Cvoice24.com


আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত : এমপি বাদল (ভিডিওসহ)

প্রকাশিত: ১৪:৫৬, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮
আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত : এমপি বাদল (ভিডিওসহ)

ছবি: প্রতিবেদকের সাথে সাংসদ মঈন উদ্দিন খান বাদল

মঈন উদ্দিন খান বাদল। মহাজোট থেকে  নৌকার ব্যানারে চট্টগ্রাম-৮ আসন থেকে দুইবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য এই জাসদ নেতা। সংসদেও বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর তিনি। প্রতিটি সংসদ অধিবেশনেই থাকে তাঁর সপ্রতিভ ক্ষুরধার বক্তব্য। এদিক থেকে বেশ জনপ্রিয় তিনি। একাত্তরের রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখে লড়েছেন দেশ মাতৃকার জন্য। সম্প্রতি তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন সিভয়েস’এর। ব্যক্ত করেছেন আসন্ন নির্বাচন নিয়ে তাঁর ভাবনা, তুলে ধরেছেন দেশের রাজনীতির অতীত ও বর্তমান প্রেক্ষাপট। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিভয়েস প্রতিবেদক হিমাদ্রী রাহা।


সিভয়েস-আপনি চট্টগ্রাম-৮ আসন থেকে দুইবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। এই দশবছরে এলাকায় কি কি উন্নয়ন হয়েছে?
মঈন উদ্দিন খান বাদল-  উন্নয়ন সম্পর্কিত আমার ধারণা অন্য একজনের থেকে ভিন্ন হতে পারে। এটা মাথায় রাখতে হবে। কেউ হয়তো মনে রাখতে পারে নালা-নর্দমা, পাকা বিল্ডিং করা মানেই উন্নয়ন। আমি আমার এলাকায় প্রধানত যে টার্গেটটি ফিক্সড করেছিলাম, সেটি হলো বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের আলোকে একটি অসাম্প্রদায়িক চট্টগ্রাম-৮ তথা বোয়ালখালী গড়ে তোলা। আমি প্রথমে এটা সেট করতে চেয়েছি। আপনি দেখুন, এই দশবছরে আশে পাশে অন্যান্য আসনে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঘটলেও আমার এখানে হয়নি। এটাকেই আমি সাফল্য মনে করি। যাই হোক, যে প্রশ্ন করেছেন সেই প্রশ্নের আলোকেই বলি, বোয়ালখালীতে প্রায় ২১৩ কিলোমিটার পাকা রাস্তা করা হয়েছে। প্রায় ৫০টির মতো প্রাইমারি স্কুল পাকা করা হয়েছে। বোয়ালখালীতে প্রথমবারের মতো ৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী সংলগ্ন সমস্ত এলাকার ভাঙন রোধ করা হয়েছে। বাঁধ দেয়া হয়েছে। এখন সেই বাঁধের উপর পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। বোয়ালখালীতে প্রথমবারের মতো ফায়ার স্টেশন হয়েছে। বোয়ালখালীতে প্রত্যেকটি হাই স্কুলে বিল্ডিং করা হয়েছে। ১০টি হাইস্কুলে তিন কোটি টাকা করে চারতলা বিল্ডিং করা হয়েছে। দশবছর আগে বোয়ালখালীতে মানুষকে এক হাঁটু কাদা পাড়ি দিতে হতো। আজকে শেখ হাসিনার আমলে কাউকে কাদা মাড়িয়ে পথ চলতে হয়না। আমার সংসদীয় আসনের আংশিক শহরাঞ্চলও রয়েছে। আমার আমলে এই শহরাঞ্চলে আশেকানে আউলিয়া ডিগ্রি কলেজ সরকারিকরণ করা হয়েছে। ষোলশহরে টেক্সটাইল এন্ড জুট ইনস্টিটিউট করা হয়েছে। মোহরাতে ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুরু হয়েছে। চান্দগাঁওতে ৬০ কোটি ব্যয়ে ১ হাজার কর্মজীবী নারীর বাসস্থান নির্মাণ করা হচ্ছে। এর আগের আমলে অত্যাধুনিক সরকারি গোডাউন নির্মিত হয়েছে। এগুলো অত্র এলাকার মোটামুটি বড় কাজ। এছাড়া দুই এলাকাতেই এমন কোন মসজিদ, মন্দির নেই যেখানে অনুদান দেয়া হয়নি। বাকিটা আপনারা যাচাই করে দেখতে পারেন।


