Cvoice24.com


২৯ এপ্রিল: বিভীষিকার সেই রাত

প্রকাশিত: ১৩:০৪, ২৮ এপ্রিল ২০১৯
২৯ এপ্রিল: বিভীষিকার সেই রাত

একে একে পেরিয়ে গেছে ২৮ বছর। কিন্তু স্মৃতি থেকে মুছতে পারিনি বিভীষিকাময় সেই রাতটির কথা। মৃত্যুকে খুব কাছে থেকেই দেখেছিলাম রাতটিতে। রাতভর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আর বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা লোনা জলের সাথে সারা রাত যুদ্ধ করে ফিরে পেয়েছিলাম নতুন জীবন। বলছিলাম ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের মৃত্যুভয়াল সেই রাতের কথা। মহাপ্রলয়ের সেই রাতে চোখের সামনে দিয়ে পানির স্রোতের সাথে শেওলার মতো ভেসে যেতে দেখেছি নারী-পুরুষ আর শিশুর লাশ। ভাসতে থাকা মানুষের মৃত্যুপূর্ব গোঙানির শব্দ শুনেছি নিজ কানে।

আটাশ বছর আগের সেই দিনটি ছিল সোমবার। দু’দিন আগেই নিম্নচাপের সংকেত দিয়েছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। তখন চলছিল গ্রীষ্মের খরা। বিল খাল ফেটে চৌচির। রোববার রাতে নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, ৬নম্বর বিপদ সংকেতের পূর্বাভাষ। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ২৯ এপ্রিল সোমবার সকাল থেকেই আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। হালকা বাতাস বইছিল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল তবু ভ্যাপসা গরম কাটছিল না। দুপুরের পর থেকে আবহাওয়ার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। ক্রমশ বাড়তে থাকে বাতাসের গতি।

আমি তখন সদ্য ভর্তি হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র। ঘূর্ণিঝড়ের ঠিক আগের দিন শহর থেকে গিয়েছিলাম চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর গ্রামে আমাদের বাড়িতে। আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর আর আড়াই কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে ছিল শঙ্খ নদী। উপকূলীয় ভেড়িবাঁধের অবস্থাও ছিল খুবই নাজুক। ভাঙ্গনের কারণে অনেক জায়গায় বাঁধের অস্তিত্বই ছিলনা। বলতে গেলে এগারোটি গ্রাম নিয়ে গঠিত রায়পুর ইউনিয়নটি ছিল পুরোপুরি অরক্ষিত। তবে ঝড়-জলোচ্ছাস আর সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে নিত্য পরিচিত উপকূলীয় মানুষগুলোর মধ্যে এ নিয়ে কোন ধরণের ভীতি কিংবা আতঙ্কের লেশমাত্র ছিলনা।

মাটির দেয়াল আর উপরে টিন শেড দেয়া ঘরে ছিলাম আমি, মা ও ভাগিনী বিলকিস। বিকেল ৫টার পর থেকে বেড়ে যায় বাতাসের গতি, একই সঙ্গে বৃষ্টিও। সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসার পর শুরু হয় ঝড়ো হাওয়ার ঝাপটা। মাঝে মধ্যে দমকা হাওয়া বইছিল। মনে হচ্ছিল যেন টিনের চালা খুলে নিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার মধ্যেই আম্মা রান্নাবান্না শেষ করে ফেলেন। কিন্তু খাইনি কেউই। রাত ৯টার দিকে জেঠাত ভাই আবুল কালাম বৃষ্টির মধ্যে এসে আম্মাকে জানালেন ১০নম্বর বিপদ সংকেতের কথা। বললেন, সাইক্লোন শেল্টার কিংবা দূরে কোথাও চলে যেতে। কিন্তু আম্মা রাজি হলেন না। বললেন, বিল খাল শুকনো। পানি আসলে তা তো জমিনই চুষে নেবে। বাড়ির অনেকেই এসময় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেও আমরা সহ বাড়ির ১১টি পরিবারের বাকী সদস্যরা থেকে গেলেন নিজ নিজ ঘরে। বাইরে প্রচন্ড গতিতে বইছিল ঝড়। ঝড়ো হাওয়া আর বর্ষণের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না তখন। মনে মনে ভয় লাগলেও ভরসা দিচ্ছিলেন আম্মা। হারিকেন জ্বালিয়ে একটি রুমে এসে বসে রইলাম আমরা তিনজন। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল দমকা হাওয়া আমাদের ঘরটিই হয়তো উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

রাত বারোটার দিকে জানালা ফাঁক করে বাইরে টর্চ লাইটের আলো ফেলতেই দেখি ঘরের দেয়ালের কাছেই পানি। তড়ি ঘড়ি করে আম্মা আর ভাগিনীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। আমার ডাকাডাকিতে ৫ বছরের পুত্র বাদশা আর ৩ বছরের মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এলো জেঠাত ভাই ফয়েজ ও তাঁর স্ত্রী। এলেন জেঠাত বোন আয়েশা, তাঁর স্বামী সত্তরোর্ধ আছদ আলী ও মেয়ে ফাতেমা। বাড়ির উঠোনে তখন কোমর সমান পানি। সবাই মিলে পানি ভেঙ্গে ভিটের উত্তর পূর্ব পাশে থাকা খড়ের গাদায় গিয়ে উঠলাম। প্রথম দফায় শঙ্খের বাঁধ বিলীন হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব থেকে ধেয়ে আসা পানি দ্রুত বাড়ছিল তখন। এ অবস্থায় আমরা একে অপরকে ধরে একসঙ্গে জীবন বাঁচানোর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলাম । কিন্তু বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারিনি। রাত সাড়ে ১২টায় দ্বিতীয় দফায় বঙ্গোসাগর থেকে উঠে আসা জলোচ্ছাসের ঢেউয়ের আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে যায় খড়ের গাদাটি। আমার চোখের সামনেই অল্প খড়সহ বিচ্ছিন্ন হয়ে ভেসে গেলেন আম্মা ও ভাগিনী বিলকিস। তাঁদের ধরে রাখার কোন চেষ্টাই কাজে আসল না। একইভাবে একে একে ভেসে গেলেন আয়েশা ও তাঁর স্বামী আছদ আলী। ছেলে বাদশা আর মেয়ে মুন্নীকে কাঁধে নিয়ে খড় ধরে ভেসে গেলেন জেঠাত ভাই ফয়েজ। বাকী রইলাম আমি, ফয়েজের স্ত্রী ও ফাতেমা।

