Cvoice24.com


অর্ধশতাধিক স্থানে অবৈধ বালু উত্তোলন, ভাঙনে বিলীন বসতবাড়ি

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
অর্ধশতাধিক স্থানে অবৈধ বালু উত্তোলন, ভাঙনে বিলীন বসতবাড়ি

খাগড়াছড়িতে অবৈধভাবে চলছে বালু উত্তোলন। ছবি : প্রতিনিধি

খাগড়াছড়িতে সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন কাজের অজুহাতে বিভিন্ন নদী-খাল ও ছড়া থেকে বেপরোয়াভাবে চলছে বালু উত্তোলন। জেলায় সরকারিভাবে বালু উত্তোলনের জন্য ৯টি মহালে বৈধ ইজারাদার নিয়োগ করা হলেও খাগড়াছড়ি সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার পাশ দিয়ে প্রবাহিত প্রায় অর্ধশতাধিক স্থানে দিনে-রাতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলছে। 

প্রভাবশালী মহলের আগ্রাসনের শিকার হয়ে পুরো জেলার নদী-খাল-ছড়াগুলো এখন যেনো বালুখেকোদের নিষ্ঠুরতার বলি। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বৈধ বালুমহাল থেকেও ড্রেজার (গভীর থেকে বালু উত্তোলনের বিশেষ বৈদ্যুতিক যন্ত্র) দিয়ে বালু তোলার আইনি কোন সুযোগ নেই।

খোদ জেলাসদরেই প্রকাশ্যে বালু উত্তোলন ও কেনা-বেচার হাট বসলেও দেখার কেউ-ই নেই। এভাবে নির্বিচারে বালু উত্তোলনের কারণে বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ধারণ ক্ষমতার বেশি ওজনের বালু ভর্তি ট্রাক ও ট্রাক্টর চলার কারণে গ্রামীণ সড়কগুলোতেও অকালে ভাঙন ধরছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে বৈধ বালুমহাল ইজারাদাররা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

অথচ প্রভাবশালীদের ভয়ে তারাও মৌখিক বা লিখিত কোন অভিযোগ দিতে পারছেন না বলে স্বীকার করেছেন এই প্রতিবেদকের কাছে। তাদের অভিযোগ, বৈধ ইজারাদার হবার পরও এসব অবৈধ বালু উত্তোলনের দায়ভারও আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে প্রশাসন। সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। নদী-খাল-ছড়াগুলোর স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হচ্ছে।

একজন ইজারাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রশাসনের কিছু ব্যক্তি জেলায় চলমান কিছু বড় অংকের নির্মাণ কাজের ঠিকাদারের সাথে মিলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে যখন-তখন যেখান থেকে খুশী সেখান থেকেই বালু উত্তোলন করছেন। প্রকাশ্যে ড্রেজার ব্যবহার করলেও সবাই যেনো জেনেও না জানার ভান ধরছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মাত্রাতিরিক্ত বালু খেকোদের তাণ্ডবে জেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা মানিকছড়ি। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ম্রাগ্য মারমা জানান, উপজেলার বিভিন্ন খাল-ছড়া থেকে বৈধ-অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে খাল ও ছড়ার মানুষের বসতবাড়ি-জমি ভাঙনের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়িত। বালুবাহী বিভিন্ন ভারী যানবাহনের চাপে উপজেলার অধিকাংশ গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের অল্প দিনের মাথাতেই চলাচল অযোগ্য হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে উপজেলা পরিষদের মাসিক সভা করে বেশ কয়েকবছর আগে জেলা প্রশাসনকে রেজুলেশন আকারে অবহিত করা হলেও কোনই প্রতিকার মেলেনি।

খাগড়াছড়ি সদরের চেঙ্গী নদী, খাগড়াছড়ি খাল ও রাঙাপানিছড়া, দীঘিনালা উপজেলার মাইনী নদী, মানিকছড়ি ও পানছড়ি পাশ দিয়ে প্রবাহিত চেঙ্গীসহ বিভিন্ন ছড়া, মানিকছড়ি খাল, চেঙ্গুছড়া ও বড়বিলসহ বিভিন্ন নদী ও খালগুলো।

বিশেষ করে জেলার মানিকছড়ি এবং খাগড়াছড়ি সদর থেকেই সবচেয়ে বালু উত্তোলন হবার অভিযোগ করেছে ‘খাগড়াছড়ি পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলন’।

সংগঠনটির সা: সম্পাদক সাংবাদিক আবু দাউদ জানান, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা সত্বেও জেলায় অবাধে বালু উত্তোলন, পাহাড়কাটা, পুকুর-জলাধার ভরাটের দৃশ্যত প্রশাসনের কোন প্রতিবিধান চোখে পড়ছে না। প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিকের ছত্রছায়ায় পরিবেশ আইন পরিপন্থী এসব অপতৎপরতা অব্যাহত থাকলেও দেখেও যেনো কেউ-ই এমন অবস্থা বিরাজ করছে জেলাজুড়ে।

