Cvoice24.com


এ বীরের রক্তবীজ জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে

প্রকাশিত: ১৪:২৯, ২৭ অক্টোবর ২০১৮
এ বীরের রক্তবীজ জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে

প্রধানমন্ত্রী থেকে পুরষ্কার গ্রহণ করছেন মোজাহার উল্লাহ বীর উত্তম।

চট্টগ্রাম বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের এক অপরিহার্য নাম। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর চট্টলা এক অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছে। যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ জনপদের বীরেরা লড়াই করেছে, জীবন দিয়েছে। লাখো শহিদের রক্তে স্নাত এ জনপদ মুক্তি সংগ্রামকে পৌঁছে দিয়েছে বিজয়গাঁথায়। বিপ্লবের চারণভূমি এ চট্টলা হাজার বছর ধরে জন্ম দিয়েছে আত্মত্যাগী বহু বীরের। প্রীতিলতা বা সূর্যসেনের আত্মত্যাগ উচ্চারিত হলেও এ সমাজ নিশ্চুপ ছিল অনেক কৃতিমানের অবদান স্মরণে। তেমনি ভুলে যাওয়া এক বীরের নাম মোজাহার উল্লাহ বীর উত্তম।

চট্টগ্রামের একমাত্র বীর উত্তম হলেও সমাজ বাস্তবতায় তিনি অচেনা এক বীর। নৌ কমান্ডো হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, অপারেশন জ্যাকপটের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন তিনি। জীবনবাজী যুদ্ধে পুরস্কার হিসেবে বীরউত্তম খেতাব ভূষিত হলেও প্রচারবিমূখ এ বীর রয়ে গেছেন পাদপ্রদীপের আলোর বাইরে। 

মোজাহার উল্লাহ বীর উত্তম ১৯৪৪ সালের ১৩ জুন চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার করের হাটস্থ ভালুকিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শহিদ আলী আজম এবং মাতা মিসেস খায়রুন্নেসা। পড়ালেখার হাতেখড়ি হয় করের হাটের চত্তুরুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ভর্তি হন করের হাটের কামিনি মোহন হাইস্কুল। সংক্ষেপে কে. এম. হাইস্কুল নামে পরিচিত। কে. এম হাইস্কুল থেকে গিয়ে তিনি ভর্তি হন ফেনীর পাইলট স্কুলে এবং সেখান থেকে এসএসসি পাশ করে ভর্তি হন ফেনী কলেজে। পরবর্তীতে চট্টগ্রামে এসে ভর্তি হন চট্টগ্রাম সিটি কলেজে। সেখান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে ভর্তি হন করাচি ইসলামিয়া কলেজে। অতঃপর সেখান থেকে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন পাকিস্তান ইনসিওরেন্স কর্পোরেশনে। ৬ মাসের পুত্র সন্তানকে নিয়ে ১৯৭০ সালে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে। 

রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় তিনি ছুটি শেষে আর পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান নি। ২৫ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের ঘুমন্ত নিরীহ জনতার উপর বর্বর আক্রমন চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ২৬ শে মার্চ থেকে চট্টগ্রামে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। যুবক স্বেচ্ছাসেবকদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয় রামগড় মুক্তি প্রশিক্ষণ শিবিরে। প্রাথমিক অবস্থায় পাঁচ শতাধিক মুক্তিপাগল জনতা গেরিলা প্রশিক্ষণ শুরু করেন। রামগড় হাইস্কুলের সে ক্যাম্পে ট্রেনিং নেন মোজাহার উল্লাহ। মোজাহার উল্লাহ ও অন্যান্য গেরিলারা শরণার্থী দলের সাথে মিশে সীমানা অতিক্রম করে পোয়াংবাড়ি ক্যাম্পে পৌঁছান। 
মোজাহার উল্লাহ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রোষানলে পড়ে তার পরিবার। এদেশীয় রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় মোজাহার উল্লার বাড়ির ঘেরাও করে আগুন লাগিয়ে দেয় পাকবাহিনী। আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে তার পিতা শহিদ আলী আজমকে। ভারতে প্রবেশ করার পর দিন পনের হরিণা ইউথ ক্যাম্পে ছিলেন মোজাহার। 

