Cvoice24.com

ধরাছোঁয়ার বাইরে অবৈধ অস্ত্রধারীরা
পাহাড়ের সাত উপজেলায় সোয়া এক বছরে অর্ধ-শতাধিক খুন

প্রকাশিত: ১৬:০১, ২১ মার্চ ২০১৯
পাহাড়ের সাত উপজেলায় সোয়া এক বছরে অর্ধ-শতাধিক খুন

পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মতো ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। গত ১৫ মাসে পাহাড়ের সাত উপজেলায় আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছে অর্ধ-শতাধিক।

তিন পার্বত্য জেলায় আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাস-খুনোখুনি-অপহরণ আর চাঁদাবাজির জেলা হিসেবে খাগড়াছড়ির কুখ্যাতি অনেক পুরনো। আঞ্চলিক দলের আধিপত্য বিস্তার আর সশস্ত্র শাখার নিরাপদ প্রশিক্ষণ এবং কালেক্টর নিয়োগের প্রয়োজনে এটি সংক্রমিত হয়েছে পাশের জেলা রাঙামাটির দুটি উপজেলাতেও। এরমধ্যে নানিয়ারচর থেকেই আলোচিত সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ’র জম্ম হয়েছে ২০১৭ সালের নভেম্বরে। আর তখন থেকেই খাগড়াছড়ির সাত উপজেলা আর রাঙামাটির এই দুই উপজেলায় চলছে রক্তক্ষয়ী হত্যাকাণ্ড।

খাগড়াছড়ির পাহাড়িদের মধ্যে বিশেষ করে চাকমা সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেই আঞ্চলিক দলের সশস্ত্র তৎপরতা বেশি লক্ষ করা যায়। দুই জেলার সাত উপজেলায় গত সোয়া এক বছরে অর্ধ-শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে বুলেটের আঘাতে। আঞ্চলিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দেয়া পরিসংখ্যানে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি।

পার্বত্য শান্তিচুক্তির আগে পরে টার্গেট কিলিংয়ের ক্ষেত্রে যাতে নিরীহ এবং অরাজনৈতিক মানুষ যাতে মারা না যান সেটি কিলাররা মাথায় রাখতো। কিন্তু ইদানীং ঘটনাগুলোতে ভারি অস্ত্রের ব্যবহার এবং ব্রাশ ফায়ারের ফলে টার্গেটের কাছে থাকা সাধারণ নিরীহ পাহাড়িদেরও প্রাণ দিতে হচ্ছে।

২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এবং পেরাছড়া হামলায় নিহত ছয়জনের মধ্যে চারজনই নিরীহ। এছাড়া প্রতিনিয়ত কোথাও না কোথাও পাহাড়িরা আঞ্চলিক দলের দুর্বৃত্তদের হাতে নানাভাবে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পাহাড়ে বইছে লাশের মিছিল। এদিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে এবং দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এবং পেরাছড়ায় সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের দুই দফা হামলায় এঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- ইউপিডিএফ সমর্থিত পিসিপি খাগড়াছড়ি শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তপন চাকমা, সহ সাধারণ সম্পাদক এলটন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুবফোরামের সহ সভাপতি পলাশ চাকমা, মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য সহকারী জীতায়ন চাকমা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রূপন চাকমা, খাগড়াছড়ি সদরের পেরাছড়া এলাকার বাসিন্দা শন কুমার চাকমা বিএসসি প্রকৌশলী পানছড়ি উপজেলার উল্টাছড়ি গ্রামের ধীরাজ চাকমা। আহতরা হলো, পিসিপি কর্মী সোহেল চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কর্মী সমর চাকমা সখীধন চাকমা।

