জাতিসংঘে শেখ হাসিনা
রোহিঙ্গা ইস্যু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রসঙ্গ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সপ্তাহব্যাপী নিউইয়র্ক সফর নানা কর্মসূচিতে ঠাসা ছিল, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে ভাষণ দান ছাড়াও বেশক’টি উচ্চমানের আলোচনা ও মতবিনিময় সভায় তিনি ভাষণ দিয়েছেন, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় অনুকরণীয়, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের জন্য তিনি দু’টি বিশেষ সম্মাননাও গ্রহণ করেছেন। এসময় তিনি রয়টার্সের সাথে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের সাথে পৃথক আলোচনায় মিলিত হয়েছেন।
নেলসন ম্যান্ডেলা শান্তি সম্মেলন, অ্যাকশন ফর পিস কিপিং মিশন, ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের আয়োজনে সাসটেনেবল ডেভেলাপমেন্ট ইন দ্য ফোর্থ ইন্ডাসট্রিয়াল রিভ্যুলুশান এবং নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে জাতিসংঘ সদর দফতরে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা সভায় শেখ হাসিনা ভাষণ দিয়েছেন, এসব আলোচনা সভায় অধিকাংশেই জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতারেস উপস্থিত ছিলেন।
এবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ৩টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করেছেন- এগুলো হল, মিয়ানমারকে অবশ্যই বৈষম্যমূলক আইন ও নীতি বিলোপ এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধ করতে হবে, দ্বিতীয়ত: সব রোহিঙ্গাকে নাগরিকত্ব দেয়ার সঠিক উপায়, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা’সহ আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং তৃতীয়ত: রোহিঙ্গাদের প্রতি নৈরাজ্য রোধে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের জবাবদিহি, বিচার বিশেষ করে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী মিশনের সুপারিশের আলোকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে আর তাহলেই কেবল সব রোহিঙ্গার নিরাপদে প্রত্যাবাসন-পুনর্বাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ৫ দফা প্রস্তাব রেখেছিলেন, তার সাথে বর্তমান ৩দফা প্রস্তাবের সংগতি রয়েছে, তাছাড়া মিয়ানমার নেত্রী অংসান সু চি নিযুক্ত রাখাইন সংকট সমাধানে জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব কফি আনানের (সম্প্রতি প্রয়াত) সুপারিশসমূহের সাথে এসব প্রস্তাবের সাযুজ্যও রয়েছে।
এবার জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে ২টি কারণে; জাতিসংঘের আওতায় গঠিত আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের প্রাক-বিচার আদালত এক রায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরুর কথা বলেছে এবং জাতিসংঘ তথ্যানুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদনে মিয়ানমারকে ‘গণহত্যা’সংঘটন করার দায়ে অভিযুক্ত করেছে। এই ২টি বিষয় রোহিঙ্গা ইস্যুতে বড় অগ্রগতি, এই দুটি বিষয় মিয়ানমার সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে। গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের সেনাপ্রধা ‘সহ ৬ জনের বিচারের কথাও এসেছে। আন্তর্জাতিক জনমত এবং প্রভাবশালী ইউরোপীয় দেশগুলির মনোভাব ক্রমেই মিয়ানমারকে চাপে ফেলছে।
বাংলাদেশের কূটনীতি যথার্থ পথেই এগিয়েছে; এটি এখন স্পষ্ট হয়েছে যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারকে অবশ্যই ফেরত নিতে হবে, এ লক্ষে তারা জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে যদিও নানা অজুহাতে তারা প্রত্যাবাসন বিলম্ব করতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রয়টার্সের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মিয়ানমার মুখে রাজি হলেও বাস্তবে তারা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করছে। বিশ্বসম্প্রদায় তাদের চাপ না দিলে তারা সহজে প্রত্যাবাসনে রাজি হবেনা। মিয়ানমার এখন নানা অজুহাতও তৈরি করছে। চীন এবং ভারতের মতো দেশ এখন রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের ভূমিকাকে সমর্থন করছে।
