Cvoice24.com

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এনজিওদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ
বহিরাগতদের মেয়াদ বাড়ে, স্থানীয়রা ছাঁটাই হয় গণহারে

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
বহিরাগতদের মেয়াদ বাড়ে, স্থানীয়রা ছাঁটাই হয় গণহারে

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এনজিওদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের মানববন্ধন।

প্রায় মাস দেড়েক ধরে উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় লোকজনের মাঝে রোহিঙ্গাদের সেবায় নিয়োজিত দেশি-বিদেশি এনজিও গুলোর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। 

ডিসেম্বর মাসের শেষ থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন এনজিও গুলো প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার অজুহাতে কয়েক শত স্থানীয় দরিদ্র কর্মজীবীদের চাকরি থেকে ছাঁটাই করেছে। অথচ রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে এসব এনজিও সমূহে কর্মরত কক্সবাজার জেলার বহিরাগত ও শত শত রোহিঙ্গাদের চাকরি বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। 

মূলত এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে স্থনীয় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন এনজিও গুলোর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মুখোমুখি করে বিশৃংখলা সৃষ্টির অভিযোগ করে আসছে।

শফিকুর রহমান (৩০) একজন রোহিঙ্গা যুবক। আশ্রয়, রেশনপাতি, চিকিৎসাসহ প্রায় সব মৌলিক চাহিদা বিনামূল্যে পেয়ে আসছেন। তিনি ‘ওব্যাট হেলপার’ নামের একটি বিদেশি এনজিওতে প্রোগ্রাম কর্ডিনেটর পদে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাকরি করছেন মাসিক ৪০ হাজার টাকা বেতনে। 

একই এনজিওতে লজেস্টিক অ্যান্ড অ্যাডমিন অফিসার পদে জাহিদ আলমসহ ফিল্ড অফিসার পদে ১০ জন রোহিঙ্গা মাসিক ৩৫/৪০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করছে। 

এনজিওটির বিভিন্ন ক্যাম্পে শিক্ষা কার্যক্রমে ৬৪ জন জনবলের মধ্যে মাত্র ১৩ জন বাংলাদেশি এবং বাকি ৫১ জন রোহিঙ্গা। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমে ১১৮ জন জনবলের মধ্যে মাত্র ৯ জন বাংলাদেশি আর বাকি ১০৯ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পরিচালিত হলেও ওব্যাট হেলপার এনজিওটির যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনায় রয়েছে ঢাকার পাকিস্তানি কতিপয় বিহারী। তাদের সাথে আমেরিকা, বৃট্রেন, ফ্রান্স, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের পাকিস্তারি বংশোদ্ভূত দাতারা নিয়মিত অন অ্যারাইভ্যাল ভিসা নিয়ে অবৈধভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। 

এনজিওটি স্থানীয় প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে দীর্ঘদিন বেআইনিভাবে দায়িত্ব পালন করছে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ডাক্তার ইমাদ আলী।

নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে এনজিওটিতে সম্প্রতি উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার অভিযান চালান। অভিযানকালে কর্মরত ডাক্তার, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের তথ্য চাইলে তারা দিতে ব্যর্থ হন এবং অনেকে চাকরি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী জানান।

এদিকে, মেডিসিন স্যান্স ফ্রন্টিয়ার বা এমএসএফ (হল্যান্ড) নামের আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে স্থানীয় লোকজন ও প্রশাসনের অনেক অভিযোগ। সংস্থাটি মূলত স্বাস্থ্য সেবার ওপর কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কিত কোন তথ্য দিতে তারা গড়িমসি করে থাকে বলে উখিয়ার ইউএনওসহ অনেকে জানান। তাদের হাসপাতালে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।

রোহিঙ্গা ও একটি বিতর্কিত মহলের লোকজনদের অধিকহারে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়ে থাকে বলে অভিযোগ এমএসএফের বিরুদ্ধে। 
উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা জাকের হোসেনকে সম্প্রতি কালচারাল অফিসার পদে নিয়োগ দিয়েছে সংস্থাটি প্রায় ৪৮ হাজার টাকার বেতনে।

লিয়াজোঁ অফিসার পদে সেখানে চাকরিরত রয়েছে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু রুহুল আমিন। গত ৩১ জানুয়ারি প্রকল্প মেয়াদ শেষের অজুহাতে এমএসএফ অন্তত স্থানীয় বিভিন্ন পদে চাকরিরত ৩৭ জনকে ছাঁটাই করেছে। তৎমধ্যে দুই সন্তানের জননী উখিয়ার দরগাহ বিল গ্রামের মৃত হাজী দুদু মিয়ার মেয়ে মরিয়ম বেগম। 