খাগড়াছড়ি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্য সুদর্শন দত্ত অভিযোগ করে বলেন, জেলায় পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংসের মহোৎসব চলছে। এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, জেলা সদরে তাঁর নিজের মালিকানাধীন পাহাড় কেটে নিচ্ছে চিহ্নিত দুর্বৃত্তরা। 

সরেজমিনে মানিকছড়িতে দেখা গেছে, কোন ধরণের নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করেই অন্তত অর্ধশত স্থান থেকে দিনে-রাতে বালু উত্তোলন চলছে। উত্তোলিত সে বালু ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। বালু ভর্তি ট্রাক চলাচলের কারণে সবচেয়ে নাজুক অবস্থা গ্রামীণ সড়কগুলোর। বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা বিধি না মানার কারণে নদী-খাল ও ছড়া ভেঙ্গে এবারো-থেবড়ো হয়ে গেছে। তবে বালু সন্ত্রাসীদের ভয়ে মুখ খুলতে রাজি নয় কেউ।

স্থানীয় একজন সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলার সরকারি দলের শীর্ষ নেতাদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে বলেন, গত ১০ বছরে তাঁরা একেকজন ১০ থেকে শত কোটি টাকার মালিক বনেছেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম-মানিকছড়ি-কুমিল্লায় অঢেল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন। তাঁদের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অনুসন্ধানে নামলেই মানিকছড়ির সর্বনাশা বালু উত্তোলনের মূল রহস্য উন্মোচিত হবে।

মঙ্গলবার (১২ ফের্রুয়ারি) সকালে মানিকছড়ি সদর উপজেলার সিএন্ডবি কলোনি এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, তিন শ্রমিক খাল থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু তুলছে। পাশের কয়েকজন ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বালু উত্তোলনের কারনে প্রতি বর্ষা মৌসুমে তাদের ভূমি ভেঙ্গে যাচ্ছে। বালু উত্তোলনে বাধা দিলে হুমকি দেওয়া হয়। কারন বালু উত্তোলনকারীরা প্রভাবশালী ও রাজনীতির সাথে জড়িত। কিছুক্ষণ পর বেলাল হোসেন নামে জনৈক ব্যক্তি দৌঁড়ে এসে জানালেন, তিনি শ্রমিক লীগের নেতা। তিনি বালু তুলছেন নিচু রাস্তা সমান করার জন্য। 

তিনট্যহরী চেংগুছড়া রাস্তায় দেখা গেছে আরো ভয়াবহ চিত্র। এ সড়কের বিভিন্নস্থানে ড্রেজার দিয়ে বালু তুলছে শ্রমিকরা। কিন্তু নেপথ্য ব্যক্তির নাম বলতে রাজি নয় তারা। অতিরিক্ত বালু ভর্তি ট্রাকের ভারে এ  গ্রামীণ সড়কটি এখন বিলীন হওয়ার পথে। কোথাও কোথাও বড় বড় গর্ত। আবার কোথাও সড়কের কোন অস্থিত্ব নেই।

ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের এক চালক নাম প্রকাশ না শর্তে বলেন, পুরো সড়কটি বালু খেকোরা নষ্ট করে দিয়েছে। দিনে-রাতে এ সড়ক দিয়ে চলে অতিরিক্ত বালু ভর্তি ট্রাক। এরা প্রভাবশালী। কেউ ভয়ে প্রতিবাদ করে না। একই চিত্র মানিকছড়ির বড়বিল, যোগ্যাছলা, পাক্কাটিলার ও তুলাবিল এলাকার। এ সব এলাকার প্রতি কদমে কদমে দেখা মিলবে বালু উত্তোলনের চিত্র। 

নাম প্রকাশ না শর্তে কয়েকজন বাসিন্দা জানান, সম্প্রতি সেনা, পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের অভিযানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন কয়েকদিন বন্ধ থাকলেও আবারও পুরোদমে চলছে। 

খাগড়াছড়ি পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি প্রদীপ চৌধুরী বলেন, নির্বিচারে বালু তোলার কারণে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদী, খাল ও ছড়াগুলোর ইকোসিস্টেম মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।

তিনি অভিযোগ করেন, জেলার পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষার ক্ষেত্রে রক্ষক-ই যেন ভক্ষক। ধর্মীয় ও সরকারি উন্নয়ন কাজের নামেও অবৈধ বালু উত্তোলন আর পাহাড়কাটা যেন নিয়মেই পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝে প্রশাসনের উদ্যোগে রুটিন ওয়ার্কের অংশ হিসেবে কিছু ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হলেও মামলার সংখ্যা একেবারে হাতে গোনা। 

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের ধরতে প্রতিনিয়ত অভিযান চালানো হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হচ্ছে। অভিযানের খবর আগে জেনে যাওয়ায় সফল হচ্ছে না। তবে ভ্রাম্যমান আদালতের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। 

-সিভয়েস/এসএইচ

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়