Cvoice24.com


কবি জীবনানন্দ দাশ : জীবন ও সাহিত্য সাধনা

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ১২ নভেম্বর ২০১৮
কবি জীবনানন্দ দাশ : জীবন ও সাহিত্য সাধনা

কবি জীবনানন্দ দাশ।

কবি জীবনানন্দ দাশ ছিলেন একজন কাল সচেতন ও ইতিহাস সচেতন কবি। আধুনিক কাব্য কলার বিচিত্র ইজম প্রয়োগ ও শব্দ নিরিক্ষার ক্ষেত্রে ও তার অনন্যতা বিস্ময়কর। বিশেষত: কবিতার উপমা প্রয়োগে জীবনানন্দের নৈপুণ্য তুলনাহীন। কবিতাকে তিনি মুক্ত আঙ্গিকে উত্তীর্ণ করে গদ্যের স্পন্দন যুক্ত করেন,  যা পরবর্তী কবিদের প্রবল ভাবে প্রভাবিত করেছে। জীবন বোধকে নাড়া দিয়েছে। 

কবি জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের ১৭ ফ্রেব্রুয়ারী বরিশালে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন স্কুল শিক্ষক ও সমাজ সেবক। তিনি “ব্র‏হ্মবাদী” পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। মাতা কুসুম কুমারী ছিলেন একজন বিখ্যাত কবি। জীবনানন্দ দাশের বাল্য শিক্ষার সূত্রপাত হয় মায়ের কাছেই। তারপর তিনি বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৫ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯১৭ সালে ব্রজমোহন কলেজ থেকে আই, এ প্রথম বিভাগে এবং ১৯১৯ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজীতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। ১৯২২ সালে কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজী ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। জীবনানন্দ দাশ ১৯৩৫ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের কিছু আগে তিনি স্বপরিবারে কলকাতায় চলে যান। 

জীবনানন্দের কাব্যচর্চার শুরু অল্প বয়স থেকেই। স্কুলে ছাত্রাবস্থায় তাঁর প্রথম কবিতা “বর্ষ-আবাহন” ব্র‏হ্মবাদী পত্রিকায় (বৈশাখ ১৩২৬/এপ্রিল ১৯১৯ খ্রি:) প্রকাশিত হয়।

১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রস্থ “ঝরাপালক”। ১৯৩০ সালের ৯ মে বিয়ে করেন রোহিনী কুমার গুপ্তের মেয়ে লাবন্য গুপ্তকে। বিবাহিত জীবন তার মোটেই সুখের ছিল না। বিয়ের পর অনেকদিন কর্মহীন জীবন কেটেছে জীবনানন্দ দাশের। দু’টি সন্তান ছিল তাঁর মেয়ে মঞ্জুশ্রী ও ছেলে সমরানন্দ। জীবনানন্দ দাশ বৈষয়িক জীবনে কখনো সফলতা পান নাই। বার বার ভাবতেন আত্মহত্যার কথা। ভেবেছিলেন স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে সাগরে ডুবে মরবেন। সারাটা জীবন তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থান মনে করতেনা আমাদের এই বাঙলাদেশ কে। জীবনানন্দ দাশ কবি হলেও অসংখ্য ছোটগল্প কয়েকটি উপন্যাস ও প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন। জীবদ্দশায় তিনি এগুলি প্রকাশ করেন নাই। ঔপন্যাসিক ও গল্পকার হিসেবে জীবনানন্দের স্বতন্ত্র প্রতিভা ও নিভৃত সাধনার উম্মোচন ঘটে মৃত্যুর পরে প্রাপ্ত তাঁর অসংখ্য পা-ুুলিপিতে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল, সতেন্দ্রনাথ ও মোহিতলালের কাব্য ধারার প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী। 

তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রস্থ গুলি হচ্ছে ধূসর পা-ুলিপি (১৯৩৬ খ্রি:), বনলতা সেন (১৯৪২ খ্রি:), মহাপৃথিবী (১৯৪৪ খ্রি:) সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮ খ্রি:) রূপসী বাংলা (১৯৫৭ খ্রি:), বেলা অবেলা কাল বেলা, (১৯৬১ খ্রি:) এ ছাড়াও বহু অগ্রন্থিত কবিতা, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে মাল্যবনে (১৯৭৩ খ্রি:), সুতীর্থ (১৯৭৭ খ্রি:) জলপাই হাটি (১৯৮৫ খ্রি:) জীবন প্রণালী (অপ্রকাশিত), রাসমতির উপাখ্যান (অপ্রকাশিত) ইত্যাদি। তাঁর রচিত গল্পের সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। কবিতার কথা (১৯৫৫ খ্রি:) নামে তাঁর একটি মননশীল ও নন্দন ভাবনা মূলক প্রবন্ধ গ্রন্থ আছে। সম্প্রতি কলকাতা থেকে তার গদ্য রচনা ও অপ্রকাশিত কবিতার সংকলন রূপে ‘জীবনানন্দ সমগ্র’ (১৯৮৫ খ্রি:) নামে বারো খ- রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে। 