জাতিসংঘে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ-মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে ত্রি-পক্ষীয় একটি বৈঠকের আয়োজন করেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অফিসের প্রধান এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতারেস বিশেষ আমন্ত্রণে বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। এটি একটি গুরুত্ব পূর্ণ বৈঠক যা গণমাধ্যম এড়িয়ে গেছে। বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্বি-পক্ষীয়ভাবে অর্থাৎ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের কথা বলেছেন। চীন বহু পক্ষীয় অন্তর্ভূক্তির বিরোধিতা করে আসছে। অন্যদিকে ইইউ, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, কানাডা প্রমুখ দেশ বলছে, রাখাইনে সংঘটিত ঘটনাবলী, অপরাধ, মানবাধিকার লংঘন, এসব বিষয়ে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের করণীয় রযেছে। এ ধরনের পটভূমিতে শেখ হাসিনা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ পুনর্বাসন, সুরক্ষা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা সম্পর্কিত যে বক্তব্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দিয়েছেন সেটি সবিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। সম্প্রতি নয়াদিল্লীতে এক আলোচনা সভায় জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতারেস রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যপূর্ণ, এবং তাদের অধিকারবিহীন জীবন-যাপনের উল্লেখ করে চীন, ভারত ও অন্যান্য দেশগুলিকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে সহযোগিতা এবং মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব মিয়ানমার সমাজের গভীরে বর্ণবাদের অবস্থান রয়েছে-এ কথাও উল্লেখ করেন যা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রচারণায় কাজ করেছে।
জাতিসংঘের সকল ফোরামেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুটি তুলে ধরেছে, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে মানবতা রক্ষায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করা হয়েছে, তাঁকে এই মানবিক ভূমিকার জন্য সম্মাননাও দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ এতে গর্ব অনুভব করছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সাথে শেখ হাসিনার আলোচনায় বাংলাদেশের প্রতি জাতিসংঘের পূর্ণ সমর্থন-সহযোগিতা অব্যাহত রাখার কথাও বিশেষভাবে এসেছে।
এটি এখন নিঃসন্দেহে বলা যায়, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের কূটনীতি সুফল দিতে শুরু করেছে, চীন ও ভারত সংকটের গভীরতা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বদেশে নিরাপদ ও নাগরিক অধিকার নিয়ে বসবাস এই অলকে নিরাপদও শান্তিপূর্ণ রাখতে পারে- এটি এখন যৌক্তিকভাবে বাংলাদেশ তুলে ধরতে পারছে।
২.
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতারেস বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। নিউইয়র্কে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রসঙ্গটিও আসে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়নের উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, অনেক দেশ এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে।
দেশে সকল দলের আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে অধিকাংশ বিরোধীদল নির্বাচনের পূর্বে সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি এ লক্ষ্যে বিদেশী কূটনীতিকদের প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধির সাথে বৈঠকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের কূটনীতিকদের তারা নিয়মিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবহিত করে আসছেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে মহাসচিব তাঁর অভিপ্রায় শেখ হাসিনার কাছে ব্যক্ত করেছেন। আমরা মনে করি, বিশ্ব পরিমণ্ডলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মান অর্জন এবং বাংলাদেশের সাফল্যের কথা যেভাবে উচ্চারিত হচ্ছে তা অব্যাহত রাখতে অবাধ, সুষ্ঠু ও সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রধান বিরোধী দল’সহ বেশকিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে দেশবাসীকে স্পষ্ট ধারণা না দিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে চলেছে যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার অনুকূল নয়। বিরোধী দল নির্বাচন করার ঘোষণা দিলে সরকারের উচিত হবে অবাধে নির্বাচনী প্রচার-সভা-সমাবেশ চলতে দেওয়া। সকল দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন তৎপর থাকবে বলে আমরা আশা করি।
নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা শুরু হলে নির্বাচনী আমেজ ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র, যেটি শহর ও গ্রামে বাংলাদেশের নির্বাচনী সময়ের চির পরিচিত উৎসবমুখরতাকেই চিনিয়ে দেবে। আমরা সেই দৃশ্যের জন্য অপেক্ষায় থাকবো।
টীকা:
জাতিসংঘ সদর দফতরে সপ্তাহব্যাপী ব্যস্ত সময় কাটিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে এসে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিশ্বনেতা যাদের সাথে তাঁর জাতিসংঘ সদর দফতরে দেখা হয়েছে তারা চান আমি যেন পুনরায় ক্ষমতায় আসি। আমি তাঁদেরএকটাই জবাব দিয়েছি দেশের মানুষ যদি ভোট দেয় তবে আছি। না দিলে নাই।
লেখক : সাংবাদিক
সিভয়েস/এস.আর
সুভাষ দে