Cvoice24.com


নির্বাচন: যেন আতঙ্ক আশংকার ঘেরাটোপ

প্রকাশিত: ১০:০০, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮
নির্বাচন: যেন আতঙ্ক আশংকার ঘেরাটোপ

ছবি : সিভয়েস

১৯৭৯তে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) নির্বাচনের দিন নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক সিকান্দার খানকে তার মনের অবস্থা জানতে চাইলে তিনি অবলীলায় জবাব দিয়েছিলেন, “ আজ যেন আমার মেয়ের বিয়ে”। উৎসবের পরিবেশে নির্বাচন চলছিলো। ছাত্র-ছাত্রীরা সুশৃঙঙ্খলভাবে লাইনে দাড়িয়ে যে যার ভোট দিচ্ছিলো। (যদিও ভেতরে ভেতরে একটা নষ্ট মনস্তাত্বিক পরিবেশ আগে থেকেই বিশেষ কায়েমি মহল ছড়িয়ে দিয়েছিল ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে। তাহলো, চরম আঞ্চলিকতা, “চট্টগ্রাম ও নন-চট্টগ্রাম”)। এর পরিণাম পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে নানভাবে ভূগতে হয়েছে। একটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মননকে অসুস্থ করে দেয়া হয়েছে আঞ্চলিকতা দিয়ে। এই ছিল ভিতরের পরিক্রমা। স্যারের কাছে মনে হয়েছিল তার মেয়ের বিয়ের উৎসবের মত। আর অন্ধকার শক্তি দাবার গুটি চেলেছে এক বিষাক্ত ভবিষ্যতের কায়েমি আশায় এবং পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যা হবার তাই হয়েছে। এখন যারা বিভিন্ন নির্বাচন তত্ত্ববধান করেন, তারা পারবেন উৎসবের মত নির্বাচন করতে? এখনকার নির্বাচন কমিশনাররা আজ্ঞাবহ হতে ভালোবাসেন। 

শিক্ষকতায় থাকার কারণে যেকোন সংস্থার নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব আমাদের কাছে আসতো উপর থেকে। এ দায়িত্ব কখনো মনে আনন্দ-উৎসাহ দিতোনা। বরঞ্চ দায়িত্বটা কাউকে বলে কয়ে বাদ দেয়াতে পারলে প্রশান্তি লাগতো। এর মূল কারণ নির্বাচন গ্রহণকালীন নির্বাচন কেন্দ্রের নোংরা আভ্যন্তরীণ পরিবেশ। সকল ভোটার সাধারণ সুবোধ বালকের মত নিরব শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে চলে গেলেই মঙ্গল। কিন্তু তাতো হবার নয়। কত অনুযোগ-অভিযোগ-জালভোট-সত্যগোপন- প্রভাব খাটানোর নানা কৌশলী তৎপরতা-সম্ভাব্য সংঘাত পুরো পরিবেশকে অস্থির নোংরা করে তোলে। সেজন্য দায়িত্বটা ঝুকিপূর্ণ মনে হতো। মন চাইতো না নির্বাচনের কেন্দ্রের দায়িত্ব নিতে।

আমাদের দেশের ভোটের সংস্কৃতি হলো নিজ প্রার্থীকে জেতাতেই হবে, যেততেন প্রকারেই। এজন্য চলে সর্বগ্রাসী সর্বাত্মক আয়োজন। প্রয়োজনে এ আয়োজনে চলে জীবন-মৃত্যুর খেলা। জীবন হয়ে যায় তুচ্ছ। কত মায়ের বুক খালি হয়ে যায়। এতে প্রার্থী, তার দল, প্রার্থীর শত হাজারো আবেগী বা লেনদেনভিত্তিক অনুসারী কারো কোনো মাথাব্যাথা নেই। শেষকথা-জিততেই হবে। বিপক্ষকে হারাতেই হবে এবং প্রয়োজনে যেকোনো দুঃখজনক পরিণামের বিনিময়ে। নির্বাচন-গণতন্ত্র-রাজনীতি কি এতই খারাপ অধ্যায়? অথচ রাজনীতি ছাড়া তো রাষ্ট্র চলেনা। সুস্থ গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা ছাড়া রাষ্ট্রীয় জীবন-সমাজ জীবন উশৃঙ্খল-বিশৃঙ্খল হয়ে যায়। সুতরাং নিয়ম মত নির্বাচনের দিকে দেশকে এবং দেশের জনগণকে যেতেই হবে এর কোন বিকল্প নেই।

 প্রশ্ন হলো আগামী নির্বাচনটা কি সুস্থ ও সুন্দরভাবে হবে? যদিও উদাহরণ দেবার মত বা গৌরব করার মত ভালো নির্বাচন আমাদের দেশে হয়না। ৮০’র দশকে শ্লোগান উঠেছিল,“আমার ভোট আমি দিব, যাকে খুশি তাকে দিব।” স্বেচ্ছাচারী-স্বৈরাচারী শাসনের কবলে পড়লে উপরিউক্ত শ্লোগানও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সময়ে এ ধরণের শ্লোগান অর্থহীনও হয়ে যায়। “যাকে খুশি তাকে দিব”- সে কে? এ প্রশ্নটি দেশের ভবিষ্যৎ মঙ্গল প্রশ্নে, ভালো-নিষ্ঠ-যোগ্য লোক নির্বাচিত করার প্রশ্নেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভোটারের খুশি হল একজন ঐতিহাসিক ক্রিমিনাল-ধর্ষক বা অস্ত্র চোরাচালানকারীকে ভোট দেওয়ার, ভোটে এরা জিতে গেল- তারপর?? 

