Cvoice24.com


ধরা ছোঁয়ার বাইরে টেকনাফের সেই ‘ইয়াবা পরিবার’

প্রকাশিত: ১৫:২৬, ১২ নভেম্বর ২০১৮
ধরা ছোঁয়ার বাইরে টেকনাফের সেই ‘ইয়াবা পরিবার’

ছবি: ২০১৭ সালে উপ সচিবের গাড়ি ব্যবহার করে ইয়াবা পাচারের সময় ধরা পড়া রবিউল।

সম্প্রতি টেকনাফ থানায় ওসি প্রদীপ কুমার দাশ যোগদানের পর থেকেই ইয়াবার গেটওয়ে টেকনাফে আতঙ্ক শুরু হয়ে গেছে। গত ১৭ দিনে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে ৯ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী। কিন্তু এত কড়াকড়ির মাঝেও রাজার হালে থেকে যাচ্ছে টেকনাফের ভয়ংকর এক ‘ইয়াবা পরিবার’। 

পুলিশ, মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর এবং সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, টেকনাফে যে’কটি ইয়াবা পরিবার রয়েছে তারমধ্যে ছিদ্দিক আহমদের পরিবারটি অন্যতম। ছিদ্দিকের পরিবারের এমন কেউ বাকি নেই যে ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত নয়। সাবেক ইউপি সদস্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা গডফাদার হামজালালের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠা এই সিন্ডিকেটের প্রত্যেক সদস্যের বিরুদ্ধে একাধিক ইয়াবা মামলা ছাড়াও হত্যাসহ বিভিন্ন আইনে মামলা রয়েছে। তারপরও তারা টেকনাফে চলে রাজার হালে। মাদক কারবারী নিধনে এত অভিযান, এত আয়োজনের পরও ছিদ্দিকের পরিবারটি সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

কয়েকটি মামলা অনুসন্ধান করতে গিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কক্সবাজার-চট্টগ্রামের বড় মাপের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আর্থিক লেনদেন সম্পর্কে তথ্য চেয়ে করা আবেদনে যে’কটি নাম প্রথমে উঠে আসে তারমধ্যে ছিদ্দিকের পরিবারের কয়েকজন সদস্য রয়েছে। এরমধ্যে ছিদ্দিকের ছেলে রবিউল আলম অন্যতম। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র রবিউল আলমের বৈধ কোন আয়ের উৎস না পেলেও তার ব্যাংক একাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পায় পুলিশ।

পুলিশের তথ্যমতে, তাদের অনুসন্ধানে ছিদ্দিকের পরিবারের সব সদস্যের ব্যাংক হিসাবের তথ্য সংগ্রহ করে পুলিশ। এতে রবিউলের দুটি ব্যাংক হিসাবে জমার পরিমাণ ৮৩ লাখ টাকার বেশি। এ টাকার উৎস হিসেবে নেই কোন আয়কর নম্বর বা ট্রেড লাইসেন্স। পরিবারের অন্য সদস্যদের হিসাবেও অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পায় পুলিশ। যার পরিমাণ ৬ কোটি টাকার বেশি।   

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এক সময় লবণ বোঝাই ট্রলারের শ্রমিক ছিলেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নজিরের পুত্র ছিদ্দিক আহমেদ ওরফে ব্ল্যাক ছিদ্দিক। লবণ পৌছে দেওয়ার ফাঁকে চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ে। পরে বিষয়টি ট্রলার মালিক অবগত হওয়ার পর ছিদ্দিককে চাকরি থেকে বের করে দেয়া হয়। কিন্তু ততদিনে কিছুটা কালো টাকার মালিক বনে যান তিনি। এরপর শুরু করেন রেন্ট এ কার ব্যবসা। এখান থেকেই মূলত স্বপরিবারে ইয়াবা ব্যবসায় যাত্রা তাদের।

ইয়াবা ব্যবসা করতে গিয়ে অনেকবার হাতেনাতে দেশের বিভিন্ন থানায় গ্রেফতার হন ছিদ্দিক। ছিদ্দিকের বিরুদ্ধে ঢাকার শাহবাগ থানা, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানা, রামু থানা, লোহাগাড়া থানা ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে ইয়াবা মামলা রয়েছে। স্বপরিবারে ইয়াবা ব্যবসা করে অঢেল সম্পদের মালিক বনেছেন তিনি। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বেশ কয়েকটি নামে-বেনামে ফ্ল্যাট রয়েছে। টেকনাফে আলিশান বাড়ি করেছেন। 

