Cvoice24.com


কুলদীপ নায়ার: একটি নক্ষত্রের পতন

প্রকাশিত: ১৫:৫১, ২৫ আগস্ট ২০১৮
কুলদীপ নায়ার: একটি নক্ষত্রের পতন

ছবি : সিভয়েস

উপমহাদেশের সাংবাদিকতার জগৎ থেকে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের তিরোধান ঘটলো। ষাট বছরেরও অধিক সময় কুলদীপ নায়ার উপমহাদেশের সাংবাদিকতায় একটি মননশীল ধারা গড়ে তুলেছেন যা দেশ ও সম্প্রদায়গত স্বার্থের ওপরে মানবতা আর মানবধর্মকে স্থান দিয়েছে। তিনি নানা রাজনৈতিক উত্থান পতন, অস্থির সমাজ ও সময়ের নানা রূপ গভীরভাবে অবলোকন করেছেন, কেবল এসবের নিরীক্ষক হয়ে তিনি বসে থাকেননি বরং প্রচলিত ভেদ-বুদ্ধি আর কুটিল চিন্তা-দর্শনের বিরুদ্ধে যুক্তি, প্রজ্ঞা আর মানবহিতের বাণী নিয়ে লেখনীর মাধ্যমে সংগ্রাম চালিয়েছেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এসব কনসেপ্টকে তিনি বিমূর্ততার আধারে স্থাপন করেননি বরং সে সব ধারণা বিন্যস্ত করেছেন সমসাময়িক জীবনবোধের আবেগীয় ও মানবীয় তত্ত্বে।

কুলদীপ নায়ারের জীবন বহুবর্ণচ্ছটায় উদভাসিত। তিনি ছিলেন প্রথিতযশা সাংবাদিক, কূটনীতিক, সমাজকর্মী, সর্বোপরি গভীর জীবনবাদী ও মানবতাবাদী এক মহান মনীষী। জন্মেছেন ১৯২৩ সালের ১৪ আগস্ট শিয়ালকোটে। পেশাজীবন শুরু করেন উর্দুভাষার পত্রিকা ‘আনজামে’র মাধ্যমে সাংবাদিকতার মধ্যদিয়ে। প্রখ্যাত বামপন্থি নেতা হাসরাত সাহানির পরামর্শে তিনি উর্দু থেকে ইংরেজি ভাষায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। এবং অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন। তাঁর কলাম কেবল পাঠকপ্রিয়তা পায়নি বরং ভারত-পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অন্দরমহলকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর কলাম ৮টি ভাষায় ৮০টির বেশি পত্রিকায় ছাপা হতো, সমসাময়িক আর কোনো সাংবাদিকের কলাম এত বেশি পত্রিকায় ছাপা হয়নি। তিনি বাংলাদেশের পত্রিকা প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে নিয়মিত কলাম লিখেছেন।

দীর্ঘ পেশাজীবনে তিনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও দ্য স্টেটসম্যানের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ এর দশকে যুক্তরাজ্যে ভারতের হাই কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, ১৯৯৭ সালে ভারতের আইনসভার উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হন। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে জরুরি অবস্থা জারির বিরুদ্ধে তিনি প্রবল প্রতিবাদমুখর ছিলেন, এ সময় তিনি কারাবরণও করেন।

দেশভাগের গভীর ক্ষত তাঁর জীবনকে বেদনাহত করেছে, আজীবন তিনি সাম্প্রদায়িকতা ও জাতপাতের ভেদাভেদের বিরুদ্ধে মানবিক সম্মিলন ও সম্প্রীতির পক্ষে কেবল লেখেননি, নানা সমাবেশ, প্রচার-প্রচারণায় তিনি মানবাধিকারের পক্ষে সরব ছিলেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে এবং দু দেশের জনগণের সম্প্রীতির সেতুবন্ধ রচনায় তাঁর ভূমিকা ছিলো, দুদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাঁর এই প্রচেষ্টাকে সম্মান জানিয়েছেন।

দু’দেশের জনগণের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতির অভিযাত্রায় তিনি ও তাঁর সহযাত্রীরা দু’দশক ধরে ওয়াগা সীমান্তের দু’পাশে মোমবাতি জ্বালিয়ে শান্তির বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। দুদেশের মানুষ এই শান্তির সমাবেশে যোগ দেন প্রতিবছর। তাঁর আক্ষেপ ‘দেশ বিভাগ উপমহাদেশে যে ক্ষত তৈরি করেছে তা এখনো মুছে ফেলা যায়নি।’

কুলদীপ নায়ার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লিখেছেন, পাকিস্তানের গণহত্যার প্রতিবাদ করেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে দেখা করেছেন।
উপমহাদেশে যখনই সাম্প্রদায়িকতার অনল জ্বলে উঠেছে, সংখ্যালঘুরা যখন নির্যাতিত হয়েছে, নারকীয়তার বলি হয়েছে তখন কুলদীপ নায়ার চুপ থাকেননি, তাঁর লেখনী গর্জে উঠেছে, নানাভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, এভাবে তিনি উপমহাদেশের নিপীড়িত মানুষের সহমর্মী হয়েছেন, তিনি মানবতার ‘আলোকবর্তিকা’ হয়ে উঠেছেন, উপমহাদেশের লেখক-বুদ্ধিজীবী পেশাজীবীদের কাছে নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে বরিত হয়েছেন।

মৃত্যুর মাত্র কয়দিন আগে ১৪ আগস্ট তাঁর জন্মদিনে ‘ডেইলি স্টার’ এ তিনি লিখেছেন, ‘৭১টি বছর পেরিয়ে গেলো, এখনো দু দেশের সম্পর্ক তুষারাবৃত।’ লেখাটিতে তিনি দেশভাগের সময় পাকিস্তান থেকে চলে আসার মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়েছেন, সারা জীবন এই দুঃসহ স্মৃতি তাঁকে তাড়িয়ে ফিরেছে, মুক্তি মেলেনি। তারপরও তিনি দু দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের স্বপ্নে বিভোর। সে আর্তি এই লেখায় ফুটে উঠেছে। পাকিস্তানের সাম্প্রতিক নির্বাচনে বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের আগ্রহের কথা উল্লেখ করে তিনি এ শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন যে, পাকিস্তানের সেনা বসদের তিনি এ লক্ষ্যে বোঝাতে সক্ষম হবেন কিনা। পাকিস্তানের নয়া রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতি নয়াদিল্লীর কঠোর মনোভাবে তাঁর উদ্বিগ্নতা ফুটে উঠেছে এ লেখায়। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছেও দু দেশের জনগণের শান্তি ও সৌহার্দ্য স্থাপনের এই আকুতি কুলদীপ নায়ারের অসামান্য মানবিক সুষমারই উদভাসন।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত তাঁর একটি কলামের শিরোনাম ছিল ‘ভারতের বহুমাত্রিক সমাজের নির্যাস ধরে রাখতে হবে’, এটি শুধু ভারতের ক্ষেত্রে নয় বরং এই উপমহাদেশের পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণকেও উপমহাদেশীয় বহুমাত্রিক ঐতিহ্য, সমাজ ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার পুষ্ট করতে কাজ করে যেতে হবে। কুলদীপ নায়ার তাঁর চিন্তা ও কর্মে নক্ষত্রের মতো যে দ্যুতি ছড়িয়েছেন, তার আলোয় আমরা পথ চিনে নিই।

লেখক : সাংবাদিক

সিভয়েস/এএ/এমইউ

সুভাষ দে

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়