রবীন্দ্রনাথের (১৮৬১-১৯৪১ খ্রি:) নিবিড় প্রকৃতি চেতনা  তাঁর কবিতায় গভীর দ্যোতনা লাভ করেছে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা- পুরাণের জগৎ তাঁর কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্র রূপময়। বিশেষতঃ “রূপসী বাংলা” কাব্যগ্রন্থে যে ভাবে আবহমান বাংলার চিত্ররূপ ও অনুসুক্ষè সৌন্দর্য্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে তিনি রূপসী বাংলার কবি হিসেবে খ্যাত হয়েছেন। 

জীবনানন্দ দাশ আধুনিক বাংলা কবিদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য। তাঁর কবিতার চিত্রময়তা, যার সঙ্গে আমরা অনায়াসে ঘনিষ্ঠ বোধ করি। এটি তাঁর জনপ্রিয়তার অন্যতম একটি কারণ। যে প্রকৃতির বর্ণনা জীবনানন্দ করেন, বাস্তবে তাকে আমার আর খুঁজে পাই না। পাই না বলেই হয়তো হারানো সেই সৌন্দর্য্যকে আমরা নিজের ভেবে আর ও প্রবল ভাবে আকড়ে ধরি। অনেক সময় তাঁর উচ্চারিত শব্দ চিত্র আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। সম্রাট বিম্বিসার কে, বির্দভ নগর কোথায়, তা’না জেনেই মনে মনে নিজের মতো এক চিত্র ও ধ্বনির জগৎ আমরা গড়ে নেই। আগাগোড়া তাঁর কবিতার সুর বিষন্ন, সবচেয়ে উজ্জ্বল যে রং তাও ধূসর, অথচ তা’ সত্ত্বেও জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আমারা ব্যক্তিগত প্রণোদনার উৎস খুঁজে পাই। তবে প্রকৃতির পাশাপাশি জীবনানন্দের শিল্প জগতে মূর্ত হয়েছে, বিপন্ন মানবতার ছবি এবং আধুনিক নগর জীবনের অবক্ষয়, হতাশা, নিঃসঙ্গতা ও সংশয় রোধে জীবনানন্দ ছিলেন একজন সমাজ সচেতন কবি। তিনি ইতিহাস চেতনা দিয়ে অতীত ও বর্তমানকে অচ্ছেদ্য সস্পর্ক সূত্রে বেঁধেছেন। তার কবি স্বভাব ছিল অর্ন্তমুখী, দৃষ্টিতে ছিল চেতনা থেকে নিশ্চেতনা ও পরচেতনার শব্দ রূপ আবিষ্কারের লক্ষ্য। এ সূত্রে তিনি ব্যবহার করেছেন ইম্প্রেশনিস্টিক রীতি, পরাবাস্তবতা, ইন্দ্রিয় বিপর্যাস ও রঙের অত্যাশ্চর্য টেকনিক। জীবনানন্দ বাংলা কাব্য সাহিত্যের যে অজ্ঞাত পূর্ব ধারা আবিষ্কার করেছিলেন তা’ জীবনানন্দের সমকালীন সময়ে খুব কম কাব্য রসিক কিংবা নন্দন তাত্ত্বিকরা বুঝতে পেরেছিলেন। 

জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসে অভিব্যক্ত হয়েছে দাম্পত্য জীবনের সষ্কট, নরনারীর মনস্তত্ত্ব ও যৌন সম্পর্কের জটিলতা এবং সমকালের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর বিপর্যয়। তাঁর প্রায় গল্প উপন্যাস আত্ম জৈবনিকতার প্রকাশ ঘটেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে জীবনানন্দের কবিতার ভূমিকা ঐতিহাসিক। ষাটের দশকে বাঙালির জাতি সত্তা বিকাশের আন্দোলনে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংগ্রামী চেতনায় বাঙালি জনতাকে তাঁর “রূপসী বাংলা” তীব্রভাবে অনুপ্রাণিত করে। জীবনানন্দ ছিলেন আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ কবিদের তালিকায়। তাঁর বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থ “বনলতা সেন”  নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলনে ১৯৫৩ সালে পুরস্কৃত হন। জীবনানন্দের  “শ্রেষ্ঠ কবিতা” গ্রন্থটি ১৯৫৪ সালে ভারত সরকারের সাহিত্য আকাডেমী পুরস্কার লাভ করে। ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর কলকাতায় এক ট্রাম দূর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে জীবনানন্দ দাশ অকালে মৃত্যুবরণ করেন।

-সিভয়েস/এসএইচ

সিভয়েস ডেস্ক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়