Cvoice24.com


খাগড়াছড়িতে ৩১ কোটি টাকার সরবরাহ প্রকল্পে পানির সংকট

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ১০ আগস্ট ২০১৯
খাগড়াছড়িতে ৩১ কোটি টাকার সরবরাহ প্রকল্পে পানির সংকট

খাগড়াছড়িতে ৬৬টি হাট-বাজারে ৩১ কোটি টাকার পানি সরবরাহ প্রকল্পে পানির সংকট মেটেনি। উল্টো প্রকল্পের মেয়াদ শেষ না হওয়ার আগেই জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে উঠেছে ভয়াবহ অনিয়মের অভিযোগ। 

২০১৫-১৬ অর্থবছরে নেয়া এই প্রকল্প শেষ হয়েছে চলতি বছরের ৩০ জুন। অনিয়মে ভরা সেই কাজকে জায়েজ করতে তিনবছর মেয়াদি প্রকল্পের মেয়াদ ও অর্থ বাড়ানো হয়েছে আবারও। প্রথম পর্যায়ে ৫৬টি এবং দ্বিতীয় ধাপে আরো ১০টি বাজার এলাকায় এই প্রকল্প নেয়া হয়। প্রকল্পের আওতাধীন অধিকাংশ বাজার এলাকায় ভয়াবহ অনিয়মের ফলে বিশুদ্ধ পানি  থেকে বঞ্চিত স্থানীয় বাসিন্দারা। এমনকি এই ভরা বর্ষাতেও মিলছে না পানি। 
প্রথম ধাপের ৫৬টি বাজারে দাপ্তরিক কাগজে-পত্রে প্রকল্পের শেষ দেখানো হলেও পানির দেখা মিলছে কমপক্ষে ৩০টি বাজারে। আবার যেসব বাজারে পানির দেখা মিলেছিল, নিম্মামানের কাজের কারণে সেগুলোও এখন বেশিরভাগ অকেজো হয়ে পড়েছে।

সরেজমিনে জানা যায়, প্রকল্পের  আওতায় গভীর নলকূপ স্থাপন করে পানি সরবরাহ লাইন চালু করার পর  কিছুদিনের মধ্যে  তা বন্ধ হয়ে গেছে। কাজের গুণগত মান নিয়েও স্থানীয়দের ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নকৃত প্রকল্পের  বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। 

জনস্বাস্থ্য প্রকৗশল সূত্রে জানা যায়,খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলায় গুরুত্বপূর্ণ হাট-বাজার এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপন প্রকল্প নেয় খাগড়াছড়ি জনস্বাস্থ্য বিভাগ। প্রকল্পের আওতায় খাগড়াছড়ি জেলা সদর, মাটিরাঙা, রামগড়, মানিকছড়ি, গুইমারা, মহালছড়ি, দীঘিনালা, লক্ষীছড়ি ও পানছড়ি উপজেলার ৬৬ টি বাজারে গভীর নলকূপ স্থাপন করার কথা। 
কিন্তু প্রকল্পের প্রথম ধাপের তিন বছর শেষে দেখা গেছে, বেশিরভাগ হাটবাজারে গভীর নলকূপ বসানোর আগেই দেখা মিলেছে সরবরাহ পাইপ আর ট্যাংকের। নিম্মমানের সামগ্রী ব্যবহারের ফলে পানি সরবরাহ লাইনও অকেজো হয়ে পড়েছে। আবার কোথাও পাইপ লাইন বসানো হলেও  তা দিয়ে মিলছে না পানির দেখা। অনিয়ম ঢাকতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ চলতি অর্থবছরে তড়িগড়ি করে অনিয়মে ভরা সেই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে আরো অর্থ নিয়ে আসে মন্ত্রণালয় থেকে।  

দীঘিনালার মধ্য বোয়ালখালী বাজারে বাজারে পানি সরবরাহের লক্ষে ছয়টি পানির ট্যাপ (পয়েন্ট) বসানো হয়।  পানি সরবরাহ বন্ধ থাকায় ৬টি পয়েন্টই নষ্ট হয়ে গেছে।  একবছর আগে গভীর নলকূপ থেকে পানি সরবরাহের জন্য সংযোগ লাইন স্থাপন করা হলেও একদিনও পানি পাননি ব্যবসায়ীরা। সেই বাজারের মসজিদ এলাকাতেও মিলছে না সুপেয় পানি।