প্রাণের মায়া তখনো ছাড়িনি। হঠাৎ দক্ষিণ দিক থেকে একটি খালি চালা এসে ঠেকল খড়ের গাদা ও পাশ্ববর্তী রেইনট্রি গাছের সঙ্গে। আমরা তিনজনই তাতে উঠে পড়লাম। দশ মিনিটের মতো ওই অবস্থায় ছিলাম। এরপর হঠাৎ পানির প্রচন্ড স্রোতে আমাদের সহ চালাটি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগল পূর্ব দিকে। প্রায় আধ কিলোমিটার যাবার পর চালা থেকে ছিটকে পড়ে গেলাম আমি। মনে হলো এখানেই জীবন শেষ, বাঁচার আশা প্রায় ছেড়ে দিলাম। এমন সময় হঠাৎ ভেসে উঠলাম পানির উপরে। ঝড়ে ডাল পালা ভেঙ্গে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা কড়ই গাছ পেলাম সামনে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম গাছটি। এক একটি ঢেউ এসে চলে যাচ্ছিল মাথার উপর দিয়ে। গাছটি জড়িয়ে ধরে ঢেউয়ের ধাক্কার মুখে অনেক কষ্টে নিজেকে টিকিয়ে রাখছিলাম। ঢেউ যাবার পর মাথাটা কোনোভাবে পানির উপরে তুলে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম। গাছটির ডালপালা না থাকায় উপরে উঠারও কোন সুযোগ ছিলনা। তখন গভীর রাত। পানির নিচে ডুবে গেছে পুরো উপকূলীয় এলাকা। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। মনে হচ্ছিল যেন সাগর মাঝে ভাসছি আমি। ঘরের চালা, গাছ পালা, খড় কুটো ইত্যাদি স্রোতের টানে চলে যাচ্ছিল আমার কাছ দিয়েই। পানিতে ভাসতে থাকা এক মহিলাকে দেখলাম ঘোঙাতে ঘোঙাতে এসে ঠেকেছে একটু দূরে আরেকটি গাছের সঙ্গে। কিন্তু এ সময় গাছটি ধরে বাঁচার চেষ্টা করার মত শক্তিও সম্ভবত তার ছিলনা। কিছুক্ষণ পরে সেখানেই তাকে নিথর হয়ে ভাসতে দেখলাম। এভাবে অনেক আদম সন্তানের লাশ ভেসে যেতে দেখেছি খুব কাছে থেকে। এভাবে ঝড় আর ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করেই কাটে সারারাত।

রাত আনুমানিক তিনটার পর থেকে পানি কমতে শুরু করে। পানি কমে যাওয়ার পর সকাল ৭টার সময় নেমে আসি রাতভর বুকে জড়িয়ে রাখা গাছটি থেকে। তখনো বুক সমান পানি। পানি সাঁতরে কোনোভাবে উঠে এলাম বাড়ির সামনের রাস্তায়। এ সময় রাস্তার দু’পাশে দেখা যাচ্ছিল কেবল লাশ আর লাশ। চিৎ, কাত, উপুড় হয়ে পড়ে থাকা বিবস্ত্র নারী পুরুষের লাশ, সন্তান বুকে মায়ের লাশ, গরু ছাগলের অসংখ্য মরদেহ। চোখের সামনে ভেসে যাওয়া আম্মা-ভাগিনী, প্রতিবেশি কারো বেঁচে থাকার আশাই করতে পারছিলাম না তখন। ভিটেতে ফিরে দেখি ঘরের কোন অস্তিত্ব নেই। শূণ্য ভিটেয় ভেজা কাপড়ে বসে কাঁদছেন আম্মা।

তিনি জানালেন, খড়সহ ভেসে যাবার পথে একটি গাছ ধরে রাতভর মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচেছিলেন তিনি। একইভাবে বেঁচে যান ভাগিনী বিলকিসও। কিন্তু চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় জেঠাত ভাই ফয়েজ, তার ছেলে বাদশা ও মেয়ে সহ আমাদের বাড়ির তিনটি পরিবারের ১৬জন সদস্য। অনেক খোঁজাখুঁজির পর মিলেনি এদের অনেকের লাশের সন্ধান।

২৮ বছর আগের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি আজো নাড়া দিয়ে যায়। ভাবলেই বিস্মিত হই কিভাবে বেঁচে গিয়েছিলাম সেদিন। রাতটির কথা ভাবলে এখনো মনে হয়, আমার জীবন তো সেই ২৮ বছর আগেই থেমে যেতে পারতো। এখনো যে বেঁচে আছি সেটা তো ‘বোনাস লাইফ’।

-সিভয়েস/এসএ

শামসুল ইসলাম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়