দুর্বৃত্তদের এলোপাথাড়ি ব্রাশ ফায়ারে প্রাণ হারান আরো তিনজন নিরীহ ব্যক্তি। এরমধ্যে টেক্সটাইল প্রকৌশলী ধীরাজ চাকমা ঢাকা থেকে নৈশবাসে নেমে স্বনির্ভরস্থ পানছড়ি স্টপেজে গাড়ির জন্য অপেক্ষারত ছিলেন। মেধাবী এই প্রকৌশলীর বাড়ি পানছড়ি উপজেলার উগলছড়ি গ্রামে। মূলত ঈদ উল আযহার বন্ধে পরিবার স্বজনদের সাথে সময় কাটানোর জন্য তিনি বাড়ি ফিরছিলেন। নিহত রুপন চাকমা স্বনির্ভর এলাকার বাসিন্দা সুগত চাকমার সন্তান। দীঘিনালা ডিগ্রী কলেজের উন্মুক্ত শাখায় উচ্চ মাধ্যমিক অধ্যয়রত এই ছাত্র প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ফটোকপি করার জন্য বাসা থেকে বেরুনোর মাত্র ২০ মিনিটের মাথায় লাশ হয়ে যান। মহালছড়ি উপজেলায় স্বাস্থ্য সহকারি হিসেবে কর্মরত জিতায়ন চাকমা ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন স্বনির্ভর বাজার থেকে শাক-সবজি কেনার জন্য। সন্ত্রাসীদের বিষাক্ত বুলেট তাঁর বুক ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তপন ত্রিপুরা জানান, নিহতদের মধ্যে পিসিপি নেতা তপন চাকমা’র বাড়ি মহালছড়ি উপজেলা চোংড়াছড়ি গ্রামে। ডিওয়াইএফ নেতা পলাশ চাকমার বাড়িও একই উপজেলার মনাটেক গ্রামে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’ (ইউপিডিএফ)-এর সশস্ত্র শাখার প্রধান এবং নানিয়ারচর উপজেলার দাপটশালী কমান্ডার তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মার নেতৃত্বে ‘ইউপিডিএফ’ (গণতান্ত্রিক) নামে আরেকটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটলেই অস্থির হয়ে উঠে খাগড়াছড়ি জেলা এবং রাঙামাটির দুটি উপজেলা। এসব উপজেলায় আগে সংস্কারপন্থী ‘জনসংহতি সমিতি এবং ‘ইউপিডিএফ’র মধ্যকার সম্পর্ক ভালোই ছিল। ইউপিডিএফ থেকে ২০১৩ সালে বহিস্কৃত তপন জ্যোতি চাকমা প্রকাশ বর্মা ইউপিডিএফ-এর সামরিক কমান্ডার থাকাকালীন সময়ে পার্বত্য এলাকায় বিশেষত নানিয়াচরসহ রাঙামাটি এবং খাগড়াচড়িতে ব্যাপক আধিপত্য গড়ে তুলেছিল। দল থেকে বহিস্কৃত হওয়ার দীর্ঘদিন পর তপন জ্যোতি চাকমা ২০১৭ সালে তপন জ্যোতি চাকমা নতুন দল নিয়ে মাঠে নামলেই পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে থাকে।

২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত খাগড়াছড়িসহ অন্যান্য এলাকায় সংস্কারপন্থী জনসংহতির সাথে ইউপিডিএফ’র দৃশ্যত কোন ঝামেলা ছিল না। কিন্তু জানুয়ারির নির্বাচনে দুই দলের দুই প্রার্থী মাঠে নামলেও সংঘাত হয়নি। সেই নির্বাচনের পরে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনেও এই দুটি দল ভাগাভাগির ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করেছে। কিন্তু বহিষ্কৃত বর্মাকে দল গঠনে আস্কারা প্রদানের সন্দেহ থেকে প্রথমে দুই দলের সশস্ত্র শাখার মধ্যে পাল্টাপাল্টি আক্রমণ এবং পরে তা ক্রমে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে।

ইউপিডিএফ’র সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে চলতি আগস্ট পর্যন্ত মূল সংগঠন এবং সহযোগী সংগঠনের ২০ জন নেতাকর্মী সমর্থক খুন হয়েছেন। গত বছরের ডিসেম্বর মাসেই রাঙামাটির নানিয়াচর উপজেলায় ইউপিডিএফ-এর দুই কর্মী সমর্থক সাবেক ইউপি সদস্য অনাদি রঞ্জন চাকমা অনিল বিকাশ চাকমা খুন হন। এই হত্যকান্ডের রেশ না কাটতেই ২০১৮ সালের জানুয়ারি সকালে খাগড়াছড়ি জেরা সদরের নিজ বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে খুন করা মিঠুন চাকমাকে। পিসিপি গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাবেক এই কেন্দ্রীয় সভাপতি ইউপিডিএফ’র অন্যতম শক্তিশালী-জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। কেন্দ্রীয় সভাপতি দলীয় শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে অন্যতম।

