Cvoice24.com

মিরসরাই ইকোনোমিক জোনে সাবেক সেনা সদস্যের লাশ উদ্ধার
কর্তৃপক্ষের দাবি খুন, তবে মুখ খুলছে না পুলিশ

প্রকাশিত: ১৩:৩২, ১৮ জুন ২০১৯
কর্তৃপক্ষের দাবি খুন, তবে মুখ খুলছে না পুলিশ

নিহত নান্নু মিয়ার লাশ উদ্ধার করছে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। ইনসেটে নিহত নান্নু মিয়া

মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পজোনে ওয়াহিদ কন্সট্রাকশনের স্টোর কিপার নান্নু মিয়া (সাবেক সেনা সদস্য) হত্যার রহস্য ৩ দিন পেরিয়ে গেলেও উদঘাটন হয়নি রহস্য। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়াহিদ কন্সট্রাকশনের দাবি নান্নু মিয়াকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। চায়না হারবার কোম্পানির কর্মীরা নান্নু মিয়াকে হত্যা করেছে বলে তাদের অভিযোগ। এ ঘটনায় সোমবার অজ্ঞাতনামা ২৫ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। ওয়াহিদ কন্সট্রাকশনের প্রজেক্ট ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় কারো নাম উল্লেখ করা না হলেও মামলার বিবরণে চায়না হারবার কোম্পানির কর্মীদের এ ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে।

এদিকে মামলা দায়েরের ২৪ ঘন্টা পার হয়ে গেলেও পুলিশ কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

কয়েকদিন ধরে নিখোঁজের পর গত রোববার (১৫ জুন) 'মিরসরাই ইকোনোমিক জোন' এলাকা থেকে সাবেক এক সেনা সদস্যের (ল্যান্স কর্পোরাল) নান্নু মিয়ার বিভৎস লাশ উদ্ধার করে পুলিশ ও ইকোনিক জোনের কর্মকর্তারা। নান্নু মিয়া ইকোনোমিক জোন এলাকার ওয়াহিদ কন্সট্রাকশনের স্টোর কিপার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ওয়াহিদ কন্সট্রাকশন বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চলে বেপজার ভূমি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত। তারা সমুদ্রে ড্রেজার স্থাপনের লক্ষ্যে বামনসুন্দর খাল দিয়ে নিজস্ব ইঞ্জিন বোট নিয়ে কোম্পানীর সাইট অফিস থেকে ড্রেজার পর্যন্ত যাতায়াত করতো। শুক্রবার (১৪ জুন) বিকেলে কোম্পানির বোট অপারেটর ফারুক বোট নিয়ে বামনসুন্দর খালের মুখে ঢোকামাত্র চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানীর কর্মীরা স্কেলেবেটর দিয়ে তাদের বোটটি ডুবিয়ে দিতে চায়। এসময় তারা ভয়ে তারা পালিয়ে চলে আসলে বোটটি চায়না হারবার কোম্পানির কর্মীরা নিয়ে যায়। পরে ফিরে এসে তারা বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানায়।

কোম্পানীর প্রকল্প পরিচালক মেজর (অব:) প্রকৌশলী রেজাউল করিম বিষয়টি মৌখিকভাবে জোরারগঞ্জ শিল্পজোন পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আবুল বাশারকে জানায়। পরে কোম্পানীর উপদেষ্টা আরিফ মোস্তফা বিষয়টি জানতে পেরে মেরিন ড্রাইভ প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক জুলফিকার তারেককে মুঠোফোনে জানান।

পরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক জুলফিকার তারেক কোম্পানীর উপদেষ্টাা আরিফ মোস্তফাকে জানান যে চায়না হারবার কোম্পানীর কর্মকর্তা জনৈক হেলেনের সাথে বোটটি ফেরত দেয়ার কথা হয়েছে। তার কথামত ড্রেজারের লোকজন নিয়ে বোট অপারেটরকে চায়না হারবার কোম্পানিতে পাঠান। তাদের সাথে সহকারী প্রকৌশলী ইসমাইল, নিহত নান্নু, হাবু, রুহুল, আমিন ও মোবারক যায়। তবে তিনি নিহত নান্নু যাওয়ার বিষয়টি জানতেন না। সেখানে নৌকাটি ফেরত না দিয়ে চায়না হারবারের ২০-২৫ জন সশস্ত্র হামলা চালায়। একপর্যায়ে ওয়াহিদ কন্সট্রাকশনের কর্মীরা সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং যে যার যার মতো করে ফিরে আসেন। কিন্তু পরে জানা যায়, সেখান থেকে চারজন ফিরে আসলেও নান্নু মিয়া ফিরেননি। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন ওই এলাকায় নান্নুকে খোঁজাখুঁজি করেও সন্ধান পাননি। রোববার সকাল ১০টায় পুলিশ নান্নুর লাশ উদ্ধার করে।

