Cvoice24.com

প্রশান্তির ঘুম, আপনার করণীয় ... 
সুস্থতায় নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুমের বিকল্প নাই

প্রকাশিত: ১৩:৩৪, ২২ নভেম্বর ২০১৮
সুস্থতায় নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুমের বিকল্প নাই

অপরিমিত ঘুম! আজকের দিনে অতি সাধারণ এক সমস্যা। চিকিৎসকদের মতে, সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দিনে অন্তত আটঘন্টা ঘুমানো উচিৎ। কারণ, ঘুমের সময় আমাদের শরীর সারাদিনের যত শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে, নিরাময় করে ও নতুন করে কর্মোদ্যম ফিরে পায়। 

আবার নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুম না হলে সারাদিন মেজাজ খিটখিটে থাকে, স্মৃতিশক্তি কমে যায়, মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়, চেহারায় ও ত্বকে বয়সের ছাপ পড়ে, শারীরিক শক্তিও কমে যায় এমনকি সহজে ওজনও কমতে চায়না। 

তাই সুস্থ থাকার জন্য নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুমের বিকল্প নাই। আসুন দেখে নেই ঘুম না হওয়ার কিছু কারণ ও এর প্রতিকার।

হাতে নয় মোবাইল, ট্যাব বা ই-বুক : 

বার্মিংহ্যাম সাউদার্ন কলেজের সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডঃ জোসেফ চ্যান্ডেলর বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইমেইল প্রচুর স্ট্রেস বা মানসিক চাপ ডেকে আনে যার ফলে ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়। 

ঘুমানোর আগে মোবাইল, ট্যাব বা অন্য কোনো গেজেটে চোখ রাখলে তার থেকে আসা আলো আমাদের মস্তিষ্ককে বিভ্রান্ত করে। ডিভাইসের স্ক্রিন থেকে আসা আলো কে দিনের আলো ভেবে ভুল করে। এর ফলে আমাদের শরীরে মেলাটোনিন নামক রাসায়নিক উৎপাদন হয়না। এই মেলাটোনিন ঘুম এনে দেয়। যখনই শরীরে পর্যাপ্ত মেলাটোনিন উৎপাদন হয়না, তখনই আমাদের ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়। ইনসমনিয়া বা ঘুমাতে না পারা রোগের সূত্রপাতও হয় পর্যাপ্ত পরিমাণ মেলাটোনিন উৎপাদন না হলে। তাই ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত এক ঘন্টা আগে সমস্ত ধরণের ডিজিটাল যন্ত্র যেমন মোবাইল, কম্পিউটার, টেলিভিশন, ই-বুক ইত্যাদি দেখা বন্ধ করে দিন। 

টেক্সাসের হাউসটন মেথোডিস্ট হাসপাতালের একজন স্লিপ নিউরোলজিস্ট অপরাজিতা ভার্মা। তিনি মোবাইল বা অন্যকোন গেজেট বিছানার কাছে না রাখতে পরামর্শ দেন। বিশেষত যাদের রাতের বেলা সময় সময় ফোন চেক করার অভ্যাস আছে তাদের তো একদমই ফোন হাতের কাছে রাখা যাবেনা। 

‘আজ দশটা তো কাল বারোটা’ যেন না হয় : 

সপ্তাহের একদিন রাত দশটায় ঘুমাতে গেলেন তো আরেকদিন রাত দুটোয়। এভাবে সপ্তাহের একেক দিন এক একসময়ে ঘুমাতে গেলে আমাদের দেহঘড়ি বা শরীরের ভেতরের নিজস্ব সময়ানুবর্তিতায় ব্যাঘাত ঘটে। ফলে সহজে ঘুম আসেনা। অপরাজিতা ভার্মা বলেন, এমন হলে ঘুম ভাঙার পর দুর্বল লাগে, এমনকি নিজের পায়ে দাঁড়াতেও যেন সমস্যা হয়। কিন্তু প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া কিছুটা অসম্ভব বলতে গেলে। তবে প্রতিদিনের ঘুমাতে যাওয়ার সময়ের ব্যবধান ৩০ থেকে ৪৫ মিনিটের বেশি যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিনের আগের রাতেও এ নিয়মের ব্যত্যয় যেন না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। 

ক্যাফেইনও হতে পারে ঘুমের শত্রু  : 