সিভয়েস- রাজনীতির মাঠে আপনার সুদীর্ঘ পথচলা। এই পথচলার আলোকে দেশে ৭৫ পরবর্তী রাজনীতির যে বিবর্তন তা কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
মঈন উদ্দিন খান বাদল- শোনেন, দেশটা পাল্টে গেছে। উন্নয়েনের প্রেক্ষাপটে এটা এখন নতুন বাংলাদেশ। এটা আর গরিব দেশ না। এটা উন্নয়নশীল দেশ। উন্নয়নশীল দেশ মানেই শুধু রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোর উন্নয়ন নয়। এর সাথে মানসিকতার উন্নয়নও জড়িত। আমাদের মন-মানসিকতারও উন্নয়ন ঘটছে। দেশের অর্থনৈতিক খাতে যেমন পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তেমন মানুষের মনোজগতেও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এটাই সময়, একটা প্রজন্ম আরেকটা প্রজন্মের উপর চাবি পরিবর্তনের চাবি দিয়ে যাবে। চারশো মিটারের দৌঁড় প্রতিযোগিতা নিশ্চয় দেখেছেন। আমরা একটা চারশো মিটারের দৌঁড় শেষ করেছি। পরবর্তী প্রজন্ম এবার আরেকটা দৌঁড় শুরু করবে। আমাদের সময় শেষ। এখন সময় নতুন প্রজন্মের। তবে তাদের প্রতি আমি আশাবাদী। 


সিভয়েস-আপনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। যে পাকিস্তান এক সময় বাংলাদেশকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলো সেই পাকিস্তানই আজ বাংলাদেশ হতে চায়। বিষয়টি  নিয়ে একজন  মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কেমন অনুভূতি হয় আপনার ?
মঈন উদ্দিন খান বাদল- পাকিস্তান এখন অনেক পেছনে পড়ে থাকা একটি দেশ। ওদের নিয়ে কথা বলারও কিছু নেই। অমর্ত্য সেন আর কৌশিক বসু বলেছিলেন, “নানা প্যারামিটারে, নানা বিষয়ে বাংলাদেশ আজকে অনেক দূরে এগিয়ে গেছে।” আমরা পেশি শক্তি দিয়ে যেটা অর্জন করার সেটা করেছি। আমরা গার্মেন্টস খাতে পৃথিবীতে দ্বিতীয়। আমরা মাছ উৎপাদনে তৃতীয়। আমরা চাল উৎপাদনে সপ্তম। গম উৎপাদনে অষ্টম। সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। এগুলো আমরা দেশের কৃষকরা, শ্রমিকরা, রেমিটেন্স যোদ্ধারা নিজেদের পেশীকে কাজে লাগিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশকে আজ এই অবস্থায় নিয়ে এসেছেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো। উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে যেতে চাইলে এই পেশী আর কাজ করবে না। তখন দরকার মেধা। এখন এই মেধাবী প্রজন্মই তৈরি করতে হবে। শেখ হাসিনা অনেক দূরদর্শী মানুষ। তিনি এখন সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা তো মুক্তিযুদ্ধ থেকে দেশকে আজকে এই পর্যায়ে এনে দিয়েছি। একসময় আমরা খড়ম পড়তাম। এখন এই জাতি স্যান্ডেল পড়ে। একসময় আমের পাতা, জামের পাতা, কয়লা দিয়ে দাঁত মাজন করতাম। এখন এই জাতি টুথপেস্ট আর ব্রাশ ব্যবহার করে। একসময় আমরা বিদেশ থেকে আমদানি করা পুরানো গাঁটের কাপড় পড়তাম। এখন ব্র্যান্ডের কাপড় পড়ছি। পুরুষ তো পুরুষ। এখন আমাদের দেশের নারীরাও হিমালয়ে উঠে। এবার বুঝে দেখুন আমাদের উত্তরণ কিভাবে হয়েছে। আমরা পরাধীনতা দেখেছি। তাই এখন স্বাধীন দেশের এমন উন্নয়ন দেখলে গর্ব হয়। 