“যাকে খুশি”-মানে কি? একজন লোক দাগী অপরাধী ব্যাংকের টাকা মেরে দেয়। মেরে দেয়া টাকা দিয়ে হুন্ডা-গুন্ডা-ক্রিমিনাল নিয়ে জনপ্রতিনিধি হবার ‘মহান’ কর্মে নেমে গেলো। সর্বাঙ্গীন কালো পথেই যার জীবন প্রক্রিয়া, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যার কোনো রকম আস্থা-বিশ্বাস নেই, আন্তর্জাতিক ইয়াবা চোরাচালানী ইত্যাদি- খুশি হলেই এদেরকে ভোট দেয়া যায়? ভোট দেয়া কি উচিত? দল-মার্কা যাই হোক এসব বিষয় ভাবতে হবে ভোটার সাধারণকে। অপরাধীকে ভোট দিলে অপরাধ কোনদিনও যাবে না।

বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নানা জনের নানা কথা। কেউ বলে “পোকা খাওয়া নির্বাচন”। কারো মত “প্রহসনের নির্বাচন”। নির্বাচনে যাতে জামাত বিএনপি না যায় সেজন্য আওয়ামী লীগ ফাঁদ পেতেছে এবং বিএনপি জামাত সেই পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ চায়নি বিএনপি নির্বাচনে আসুক। “পরিকল্পিত প্রহসনের নির্বাচন”। ইত্যাদি নানা কথা নানা ব্যাখ্যা। কারো কারো কথা, “বিএনপি জামাত নির্বাচনে তো গেলইনা, অসংখ্য ভোট কেন্দ্র পুড়িয়েছে, মানুষ মেরেছে, প্রিসাইডিং অফিসার খুন করেছে।

এক পরিচিত কলেজ শিক্ষক প্রিসাইডিং অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন দায়িত্ব পালন করলেন? তাঁর উত্তর-“আওয়ামী লীগের অনেক কিছুই ভালো লাগেনা, তবে জামাত-বিএনপির আবার ক্ষমতা চাইনা। ২০০১ এ শিক্ষা হয়েছে। আওয়ামী লীগই থাকুক, কোনো ক্রমেই বিএনপি-জামাত আর নয়। তবে আওযামী লীগে খারাপ লোকের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। নির্বাচনে যা দেখলাম তা বলতে লজ্জা হচ্ছে। যাচ্ছে তাই নির্বাচন। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে ছিলাম কেন্দ্রে। শুনেছি প্রিসাইডিং অফিসার খুন হয়েছে, রাতে টেলিভিশনে দেখেছি। কখন যে আমাদের দেশে সৎ দেশপ্রেমিক ভদ্রলোক প্রার্থী হবে, মানুষ আনন্দে ভোট দেবে।
আসন্ন নির্বচনকে কেন্দ্র করে নানা তৎপরতা চলছে এখন। সরকার চলছে সরকারের পরিকল্পনা নিয়ে, পুনঃনির্বাচিত হওয়ার মরিয়া প্রচেষ্টাতেই আছে বোঝা যায়। ক্ষমতা ধরে রাখাতে নানা কৌশলে আছে। নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা জল্পনা-কল্পনা রয়েছে এবং উৎসাহও আছে। সরকারের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী আচরণ বেড়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষকে জয় করে নির্বাচনী কাজে অগ্রসর হওয়ার প্রবণতাতে মনোযোগ নেই। ক্ষমতার প্রধান উৎস যে জনগণ এটা দিন দিন গৌন হয়ে যাচ্ছে। নানামুখী দৌড়ঝাপ চলছে। চলছে দেশে ও দেশের বাইরে। ড. কামাল হোসেন – ড. বি চৌধুরীরা কি করেন, কার সাথে গাটছড়া বাধছেন এসব নিয়ে সরস আলোচনা রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। সব চলছে কৌশলগত খেলা। এ ক্ষেত্রে নীতি নৈতিকতার অধ্যায় বাস্তবে গৌণ অবস্থানে।
বস্তুত দীর্ঘকাল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নীতি-নৈতিকতা-রাজনৈতিক সততা ইত্যাদি বহুদূরে অবস্থান করছে। সকল সমীকরণ চলে ক্ষমতার বলয়কে ঘিরে। ৭৫’এর কুশীলবরাও বসে নেই। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটাকে ‘তারা’ অতি সহজে মেনে নেবেনা। বিশেষ বিদেশী মহল বাংলাদেশের ক্ষতি করার সব কাজে ছিল-আছে এবং থাকবে। যতই ওদেরকে তোয়াজ করা হোক না কেন। মুক্তিযুদ্ধের একটা আদর্শ আছে, দর্শন আছে সেটা বাদ দিলে সকল বক্তৃতা কথামালা অন্তঃসারশূন্য হয়ে যায়। বাংলাদেশটা হয়ে যায় ষড়যন্ত্রের গিনিপিগ। এ বিষয়টাকে বিশেষ গুরুত্ব না দিলেই সমূহ বিপদ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটা প্রগতির ধারা। একটা প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত নির্ভর রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মানের জন্য লাখো শহীদের বাংলাদেশ নয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রগতির ধারায় অগ্রসর করার প্রশ্নে সকল বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক মহলকে। 

পশ্চাৎপদতা, রক্ষণশীলতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, রাজাকার তোষণ, হেফাজত তোষণ, আকণ্ঠ লুটপাটতন্ত্র, ঘুষ-দুর্নীতির উপর ভর করে চলতে থাকলে এক ভয়াবহ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করার বিকল্প নেই। ক্ষমতা দখল করে রাখা-ক্ষমতায় বসে থাকা, খুনোখুনির রাজনীতি, একটা কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা কারো জন্য কল্যাণকর কিছু বয়ে আনবে না। রাজনীতিতে সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, চট্টগ্রাম জেলা।

সিভয়েস/এমডিকে/এমইউ

অশোক সাহা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়