মুসল্লী নুরুজ্জামান বলেন, জনস্বাস্থ্যের স্থাপন করা গভীর নলকূপের পানি যদি দুর্গন্ধে ভরা হয় তা কিভাবে ব্যবহার করবো? তিনি অভিযোগ করেন, বিবর্ণ সেই পানি কারো কাজে আসেনি শুরু থেকেই। পানি সরবরাহের জন্য স্থাপিত নিম্মমানের সবকটি পানির  ট্যাপ (পয়েন্ট) এখন নষ্ট। শুরুর দিকে বিষয়টি ঠিকাদারকে অবহিত করলেও তা তিনি পাত্তা দেয়নি।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আবু তালেব জানান, সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা আর গাফিলতির কারণে ঠিকাদার কম গভীরতায় নলকূপ স্থাপন করেন। ঠিকাদারকে বিষয়টি জানালেও তিনি তা শুনেননি।  ফলে সরকারি টাকা খরচ করে গভীর নলকূপ স্থাপন করলেও আমরা কোনদিন পানি পাইনি। একই উপজেলার জামতলী এলাকায় স্থানীয়রা শুধু পানির পাইপ লাইন দেখেছেন, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে পানির দেখা পাচ্ছেন না।
একই অবস্থা খাগড়াছড়ির জেলা সদরের ঠাকুরছড়া, মহালছড়া, গুগড়াছড়ি বাজারেও।

এসব বাজারে সরেজমিনে দেখা গেছে, পানি সরবারাহের অধিকাংশ পাইপ ফেটে গেছে। নিজেদের টাকায় মেরামত করলেও পানি সরবরাহ ঠিক থাকে না। প্রায় এক বছর আগে এখানে পাইপ বসানো হলেও বিশুদ্ধ পানির দেখা মিলছে না।  আবার কোথাও কোথাও পানি সরবরাহের জন্য অর্থ আদায় করা হচ্ছে। তবে অর্থ আদায়ে সাথে অধিদপ্তরের কেউ জড়িত নয় বলে জানিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।

সরকারের বিপুল টাকার এই প্রকল্পের সুফল থেকে বঞ্চিত স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এটি সরকারি অর্থ লুঠপাটের জন্যই করা হয়েছে। ঠিকাদার যখন কাজ করছেন তখন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি-হেডম্যান অথবা বাজারের কারো সাথে কোন কথা বলেননি। জনস্বাস্থ্য বিভাগের কাউকেও বাজার এলাকার মানুষ দেখেনি।

প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষেও পানি সরবরাহ চালু না হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিরা।

খাগড়াছড়ি সদর ইউপি চেয়ারম্যান আম্যে মারমা বলেন, জনস্বাস্থ্য  প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে হাট-বাজারে পানি সরবরাহ লাইন বসানোর পরও এলাকার মানুষ পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এলাকায় কোন বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই। কেন পাচ্ছে না তাও জানি না এবং কবে পাবে তাও জানি না।  

জেলা সদরের রাজবাড়ি এলাকায় স্থাপিত গভীর নলকূপ স্থাপন প্রকল্পের  ঠিকাদার স্বপন দেবনাথ বলেন, আমি কাজ শেষ করে বাজারের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে বুঝিয়ে দিয়েছি। তাদেরকে পানি সরবরাহ প্রকল্প সচল অবস্থায় বুঝিয়ে দিয়েছি। এখন সচল  না থাকলে কিছু বলার নেই।
অভিযোগ রয়েছে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অনিয়মের কারণে প্রকল্প মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তা মুখ থুবড়ে পড়েছে।

সম্প্রতি বরখাস্ত হওয়া খাগড়াছড়ি জনস্বাস্থ্য প্রকৗশল অধিদপ্তর এর নির্বাহী  প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) সোহরাব হোসেন জানান, প্রকল্পটি’র কাজ প্রায় শেষের পথে। যে সকল বাজারে নলকূপ স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে তা বাজারের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে কোথাও যদি বড় ধরনের সংস্কার করা প্রয়োজন হলে অধিদপ্তর তা করে দেবে।
তিনি অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয় এড়িয়ে  দাবি করেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও স্থানীয় বাসিন্দারা উপকৃত হবে।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী বলেন, মানুষ ও অন্যান্য  প্রাণির বেঁচে থাকার জন্য পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। হাট-বাজার এলাকার ক্রেতা-বিক্রেতা ও  স্থানীয় বাসিন্দাদের কথা চিন্তা করে পরিষদের উদ্যোগেই এই প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়। আর সেই প্রকল্পে সংঘটিত সকল অনিয়মের দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং ঠিকাদারকেই নিতে হবে।
তিনি জানান, শিগগির এ বিষয়ে অভিজ্ঞদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হবে। আর চলমান কাজের কী অবস্থা তাও খতিয়ে দেখা হবে।

সিভয়েস/আই
 

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়