ক্যাফেইন শরীরে নতুন করে কর্মশক্তি যোগান দেয়। এর মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্ককে সে কতক্ষণ ধরে জেগে আছে সে সম্পর্কে ভুল ধারণা দেয় দেয়। তাই ঘুম আসতে দেরী হয়। অধ্যাপক চ্যান্ডেলর বলেন, অনেকেই ভাবেন ঘুমানোর আগে নিয়মিত চা কিংবা কফি খেলে ধীরে ধীরে সেটা শরীরে সয়ে যায়। তাই রাতে ক্যাফেইন গ্রহণেও ঘুমে সমস্যা হয় না। কিন্তু যারা দীর্ঘদিন ধরে ঘুমের আগে চা বা কফি খায় তাদেরও সহজে ঘুম আসে না।

বেশিরভাগ ক্যাফেইন অন্তত সাতঘন্টা আমাদের শরীরে কার্যকর থাকে। তবে ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত পাঁচ ঘন্টা আগেই দিনের শেষ কাপ চা বা কফি পান করতে হবে। কারও যদি খুব বেশি ঘুমের সমস্যা থাকে তবে দিনের শেষ কাপ চা বা কফি দুপুরের খাবারের পরপরই খেয়ে নিতে হবে।

বিছানা ও বালিশে সতর্কতা :

বিছানা যদি আরামদায়ক না হয় অর্থাৎ বেশি শক্ত বা নরম হলেও ঘুমের সমস্যা হয়। আবার ঘুমানোর সময় সঙ্গী যদি নড়াচড়া করে তবেও ঘুমের সমস্যা হয়।

বিছানার সমস্যার জন্য ঘুম না হলে সেটা চিহ্নিত করে তারপর সমাধান করুন। প্রয়োজনে জাজিম, তোষক, ম্যাট্রেস বা ফোম বদলে ফেলুন। শুধু বিছানাই নয়, বালিশের জন্যও ঘুমের সমস্যা হয়। তাই দরকার মনে করলে বালিশ বদলান এবং পাশবালিশ, কুশন ইত্যাদি রাখুন। অনেকসময় কোমরে বা পিঠে ব্যাথার জন্য ঘুম আসেনা। তখন পায়েরবালিশ ব্যবহার করলে আরাম পাবেন।

তাছাড়া বিছানাকে শুধুমাত্র ঘুমানোর জন্যই ব্যবহার করুন। বই পড়া, ইন্টারনেট ব্রাউজিং বা মুভি দেখার জন্য বিছানায় বসবেন না। একবারে ঘুমানোর আগেই বিছানায় যান।

শোবার ঘর : 

শোবার ঘর ঠাণ্ডা হলে গায়ের তাপমাত্রা কমে গিয়ে ঘুম আসে। আবার শোবার ঘর বেশি গরম হলে মানুষের অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয় তাই সহজে ঘুম আসে না। আবার আলোর ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার কাজ করে। সামান্যতম আলোতেও আমাদের শরীরে অল্প মাত্রায় মেলাটোনিন উৎপাদন হয়। ফলে ঘুমাতে হবে, এই সিগ্যনাল মস্তিষ্কে পৌঁছাতে দেরী হয়। 

তাই ঘুমের বেশ আগে থেকেই শোবার ঘর ঠাণ্ডা করুন আর কোনদিক থেকেই যেন শোবার ঘরে আলো না ঢুকতে পারে সেটা নিশ্চিত করুন। আবার একইসাথে চেষ্টা করুন ঘরকে যতটা সম্ভব শব্দমুক্ত করতে। 

মনের যত্ন নিন : 

নানারকম চিন্তা নিয়ে শুতে গেলে ঘুম না আসাই স্বাভাবিক। ঘুমানোর আগে একটা নির্দিষ্ট সময় রাখুন, সারাদিনের কাজ কারবার মূল্যায়ন করার জন্য। মানসিক চাপ থাকুক আর না থাকুক, ঘুমানোর আগে নিজের জন্য কিছুটা সময় অবশ্যই রাখুন। এই সময়টাতেই করে ফেলতে পারেন মেডিটেশন কিংবা যোগব্যায়াম। যাদের ঘুমের সমস্যা আছে তারা নিয়মিত মেডিটেশন করলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। তাছাড়া ঘুমানোর আগে আপনি যা কিছুর প্রতি কৃতজ্ঞ সেসব লিখে ফেলতে পারেন। গবেষণা বলছে যারা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে তাদের ঘুমের জটিলতা নাই বললেই চলে। 

অপরাজিতা ভার্মা বলেন, ঘুমানোর আগে গোসল করা, স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ করা অথবা বই পড়লে (ই-বুক নয়) মস্তিষ্ক ঠাণ্ডা হয়। ফলে সহজে ঘুম আসে। 

ঘুমানোর জন্য শুধুই রাত :