ইয়াবার কালো টাকার প্রভাবে এক সময় মানুষের উপর অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে ছিদ্দিকের পরিবার। ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর নাজিরপাড়া এলাকায় জমি দখলে বাঁধা দেওয়ায় স্থানীয় আজিজুল হক মার্কিনকে দিনদুপুরে হত্যা করে তারা। এঘটনায় সাবেক ইউপি সদস্য হামজালালসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়। কিন্তু কালো টাকার প্রভাব বিস্তারের কারণে সেই মামলার এখনো কূল-কিনারা হয়নি।

অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যমতে, ইয়াবা ডন ছিদ্দিক আহমেদের পারিবারিক সিন্ডিকেটে আছেন তার স্ত্রী ইয়াবা কুইন রশিদা, ছিদ্দিকের দুই ছেলে রবিউল আলম ও ফরিদ আলম, ছিদ্দিকের ভাই ছৈয়দ আলম, ভাইপো জসিম ও শফিক, ছিদ্দিকের শালা সাবেক ইউপি সদস্য হামজালাল ও বাহাদুর। পুরো সিন্ডিকেটকে নেতৃত্ব দেন ছিদ্দিক আহমেদ ও তার শ্যালক হামজালাল। আর এই সিন্ডিকেটের সবচেয়ে বড়মাপের ব্যবসায়ী হলেন রবিউল আলম। 

     

                       ছবি: রবিউল আলম

পুলিশের দেওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে জানা গেছে, কোনো ধরনের বৈধ ব্যবসা না করেই কোটিপতি হয়ে গেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত ছিদ্দিকের ছেলে রবিউল আলম। গত পাঁচ মাসে তার ব্যাংক হিসাবে কোটি টাকার কাছাকাছি লেনদেন হয়েছে।

একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এতো টাকা আসলো কীভাবে? কী তার ব্যবসা? কোথায় পেলো মূলধন? একটি গাড়ির সূত্র ধরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে শুধু রবিউলই নয়, তার বড়ভাই ফরিদুল আলম, রাশেদুল আলম, বাবা ছিদ্দিক আহমদ ও ভাবী রায়হানা আক্তারের ব্যাংকেও পাওয়া গেছে অস্বাভাবিক লেনদেন।

চট্টগ্রামে ৫০ হাজার ইয়াবা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের একটি গাড়ি আটকের ঘটনার অনুসন্ধানে এসব তথ্য পেয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

চলতি বছরের ২৫ মার্চ কর্ণফুলী থানার পিএবি সড়কে চালকসহ সরকারি স্টিকার লাগানো একটি পাজেরো জিপ আটক করেছিল নগর গোয়েন্দা পুলিশ। জিপের মালিকের সন্ধান করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া রবিউল, তার ভাই ও বাবা সবাই ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত। জিপটির মালিক ফরিদুল। রবিউলদের পুরো পরিবারের ব্যবসাই ইয়াবা।

পরবর্তীতে তদন্ত করতে গিয়ে তাদের ব্যাংক হিসাবে এ কয় বছরে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা লেনদেনের সন্ধান মেলে। ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় রবিউল, তার ভাই ও বাবাসহ চার সহযোগীর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে চার্জশিট দিয়েছেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) শিবু দাশ চন্দ।

তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়েরের সুপারিশ জানিয়ে সিআইডির কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া রবিউল আল আরাফাহ ব্যাংক টেকনাফ শাখায় একটি হিসাব (নম্বর ১০২১১২০০২৯৩২৪) খোলেন ২০১৫ সালের ২৮ মে। চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত উক্ত হিসাবে লেনদেন হয়েছে ৫৩ লাখ ২৭ হাজার একশো ৮৭ টাকা।

একই ব্যাংকে গত ২৭ মার্চ খোলা একটি মুদারাবা হিসাবে (নম্বর-১০২১৩১৩৩৩৫৩৩৯) ৩০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। আয়ের উৎস হিসাবে জমির ব্যবসা দেখানো হলেও তার কোনো ট্রেড লাইসেন্স বা টিআইএন নম্বর নেই।               

রবিউল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্বের আড়ালে নগরীতে বসে কক্সবাজার থেকে পাঠানো ইয়াবা নগরীর বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতো। পথিমধ্যে পাজেরো জিপ কেউ আটক করলে নিজেকে সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে গাড়ি ছাড়িয়ে নিতো।