এরই মধ্যে সাঁতার জানা, ডুব দিয়ে পানির নিচে থাকা ও শারীরিক সামর্থে যোগ্যদের বাছাই করা শুরু করে ভারতীয় নেভাল টিম। মোজাহার নাম লিখান সে দলে। নির্বাচিতদের রিজার্ভ ট্রেনে আসামের শীলচর, সেখান থেকে কলকাতার পলাশী নিয়ে যাওয়া হয়। ভাগিরথির উত্তাল পরিবেশে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। দু’মাসের বেশি কঠোর প্রশিক্ষণে শেষ হয় গেরিলাদের চূড়ান্ত যুদ্ধপ্রস্তুতি। প্রস্তুতি শেষে চট্টগ্রাম, খুলনা, চাঁদপুর, নারায়নগঞ্জ, মংলা প্রভৃতি স্থানে অপারেশন পরিচালনার জন্য কমান্ডো নির্বাচন করা হয়। চট্টগ্রামে অপারেশনের জন্য বাছাইকৃত হন ষাটজন নৌকমান্ডো। চট্টগ্রাম এলাকার ষাটজন নৌকমান্ডোর সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন আবদুল ওয়াহিদ চৌধুরী। 

চট্টগ্রামের অপারেশন গ্রুপকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। তিনজন অপারেশন কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে মোজাহার উল্লাহ, শাহ আলম ও আবদুর রশিদ। আবদুর রশিদ গ্রুপ রামগড়, শাহ আলম গ্রুপ আমলিঘাট এবং মোজাহার উল্লাহ গ্রুপ বিভুইয়া ঘাট দিয়ে নৌকাযোগে মিরসরাই সমিতির হাট উঠার প্রস্তুতি নেন। প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে কমান্ডোরা সীমান্ত অতিক্রম করেন। সীমান্ত পার হয়ে সমিতি হাট আশ্রয়কেন্দ্রে ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কমান্ডোরা অবস্থান করেন। পরবর্তীতে ছদ্মবেশে চট্টগ্রাম শহরে এসে নিরাপদ সেন্টারে অবস্থান নেয় কমান্ডোরা। মেডিক্যাল কলেজ অ্যাম্বুলেন্স ও ওয়াপদা লাইনম্যান ঠিকাদারের পিকআপে অস্ত্র পৌছে দেওয়া হয় চট্টগ্রামে। পরবর্তীতে তরকারির টুকরি, বাজারের ব্যাগ, মাছের ডালা প্রভৃতিতে করে অস্ত্রগুলো আনোয়ারা থানার চরলক্ষ্যার চরে পৌঁছানো হয়। 

১৩ আগস্ট ১৯৭১ কমান্ডোদের অস্ত্র চর লক্ষ্যা পৌছে। ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতে মোজাহার উল্লাহ গ্রুপ এবং শাহ আলম গ্রুপ পৌছান চরলক্ষ্যা খামার বাড়ি। মোজাহার ও অন্যান্যরা ছদ্মবেশে রেকি সম্পন্ন করেন। পাকিস্তানিরা যে সকল নৌ-বাণিজ্যপোতকে সরঞ্জাম ও অস্ত্র গোলাবারুদ পারাপারে ব্যবহার করছে সেগুলির সার্বিক অবস্থান পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখে নেন। দেশি-বিদেশি যুদ্ধজাহাজ, বাণিজ্যিক জাহাজ, কার্গো শিপ, তেলবাহী জাহাজ ইত্যাদি বাইশটি টার্গেট বেছে নেয় কমান্ডোরা। ১৫ আগস্ট ১৯৭১ রাত এগারোটায় নৌকমান্ডো প্রস্তুতি চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হয়। সংকেত পেয়ে নদীতে নেমে পড়েন কমান্ডোরা। অপারেশনের অস্ত্র বলতে প্রতিজন ১টি করে ৬ কেজি ওজনের লিম্পেট মাইন, সাঁতারের সুবিধার জন্য পায়ের পাতা ফিন্স এবং জাহাজের গায়ে শেওলা উঠাতে ১টি ছুরি মাত্র। 

