুদার স্বয়ংক্রিয় স্টেনগান থেকে একের পর এক বেরিয়ে আসে ১৮টি তাজা বুলেট। সিঁড়ির ধাপে গড়িয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে চলে সিঁড়ি বেয়ে।

সিঁড়ির ধাপেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানেই পড়ে থাকে তার রক্তাক্ত মৃতদেহ। মৃত্যুর পরও বঙ্গবন্ধুর চেহারা ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, সৌম্য ও শান্ত। বুকের অংশটুকু ছিল ভীষণভাবে রক্তাক্ত। বাঁ হাতটা ছিল বুকের ওপর ভাঁজ করা। বুলেটের আঘাতে তর্জনীটা ছিঁড়ে চামড়ার সঙ্গে ঝুলছিল। ব্রাশফায়ারে তার বুক ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল। পেট, পা, হাতসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিল গুলিবিদ্ধ। একটি গুলি মাথার পেছনে বিঁধে ছিল। নয়টি গুলি চক্রাকারে বুকের নিচে লেগে ছিল। খুনিদের পৈশাচিক নির্মমতা-বর্বরতা ছিল চরম পর্যায়ের। মৃত্যু নিশ্চিত করার পরও তারা বঙ্গবন্ধুর দু'পায়ের গোড়ালির রগ কাটে। ওই সময়ে বঙ্গবন্ধুর পরনে ছিল সাদা গেঞ্জি, পাঞ্জাবি এবং সাদা-কালো চেক লুঙ্গি। পাঞ্জাবির পকেটে ছিল চশমা।

বঙ্গবন্ধু ভবন সৈন্য পরিবেষ্টিত হলে আবদুর রহমান শেখ রমা তিনতলায় গিয়ে শেখ কামালকে ঘুম থেকে উঠিয়ে সেনা আক্রমণের খবর দেন। সুলতানা কামাল খুকু তার স্বামী শেখ কামালের পিছে পিছে দোতলা পর্যন্ত আসেন। শেখ কামালের রুম থেকে দোতলায় এসে আবদুর রহমান শেখ রমা সেনা হামলার কথা শেখ জামালকে জানান। তিনি তার নবপরিণীতা স্ত্রী পারভীন জামাল রোজীকে সঙ্গে নিয়ে মা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের রুমে আসেন।

শেখ কামাল ওপর থেকে নিচে নেমে বলেন, 'আর্মি ও পুলিশ ভাই, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন।' তখন মেজর বজলুল হুদা তিন থেকে চারজন কালো ও খাকি পোশাকধারী সশস্ত্র সেনাসদস্য পরিবেষ্টিত হয়ে শেখ কামালের পায়ে গুলি চালায়। শেখ কামাল নিজের পরিচয় দিলে সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় তাকে। ক'জন সেনাসদস্য গুলি ছুড়তে ছুড়তে তখন ওপরে উঠে আসে।

ওই সময়ে জাতির পিতার উচ্চ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। অতঃপর অসংখ্য গুলির শব্দ শোনা যায়। দোতলায় নারীদের আহাজারি-আর্তচিৎকার। তার পর নেমে আসে সুনসান নীরবতা। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তখন সুলতানা কামাল খুকু, শেখ জামাল, পারভীন জামাল খুকু, শেখ রাসেল ও বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ আবু নাসেরকে নিয়ে বাথরুমে অবস্থান নেন। আবদুর রহমান শেখ রমাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে জানান। এ সময় সেনাসদস্যরা দরজা ভাঙার চেষ্টা করলে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব 'মরলে সবাই একসঙ্গে মরব'- এ কথা বলে দরজা খুলে দেন।

লে. কর্নেল আজিজ পাশাসহ বিপথগামী সেনাসদস্যরা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ শেখ আবু নাসের, শেখ রাসেল ও আবদুর রহমান শেখ রমাকে সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে যায়। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ দেখে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব অঝোরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। চিৎকার দিয়ে বলেন, 'আমি যাব না। আমাকে এখানেই মেরে ফেল।' কিন্তু সৈন্যরা তাকে দোতলায় তার কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানেই লে. কর্নেল আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের গুলিতে শহীদ হন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

এর পর ঘাতকের বুলেটের আঘাতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন শেখ জামাল, সুলতানা কামাল খুকু ও পারভীন জামাল রোজী। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নিথর দেহটি দরজার পাশে পড়ে থাকে। বাঁ দিকে পড়ে থাকে শেখ জামালের মৃতদেহ। পারভীন জামাল রোজীর মুখে গুলি লাগে। রক্তক্ষরণে বিবর্ণ হয়ে যায় সুলতানা কামাল খুকুর মুখ। এর পর সৈন্যরা শেখ আবু নাসের, শেখ রাসেল ও আবদুর রহমান শেখ রমাকে নিচে নামিয়ে আনে।

তখন শেখ আবু নাসের সৈন্যদের বলেন, 'আমি তো রাজনীতি করি না। কোনোরকম ব্যবসা করে খাই।' জবাবে পাহারারত এক সৈন্য বলে, 'শেখ মুজিব ইজ বেটার দেন শেখ নাসের।' এ সময় শেখ আবু নাসেরকে পাশের কক্ষে গিয়ে বসার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বলা হয়, তাকে কিছুই করা হবে না। অথচ তাকে বাথরুমে নিয়ে গুলি করে খুন করা হয়। মৃত্যুর আগে তিনি পানি চেয়েও পাননি।

পরে ওপর থেকে ভীত-বিহ্বল শিশু শেখ রাসেলকে নিয়ে আসে আরেক দল সেনাসদস্য। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকা শেখ রাসেল তখন আ ফ ম মুহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে জানতে চায়, 'ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো।' তখনই এক সৈন্য শেখ রাসেলকে আলাদা করে ফেললে সে তার মা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে যাওয়ার আকুতি জানায়। এক সৈন্য তাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার মিথ্যা প্রবোধ দিয়ে দোতলায় নিয়ে যায়।

সেখানে মায়ের রক্তমাখা মরদেহ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে শেখ রাসেল মিনতি করে, 'আমাকে হাসু (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডাকনাম) আপার কাছে পাঠিয়ে দাও।' কিন্তু সৈন্যদের মন গলেনি। বিন্দুমাত্র দেরি না করে গুলিতে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা। গুলিতে শেখ রাসেলের চোখ বেরিয়ে যায়। মাথার পেছনের অংশ থেঁতলে থাকে। নিথর দেহটি পড়ে থাকে সুলতানা কামাল খুকুর লাশের পাশে। শেখ রাসেল ছিল ঘাতকের শেষ শিকার। সে শহীদ হওয়ার পর উদ্ধত কণ্ঠে সৈন্যরা তাদের কর্মকর্তাদের খবর দেয়, 'স্যার, সব শেষ।'

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ইতিহাসের নৃশংসতম ওই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশে কারফিউ শুরু হয়। সামরিক আইন জারি করা হয়। দীর্ঘ একুশ বছর গণতন্ত্র ও সংবিধান ভূলুণ্ঠিত হয়। এক সাগর রক্তে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের লাল টকটকে ও গাঢ় সবুজের মানচিত্র খামচে ধরে পুরনো শকুনেরা।

[এ প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রয়াত সাংবাদিক বেবী মওদুদ সম্পাদিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের প্রকাশনা '১৫ আগস্ট ১৯৭৫' গ্রন্থের সহায়তা নেওয়া হয়েছে।]

-সিভয়েস/এসএ

সরোজ আহমেদ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়