রবিউলের বিরুদ্ধে উখিয়া, টেকনাফ, রামু ও ঢাকার তেজগাঁও থানায় চারটি মামলা রয়েছে বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়। 

একইভাবে তার ভাই ফরিদুল আলমের নামে ইসলামী ব্যাংক টেকনাফ শাখায় দুটি, আল আরাফাত ব্যাংক টেকনাফ শাখায় তিনটি আলাদা আলাদা হিসাবে এক কোটি ৯০ লাখ তিন হাজার ৯১ টাকার লেনদেন হয়েছে। অধিকাংশ টাকা রাজধানীর নবাবপুর, রমনা, ইসলামপুর, গাজিপুর চৌরাস্তা ও নারায়ণগঞ্জ এলাকা থেকে পাঠানো হয়েছে।

চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, ফরিদ একজন পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী। নিজের পাজেরো জিপে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড ও সরকারি স্টিকার লাগিয়ে মনোনীত ব্যক্তিকে ভুয়া সরকারি কর্মকর্তা সাজিয়ে কক্সবাজার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা পাচার করত।

ফরিদুলের বিরুদ্ধে উখিয়া, কক্সবাজার, টেকনাফ ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় ছয়টি মামলা রয়েছে বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে।

                                  ছবি: ছিদ্দিক আহমদ

রবিউলের বাবা ছিদ্দিক আহমদের নামে আল আরাফাহ ও জনতা ব্যাংক টেকনাফ শাখার চারটি হিসাবে তিন কোটি ৬৬ লাখ ৮ হাজার ৯৪৭ টাকার লেনদেন হয়েছে। ছিদ্দিক আহমদের বিরুদ্ধে উখিয়া, টেকনাফ ও রামু থানায় ছয়টি মামলা রয়েছে।

শুধু তাই নয়, ফরিদুলের স্ত্রী রায়হানা আক্তারের নামে আল আরাফাহ ও জনতা ব্যাংক টেকনাফ শাখায় দুটি হিসাবে ১৮ লাখ ১৮ হাজার চারশো ৮৪ টাকার লেনদেন হয়েছে। ফরিদুলের আরেক ভাই রাশেদুলের নামেও জনতা ব্যাংক টেকনাফ শাখায় একটি স্কুল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর রয়েছে। যাতে দুই লাখ ১০ হাজার একশো ৫৫ টাকার লেনদেনের তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে রবিউল, ফরিদুল, স্ত্রী রায়হানা, ভাই রাশেদুল ও বাবা সিদ্দিক আহমদের হিসাবে এ কয় বছরে ছয় কোটি ৪০ লাখ ৩৭ হাজার টাকার লেনদেন হয়েছে।

গত ২৫ এপ্রিল উদ্ধার করা ৫০ হাজার ইয়াবা টেকনাফের শামসুল ইসলাম ওরফে শফিকুল ইসলাম, নুরু, সৈয়দ আহমদ ও আবুদল মালেকের কাছ থেকে নিয়েছিলেন রবিউলের বাবা ছিদ্দিক আহমদ। 

                           ছবি: হামজালাল

ছিদ্দিকের শ্যালক হামজালালের আপন ভাই ইউছুপ জালাল বাহাদুর (৩০) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী। এক সময় মোটর গাড়ির ড্রাইভার থেকে অঢেল টাকা সম্পত্তির মালিক বনে গেছে রাতারাতি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় নামে বেনামে সম্পত্তির পাহাড় রয়েছে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাবা হাজী খলিল ড্রাইভারের নামে তার মালিকানায় কয়েকটি ট্রাক, ডাম্পার, নোহা ও কার গাড়ি রয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা থাকা সত্ত্বেও অদৃশ্য কারণে রয়ে গেছে অধরা।

অভিযোগ আছে, স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে যোগসাজস করে ইয়াবা ব্যবসা করায় এত ধরপাকড়ের পরও বার বার পার পেয়ে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর এই ইয়াবা পরিবার। এমনকি প্রদীপ কুমার দাশের মতো ওসিরও নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে তারা। 

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, ইয়াবার সাথে জড়িত থাকলে এবং ইয়াবা মামলায় ওয়ারেন্ট থাকলে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

-সিভয়েস/এমডিকে/এমইউ

আজিম নিহাদ, কক্সবাজার

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়