সিভয়েস-বিএনপি বলছে নেত্রীকে  কারাগারে রেখে কিংবা তত্ত¡াবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। এই যে তাদের নির্বাচনী অংশ নেয়া নিয়ে যে দোলাচল, তা কিভাবে দেখেন আপনি?
মঈন উদ্দিন খান বাদল- দোলাচল নেই। কোন দল যদি বলে তারা নির্বাচনে যাবে না, এটা তাদের ব্যাপার। আমি সংবিধান বুঝি। সংবিধানে আমার আয়ুস্কাল জানুয়ারি। তারপর আমি আর নেই। সংবিধান যা বলে তা। সংবিধানের বাইরে কোন কিছু হবে না।


সিভয়েস- আসন্ন নির্বাচনে আপনি কি আবারো মনোনয়ন চাইবেন?
মঈন উদ্দিন খান বাদল- আওয়ামী লীগ জোটগতভাবে নির্বাচনে গেলে আমি অবশ্যই প্রার্থী হবো। যদি আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করে তবে আমি প্রার্থী হবো না।
সিভয়েস- অন্যান্য দল থেকে যারা মনোনয়ন প্রত্যাশী তারা তো আপনাকে সেক্রিফাইস করতে বলছে এবার। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
মঈন উদ্দিন খান বাদল- অনেকে বলে আমি পঙ্গু হয়ে গেছি, আমি অসুস্থ। কিন্তু এসবে আমার কিছু যায় আসে না। জোটগতভাবে নির্বাচনে শেখ হাসিনা যাকেই বলবে সেই নির্বাচন করবে। এখানে সেক্রিফাইসের কিছু নেই।


সিভয়েস-আপনার সংসদীয় আসন বোয়ালখালীবাসীর আজন্ম দুঃখ কালুরঘাট ব্রিজ। এই সেতুটির পুনঃনির্মাণের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই ঝুলে আছে। ব্রিজ হবে হবে করেও হচ্ছেনা। কেন?
মঈন উদ্দিন খান বাদল- দেখুন চট্টগ্রাম থেকে রেলপথ সম্প্রসারিত হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত যাচ্ছে। তো এই ব্রিজ নিমাণ ছাড়া তো আর কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগ সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে সেতুর নকশাও প্রণয়ন হয়েছে। শীঘ্রই সুখবর পাবেন।


সিভয়েস-রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে কতটুকু সফল বলে মনে করেন আপনি?
মঈন উদ্দিন খান বাদল- মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের জেনারেল সুজন সিংহবান, আমাদের মুজিব বাহিনী উনার হাতে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলো। উনি হেডকোয়ার্টার করেছিলেন রাঙামাটি। আমি আর প্রয়াত ছাত্রনেতা এসএম ইউসুফ তাঁর কাছে গেলাম একদিন। উনি বললো, “বাচ্চা ‘চা পিয়ো’(চা খাও)।” চা খেতে খেতে তিনি বলছিলেন, “দেখো নিজেকে এমনভাবে তৈরি করবে যেন যেকোন পরিস্থিতিতে মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করার মানসিকতা থাকে। তবেই তুমি একজন ভালো যোদ্ধা হবে। তোমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। তোমার মৃত্যুতে কেউ চোখের পানি ফেলবে না। কেউ শোকবার্তা দেবে না। এরকম নিরবে যদি মরে যেতে পারো তবেই তুমি একজন আসল যোদ্ধা।” কথাটা এখনো আমার কানে বাজে। আমার জীবনের এই সত্তর বছর বয়সে এসে কানায় কানায় প্রাপ্তি। অপ্রাপ্তি বলে কিছু নেই। একটা লোক আর কত করবো। আমি আমার মায়ের সম্ভ্রমের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি। পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে একশ’ কোটি লোকেরও সেই ভাগ্য হয়নি। আমার হয়েছে। অতএব আমি ভাগ্যবান। আমি সমস্ত গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে অংশ নিয়েছি। অতএব আমি ভাগ্যবান। আমি যখন রোগাক্রান্ত ছিলাম, আমার এলাকার মানুষ গড়াগড়ি করে কেঁদেছে। অতএব আমি ভাগ্যবান। আমি এখন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। খালি হাতে এসেছিলাম। খালি হাতেই যাবো।
সিভয়েস- আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
মঈন উদ্দিন খান বাদল- আপনাকে ও সিভয়েস’এর সকল পাঠকদেরও ধন্যবাদ।


সিভয়েস/এসএ/এমডিকে


 

হিমাদ্রী রাহা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়