শুধুমাত্র রাতেই ঘুমান, দিনের অন্য সময়ে নয়। দিনের বেলা ঘুমানোর প্রয়োজন হলেও বিকেলের দিকে নয়। তাও ২০ মিনিটের বেশি যেন না হয়। বিকেলের দিকে ক্লান্ত লাগলে অল্প কিছুক্ষণ হাঁটুন বা এক গ্লাস বরফ ঠাণ্ডা পানি খান অথবা কোন বন্ধুকে ফোন দিয়ে কিছুক্ষন গল্প করুন। 

এলার্ম ঘড়ি দূরে রাখুন :

রাতে ঘুমাতে গিয়ে বারবার করে এলার্ম ঘড়ির দিকে তাকালে পরদিনের কাজের কথা মনে আসবে বারবার। তাই ঘুম আসতেও সমস্যা হয়।

শোবার সময় এলার্ম ঘড়ি ভুলেও হাতের কাছে রাখবেন না। শোবার আগেই এলার্মের সময় ঠিক করে বিছানার নীচে, টেবিলের ড্রয়ারে বা হাতের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন।

শারীরিক অস্বস্তি দূর করাও জরুরি : 

ঘুম ভাঙার পর কাঁধ নাড়াতে সমস্যা হলে বা ক্লান্ত লাগলে সেই দায় আপনার বালিশের হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বালিশ খুব বেশি উঁচু বা নীচু দুটোই সমস্যার। শোবার সময় বালিশের মাধ্যমে কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত শরীরের ন্যাচারল কার্ভের ভারসাম্য রক্ষা করা। কারো যদি কাত হয়ে শোয়ার অভ্যাস থাকে তাহলে যতখানি সম্ভব সোজা থাকার চেষ্টা করুন। পেটের দিকে সংকুচিত হয়ে শুলে কাঁধে ব্যাথা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। বিছানার বসে টিভি দেখার অভ্যাস বাদ দিতে হবে। কাঁধ বাকিয়ে গলা কিছুটা সামনে বাড়িয়ে টিভি দেখার কারণে কাঁধে সমস্যা দেখা দিতে পারে। 

সতর্কতা ব্যায়ামেও : 

আমরা সবাই জানি প্রতিদিন ব্যায়াম করলে ভালো ঘুম হয়। কিন্তু যদি ঘুমের ঠিক আগে ব্যায়াম করেন, তবে উল্টো ফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ ব্যায়ামের ঠিক পর পর শরীরে নতুন করে শক্তি সঞ্চার হয় যা উল্টে জাগিয়ে রাখে। তাই ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত তিন থেকে চার ঘন্টা আগেই বায়্যাম সেরে রাখুন। যদি ঘুমানোর আগে ব্যায়াম করতেই হয় তবে যোগবায়্যাম বা মাইন্ড-বডি এয়াক্সারসাইজ করুন।  

ঘুমের সাথে খাবারও ওতপ্রতভাবে জড়িত : 

ঘুমের সাথে রাতের খাবারের সম্পর্ক আছে। রাতে খুব ভারী খাবার খেলে তা পাচনতন্ত্রে থেকে যায় ফলে ঘুমের সমস্যা হয়। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত এক ঘন্টা আগেই রাতের খাবার শেষ করে ফেলুন। এমনকি সন্ধ্যার নাস্তাতেও তেল মশলা, পনির বা মাখন আছে এমন খাবার এড়িয়ে চলুন। অনেকেরই রাতে এলকোহল গ্রহণের অভ্যাস আছে। এলকোহল কিছুক্ষণের জন্য ঘুম আনলেও রাতে দীর্ঘক্ষণ জাগিয়ে রাখার জন্য দায়ী। রাতের দিকে হালকা গরম দুধ বা ক্যালোমাইল চা পান করা ভালো। এতে ঘুম আসবে। 

ঘুমের ওষুধ, সাবধান! 

ঘুমের সমস্যা হলে অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ঘুমের ওষুধ খাওয়া শুরু করে দেন। তবে একটানা দীর্ঘসময় ধরে ঘুমের ওষুধ খেলে অন্যান্য শারীরিক সমস্যা হতে পারে। যদি এমন হয় যে আপনি দীর্ঘদিন ধরে ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুমাতে পারছেন না তবে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে ওষুধ ছাড়াই যেন ঘুম আসে সে ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে লাইফস্টাইলে পরিবর্তন আনুন। 

নিজে নিজে চেষ্টা করার পরেও যদি ঘুম না আসে তবে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।

সিভয়েস/এস.আর 

সিভয়েস ডেস্ক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়