দাম্পত্য জীবনে সমস্যায় পড়ে ভাইদের কাছে দুই ছোট শিশু নিয়ে আশ্রয়ে থেকে সে চাকরি করছিল। চাকরি হারিয়ে মরিয়ম পরদিন মানষিক চাপে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। 

এমএসএফ (হল্যান্ড) এ টিম লিডার পদে স্থানীয় চার জনের বিপরীতে চাকরি করছে ৩২ জন রোহিঙ্গা। 
স্থানীয় ৩৩ জন আউটরিচ ওয়ার্কারের বিপরীতে ঐ পদে রোহিঙ্গা চাকরি করছে দেড় শতাধিক। স্থানীয় ৪০ জন আউটরিচ টিম সুপারভাইজারের বিপরীতে রোহিঙ্গা কর্মরত রয়েছে দুইশ জনের বেশি। 

এমএসএফ (ফ্রান্স) এ আরো কঠিন অবস্থা স্থানীয়দের নিয়োগের ক্ষেত্রে। উক্ত এনজিওতে গার্ড পদে বাংলাদেশি ১০ জনের বিপরীতে রোহিঙ্গা নিয়োজিত রয়েছে ৩৭ জন। যাদের বেতন মাসিক ২২ হাজার টাকা। হেল্থ ওয়ার্কার পদে বাংলাদেশি কোন কর্মী না থাকলেও রোহিঙ্গা কর্মরত রয়েছে ১৮৪ জন। যাদের বেতন মাসিক ২৫-২৮ হাজার টাকা। তাদের ১২০ জন ন্যাশনাল স্টাফের অধিকাংশ কক্সবাজার জেলার বাইরের।

রিলিফ ইন্টারন্যাশনাল নামের এনজিওটিতে স্বাস্থ্যকর্মী, স্কুল ও শিশুবান্ধব কেন্দ্রের তিন শতাধিক কর্মীর মধ্যে ২৬০ জনের মত রোহিঙ্গা কর্মরত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। 

এছাড়াও রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টার (রিক) ব্র্যাক, সেভ দ্যা চিলন্ড্রেন, খ্রিষ্টান এইড, প্লান ইন্টারন্যাশনাল, গণস্বাস্থ্য, গণউন্নয়ন কেন্দ্র, ডেনিস রিফিউজি কাউন্সিল, আইআরসি, এডিআরএ, ঢাকা আহসানিয়া মিশন, ইসলামিক হেল্প, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ, ওয়াল্ড ভিশন, কারিতাসসহ শতাধিক দেশি-বিদেশি এনজিওতে অন্তত পক্ষে সাত হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ও কক্সবাজার জেলার বাইরের আরও ৫ হাজারের বেশি লোক কর্মরত রয়েছে বলে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব ও পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সম্ভবত এনজিও গুলোতে রোহিঙ্গা যারা বেআইনিভাবে চাকরি করছে তাদেরও স্থানীয়দের কাতারে হিসেব করা হচ্ছে। বিদেশিদের অনেকের বৈধ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র না থাকার দায়ে পুলিশসহ আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে দুই শতাধিক বিদেশি কর্মীদের আটক করেছিল। পরবর্তীতে মুচলেখায় মুক্তি পেলেও তাদের স্বভাব বদলাচ্ছে না বলে তিনি জানান।

উক্ত কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, হাজার হাজার রোহিঙ্গা ও বহিরাগতদের জন্য এনজিও গুলো প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয় না। শুধুমাত্র রোহিঙ্গাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত উখিয়া ও টেকনাফে বেকার জনগোষ্ঠির ক্ষেত্রে তাদের বিভিন্ন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এতে করে সেবা সংস্থার নামে এনজিও গুলো বিশ্ব দরবারে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘস্থায়ী করতে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠি ও আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির মধ্যে বিভেদ, বিশৃংখলা সৃষ্টি করে উভয়কে মুখোমুখি করে পরিস্থিতি ভিন্নতর রুপ দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে।

তিনি সহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলেছেন, মানবতাকে আশ্রয়, লালন করতে গিয়ে উখিয়া ও টেকনাফের মানুষদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি এনজিও গুলো প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার অজুহাতে অনেক স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনদের চাকরি থেকে ছাঁটাই করেছে। গত মাসখানেক ধরে বেকার লোকজন বিভিন্নভাবে বিভিন্নস্থানে এনজিও গুলোর বিরুদ্ধে মানববন্ধন, ক্ষোভ, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসকসহ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট হাজার খানেক চাকরিচ্যুত স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন চাকরি ফিরে পাওয়ার আবেদন করেছেন বলে জানা গেছে।   

-সিভয়েস/এসএইচ

আবদুল্লাহ আল আজিজ, উখিয়া

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়