মোজাহার গ্রুপের টার্গেট ছিলো আল হরমুজ জাহাজ। পাক-আর্মি এটাকে সামরিক সরঞ্জাম পারাপারে ব্যবহার করতো। জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র গোলাবারুদ খালাসের অপেক্ষায় ছিলো। মোজাহার এবং তার সাথীরা যথাস্থানে মাইন লাগিয়ে ফিরে আসেন। অন্যান্য কমান্ডোরাও যার যার টার্গেটে মাইন লাগিয়ে ফেরত আসেন। ১৫ আগস্ট দিবাগত রাত ১টা ৪০ থেকে ২টার মধ্যে কমান্ডোদের লাগানো মাইন ফাটতে শুরু করে। আল-আব্বাস, আল-হরমুজ ও ওরিয়েন্টাল বার্জ নং-৬ এ তিন ধরনের জলযান ডুবতে শুরু করে। এ অপারেশনই ইতিহাসে অপারেশন জ্যাকপট নামে পরিচিত। আল-আব্বাস, আল-হরমুজ ও ওরিয়েন্টাল বার্জ নং-৬ এর সর্বাধিক সাফল্য বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। 

আগস্ট ১৯৭১ নাগাদ সুরক্ষিত অবস্থানের ক্ষেত্র সুবৃহৎ কৌশলগত অবস্থানে মুক্তি হামলা পাক-ভিত্তিমূল নড়েনি। এমনি হতাশা কাটিয়ে উঠতে অপারেশন জ্যাকপট সাফল্য দেশে-বিদেশে আসন্ন স্বাধীনতার পক্ষে বিপুল শিহরণ জাগায়। চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ-কমান্ডো অপারেশনের তিন মহানায়ক মোজাহার উল্লাহ, আবদুল ওয়াহিদ চৌধুরী ও শাহ আলম। অনন্য সাধারণ সাহস, সহিষ্ণুতা, মৃত্যুঞ্জয়ী উন্মাদনা-সহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পাক জাহাজ ডুবানোর স্বীকৃতিতে তারা বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে সংঘটিত নৌ-কমান্ডো কার্যক্রম পাক প্রতিরক্ষার নাভিমূলে আঘাত হানে। তাঁর সুদুরপ্রসারী প্রভাব বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে পাক আর্মির অস্ত্রবোঝাই জাহাজ ধ্বংস কার্যক্রমে যার অক্ষয় অবদান, বাংলার গৌরব সে মুক্তিযোদ্ধা মোজাহার উল্লাহকে স্মরণ করে এই লেখা। 

যুদ্ধশেষে মোজাহার উল্লাহ বীর উত্তম তার প্রাক্তন কর্মজীবনে ফিরে যান এবং সাধারণ বীমা কর্পোরেশন আগ্রাবাদ শাখার ম্যানেজার হিসেবে অবসরগ্রহন করেন। অকুতোভয় এ বীর ২০০৮ সালের ২৭ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। আজ মহান এ বীরের মৃত্যুবার্ষিকী। স্বাধীনতা যুদ্ধে শৌয্য, বীর্য ও সাহসিকতার প্রতীক মোজাহার উল্লাহ। এ বীরের রক্তবীজ অনাগত জাতীয় দুর্দিনে এ জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে। এ মহান বীরের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। 

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ  সুপ্রিম কোর্ট

সিভয়েস/এসএ/এমআইএম

আবু বকর সিদ্দিকী

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়