ঘটনার এক মাস বিরতিতে একই বছরের ১৭ ফেরুয়ারি খাগড়াছড়ি জেলা সদরের রাঙাপানি ছড়ায় দীলিপ চাকমা খুন হন। এই ঘটনার তিন দিন পর জেলার দীঘিনালা উপজেলার জামতলীকে গুলি করে সাইন চাকমা সুপারা নামে এক ইউপিডিএফ কমীর্কে হত্যা করা হয়। মার্চ মাসে খাগড়াছড়ি সীমান্তবর্তী উপজেলা বাঘাইছড়িতে নতুন মনি চাকমা নামে এক কর্মী মারা যায়। এপ্রিল মাসে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের কমলছড়িতে সূর্য বিকাশ চাকমা (৪৫) নামে এক সমাজ কর্মী মারা যায়। নিজেদের নেতা বা কর্মী না হওয়া সত্বেও ইউপিডিএফ তাঁর মৃত্যুর পর প্রতিবাদে খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। একই সপ্তাহে খাগড়াছড়ির পানছড়িতে খুন হন ইউপিডিএফ সংগঠক নতুন কুমার ত্রিপুরা (৪০) ২২ মে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় উজ্জ্বল কান্তি চাকমা ওরফে মার্শাল (৫৫) নামে আরো এক সাবেক কর্মী প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারান। এছাড়া খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালায় নিজ বাড়িতে ফেরার পথে জেরান চাকমা নামের সাবেক এক পিসিপি কর্মীকে দীঘিনালা বাস স্টেশন থেকে প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। সেই থেকে এখনো নিখোঁজ জেরান।

একই বছরের গত মে রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে বেতছড়ি এলাকায় প্রতিপক্ষের ব্রাশফায়ারে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের প্রতিষ্ঠা সভাপতি তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ জন নিহত হয়। ঘটনার জন্য জনসংহতি সমিতি ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ইউপিডিএফ প্রসিত গ্রুপকে দায়ী করেছিল।

এদিকে ২৮ মে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে সঞ্জীব চাকমা (৩০),অতল চাকমা(৩০) স্মৃতি চাকমা (৫০)কে ব্রাশ ফায়ার করে খুন করা হয়। এএকাধিক ঘটনায় নানিয়াচর, বাঘাইছড়ি পানছড়িতে কিরণ চাকমা, জনি তঙ্গগ্যা সুনীল বিকাশ চাকমা নামে তিন ইউপিডিএফ কর্মী মারা যায়। এছাড়া হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুই নেত্রী অপহরণের দীর্ঘ সময় পর মুক্তি পায়। ঘটনাটি দেশে-বিদেশে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করে। গত সপ্তাহে দীঘিনালা উপজেলা সদরে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ হারান মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু নামের ইউপিডিএফ’র সাবেক এক কালেক্টর।

সর্বশেষ গত ১৮ জানুয়ারি বাঘাইছড়ি উপজেলার কিলো এলাকায় সন্ধ্যায় নির্বাচনী দায়িত্ব পালন শেষে ফেরার পথে সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নিহত হন প্রিজাইডিং অফিসার আব্দুল হান্নান, পোলিং অফিসার আল-আমিন, মো. আমির হোসেন, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য (ভিডিপি) সদস্য বিলকিস আক্তার, আসনার সদস্য-মিহির কান্তি দত্ত, জাহানারা বেগম এবং গাড়ির হেলপার মন্টু চাকমা হামলার সময় তিনটি গাড়ীতে প্রায় ২৪ জন দায়িত্বরত কর্তকর্তা,পুলিশ আনসার সদস্য ছিল বলে জানায় পুলিশ।

-সিভয়েস/এএস/এসএ

 

 

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়