Cvoice24.com


ওদের আবেগ স্ফুলিঙ্গ পাল্টে দিলো বিকলাঙ্গ বিবেক

প্রকাশিত: ০৯:৫৯, ৬ আগস্ট ২০১৮
ওদের আবেগ স্ফুলিঙ্গ পাল্টে দিলো বিকলাঙ্গ বিবেক

ছবি: সিভয়েস

‍“আঠারো তুমি আমায় এ কি দেখালে/
তোমার আবেগ স্ফুলিঙ্গ/ বিকলাঙ্গ বিবেক পাল্টে দিলো/
তোমার মুখরিত স্লোগানে আজ জাগ্রত রাষ্ট্রচেতনা/
তুমি থামিয়ে দিলে স্বজন হারাদের ভুবনবিদারী কান্না।”

বায়ান্ন’র পর থেকে বাঙ্গালি জাতি অনেক ছাত্র আন্দোলন দেখেছে। সেসব আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছিল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারী আন্দোলন সহ সবকটি সফল আন্দোলনের কৃতিত্বে ছিলেন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অকুতোভয় শিক্ষার্থীরাই। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর এসে  বাঙালি বা বাংলাদেশীরা নতুন একটি আন্দোলন দেখে শুধুমাত্র বিস্মিতই হয়নি, পাল্টে গেল পুরো জাতির বিবেক। ষোল থেকে আঠারো বছরের শিক্ষার্থীদের পুঞ্জিভূত আবেগ পাল্টে দিলো পুরো দেশের ঘুনে ধরা দৃশ্যপট।  

সম্প্রতি (২৯ জুলাই) রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এন্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর গত এক সপ্তাহ ধরে নতুন এক কাব্যিক আন্দোলন দেখেছে দেশবাসী। যে আন্দোলনের সুর, তাল দেখে সাবাস সাবাস ধ্বনিতে মুখরিত ছিল পুরো দেশ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, এমনকি দেশের গন্ডি পেরিয়ে এই আন্দোলনের সুবাতাস ছড়িয়ে পড়ে বহির্বিশ্বেও।  

এখন প্রশ্ন হচ্ছে সে সুবাতাসের ভবিষ্যৎ আভাস কি পেয়েছি আমরা? প্রথমত, আমি মনে করি যে সফলতাটা আমরা পেয়েছি সেটি হল, দাম্ভিক রাষ্ট্রযন্ত্রের নমনীয়তা। এছাড়া ষোল থেকে আঠারো’র পুঞ্জিভূত আবেগের কাছে দাম্ভিক রাষ্ট্রনায়কদের নম্রতা আর সতর্কতা দেশবাসীকে করেছে বিমোহিত। অতীত ইতিহাস এমন যে, ছাত্রদের এসব দাবি মেনে নেওয়া যেন অনেক বড় চিন্তার বিষয়, ভাবনার বিষয়, এমনকি প্রেস্টিজ ইস্যুও মনে করা হত। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। কোমলমতি এ শিক্ষার্থীদের নয় দফা দাবি মানতে নয় দিনও লাগেনি। রাষ্ট্রচালকদের কাছ থেকে এটাই দেশবাসীর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।  

দ্বিতীয়ত যা পেলাম তা হল, প্রতিদিনই আমরা যা দেখছি, যা দেখতাম, যা প্রতিদিন ঘটতো বা ঘটছে, যা নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যাথাই ছিলনা, শুধু সামান্য সমবেদনা কাজ করতো, তা হল, সড়ক দুর্ঘটনা। এ দুর্ঘটনাকে আমরা আর দশটা ঘটনার মতোই সাধারণ বিষয় মনে করতাম। কারণ প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল গুনতে গুনতে সড়ক দুর্ঘটনা এক প্রকার গা সওয়া হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু রাজধানীতে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন আমাদের বুঝিয়ে দিল সড়ক দুর্ঘটনা নিছক কোন ঘটনা নয়, এটা জাতীয় দুর্যোগই বলা চলে।  

সড়ক দুর্ঘটনা মানেই একটি প্রাণের বিপরীতে স্বজন হারানোর দীর্ঘশ্বাস, জন্মদাত্রী মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ, কারো ভাই হারানোর অনিঃশেষ বেদনা, দরদী বোনের গগনবিদারী আর্তনাদ সর্বোপরি একটি জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়া। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন এত বেশি মৃত্যুর সংবাদ শুনতে শুনতে, লাশ গুনতে গুনতে আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম এটা আমাদের দেশের সবচাইতে বড় দুর্যোগ।

এ বিষয়ে আমাদের বিবেক প্রায় বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েছিল, এ আন্দোলনে, শিক্ষার্থীদের আবেগ স্ফুলিঙ্গ আমাদের রাষ্ট্রচালক ও গাড়িচালকদের বিকলাঙ্গ বিবেককে জাগ্রত করতে পেরেছে। এটাই সফলতা। তবে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি রক্তপাতহীন, অস্ত্রবিহীন এক আন্দোলন। যা অতীত আন্দোলনে বাঙালি জাতি এই উপলব্ধি করতে পারেনি। দেশে প্রতিবাদ, আন্দোলন, দাবি আদায় মানেই ছিল- হামলা, পাল্টা হামলা, গ্রেফতার, লাঠিপেটা, অস্ত্রের ঝনঝনানি, এসব। শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে আমরা দেখেছি, যেন এক আবেগ যুদ্ধ, হাজার কোটি প্রাণের জমাটবদ্ধ বেদনার আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ।  

শেষে দেশবাসী যখন প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরপর ছাত্র-ছাত্রীদের দাবিগুলোর বাস্তবায়ন দেখছে, তখনি দেশবাসী বলতে শুরু করলো, এ যেন ভাঙলো কুম্ভ কর্ণের শীতনিদ্রা। দেশবাসী খুশি হয়েছে যখন শুনেছে ট্রাফিক পুলিশের পুলিশ সপ্তাহ ঘোষণা করা, যখন দেখেছে সড়কে সারিবদ্ধভাবে গাড়ি চলা, লাইসেন্স নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি হওয়া, সকলের মাঝে ট্রাফিক আইন নিয়ে শ্রদ্ধাবোধ, সড়কে ডিভাইডার দেওয়া। এ যেন চারিদিকে পরিবর্তনের সুবাতাস। সব কাজ যেন শিক্ষার্থীদের ৭ দিনের আন্দোলনের প্রসব অনুভূতি।  

তবে সব কথার শেষ কথা-‘সাবাস আঠারো.. সালাম তোমায়’  

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক

মফিজুল ইসলাম চৌধুরী

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়