এ বিষয়ে ওয়াহিদ কন্সট্রাকশনের প্রকল্প পরিচালক মেজর (অব:) প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, তারা যখন বোর্ডের জন্য যায় তখনো নান্নুর সাথে মুঠোফোনে আমার সংযোগ ছিল। পরক্ষণে সাগরে পড়ায় আর যোগাযোগ করা হয় নি। তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, চায়না হারবার প্রতিষ্ঠানটি আমাদের এই প্রকল্পটির ঠিকাদারী নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা তা না পাওয়ায় বাংলাদেশী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করতে দিতে চায় না। এর আগেও তারা বাংলাদেশী অন্যান্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের উপর হামলা করেছে। এছাড়াও আমরা যে ড্রেজার দিয়ে কাজ করছি তা অত্যন্ত উন্নত মানের। আমাদের এই বোর্ডটি তারা এর পূর্বেও ৩ মাস আটকে রেখেছিল। পরে সমঝোতার মাধ্যমে ফেরত দেয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক জুলফিকারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি তারেক কোম্পানীর উপদেষ্টা আরিফ মোস্তফাকে বোট ফেরত আনতে যাওয়ার কথা জানান নি বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, বোট আটকের বিষয়টি আমি অবগত ছিলাম। তবে বোট ফেরত আনতে যাওয়ার ব্যাপারে আমার সাথে কারো কোন কথা হয়নি।

বোট আনতে যাওয়া ড্রেজারের কর্মী আনোয়ারের সাথে কথা হয় সিভয়েসের এ প্রতিবেদকের সাথে। আনোয়ার প্রতিবেদককে জানান, কোম্পানির নির্দেশে বোট ফেরত আনতে যায় তারা। সেখানে চায়না হারবার কোম্পানির কর্মীরা তাদের উপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এসময় তারা প্রাণভয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়। সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েও রেহাই পায় নি তারা। সেখানেও চায়না হারবার কোম্পানির কর্মীরা চোখে টর্চের আলো মারে। যাতে তারা সাঁতরে তীরে উঠতে না পারে। পরে ড্রেজারের পাইপ ধরে গাঁ ভাসিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকার সাহায্যে তারা ফিরে আসে। সেসময় নান্নুকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। ধারণা করা হচ্ছে, নান্নু সাঁতার কেটে গাঁ ভাসিয়ে সাগরে কিছুক্ষণ থাকার পর কোনসময় ঢেউয়ের টানে তীরবর্তী হলে চায়না হারবার কোম্পানির কর্মীরা তাঁকে আটক করে নিয়ে গিয়ে নির্মম অত্যাচার চালিয়ে হত্যা করে।

এদিকে ঘটনার পরপরই কর্মস্থল ছাড়তে শুরু করেছে ঘটনার শিকার ওয়াহিদ কন্সট্রাকশনের কর্মীরা। 

জোরারগঞ্জ থানার এসআই আবেদ আলী বলেন, ওয়াহিদ কন্সট্রাকশনের রেজাউল করিম সাহেব শনিবার মৌখিক ভাবে জানান তাদের একজন লোক নিখোঁজ রয়েছে। পরে আমরা ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিয়ে ঘটনাস্থলের আশপাশে তদন্ত করে কাউকে পাইনি। পরদিন নদী থেকে ওই ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করি।

এদিকে নিহত নান্নুর স্ত্রী মাবিয়া সুলতানা বলেন, ‘আমার স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ওয়াহিদ কন্সট্রাকশনের সাথে চায়না হারবারের শত্রুতার বলি হয়েছে আমার স্বামী। আমি স্বামী হত্যার যথোপযুক্ত বিচার চাই।’

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন পুলিশ সুপার নুরেআলম মিনা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চট্টগ্রাম উত্তর মশিউদৌলা রেজা, র‌্যাব ৭ এর চট্টগ্রাম এবং ফেনী ক্যাম্পের সদস্যরা। তবে ঘটনাস্থলে শ্রমিকদের মধ্য এখনো আতংক বিরাজ করছে। সেখানে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। 

এ বিষয়ে র‌্যাব ৭ এর ফেনী ক্যাম্পের স্কোয়ার্ডন লিডার সাফায়েত জামিল ফাহিম বলেন, খবর পেয়ে ফেনীর এবং চট্টগ্রাম ক্যাম্পের র‌্যাব সদস্যরা গতকাল ও আজ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। আমরা উভয় পক্ষের সাথে কথা বলে ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করছি।

জোরারগঞ্জ থানার ওসি তদন্ত এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক জানান, ওয়াহিদ কন্সট্রাকশনের পক্ষ থেকে বাদী হয়ে চায়না হারবারের অজ্ঞাত নামা ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এঘটনায় তদন্ত চলছে। আসামীদের সনাক্ত করণ চলছে। তবে এখনো কাউকে আটক করা যায় নি। তিনি আরো বলেন, অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে বর্তমানে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

গতকাল সোমবার সরেজমিনে ওই এলাকায় পরিদর্শনে গেলে স্থানীয়রা জানান, চায়না হারবারের বিরুদ্ধে এর আগেও স্থানীয় শ্রমিকদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এটি সরকারের অগ্রধিকার প্রকল্প হওয়ায় এবং এই প্রকল্প নিয়ে ইতিবাচক ধারণার কারণে বিষয়গুলো স্থানীয় পর্যায়ে সমাধান হয়েছে।

সিভয়েস/এএস

নাছির উদ্দীন

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়