Cvoice24.com


আগামী পৃথিবীর দায়

প্রকাশিত: ১৫:১৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮
আগামী পৃথিবীর দায়

ছবি : সিভয়েস

আট মাসের শিশু নিবিড়। এক কদম পা চলে না। মুখে তার কথার কদম ফোটেনি। চলতে পারে না কিন্তু তার বাড় থেমে নেই। বলতে পারে না, কিন্তু তার কোনো কিছু অব্যক্ত নেই। চলতে আর বলতে না পারার নিদারুণ অসহায়ত্ব তাকে করেছে সুন্দর। অস্পষ্ট বোলে অবিরাম নানা ধ্বনি সে বের করছে যার কোনো অর্থ নেই। সেই অর্থহীন ধ্বনিরও একটা অর্থ আছে। সেটি বোঝে তার মা। মুখে কোনো কথা নেই, কিন্তু মা ঠিকই বুঝে নেন তার কখন খিদে পায়, কখন সে বিরক্ত হয়, কখন সে খুশিতে ডগমগ। মা তার ভাব বুঝে সেই মতো ব্যবস্থা নেন। পৃথিবীর সব মাকে এভাবে বুঝতে হয়। এভাবে শিশুর অস্ফুট ভাষা বোঝার ক্ষমতা আয়ত্ব করতে হয়। নইলে তার সন্তান বড় হবে কীভাবে। 

শিশুর অক্ষমতার মধ্যে আমরা যে সৌন্দর্য উপভোগ করি, সেই সৌন্দর্য নিয়ে যেন সে বেড়ে উঠতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখেন তার মা, পরিবার। নিবিড়ের কোনো কষ্ট মা সহ্য করতে পারেন না। একটু কান্নাকাটি করলে অস্থির হয়ে পড়েন। বাড়ির উঠোনে একটি মুরগির পেছনে অনেকগুলো ছানা কেমন সুন্দর করে হাঁটছে। সেই ছানাগুলোকে কেউ হাঁটতে শেখায়নি। 

এতটুকুন হাঁসের ছানা, দেখবে মায়ের সঙ্গে কেমন পুকুরে সাঁতার কাটছে। তাদের কেউ সাঁতার শেখায় না। এমনি এমনি সাঁতার শিখে যায় তারা।কিন্তু আমাদের মানুষদের সব কিছু শিখতে হয়। কথা বলা থেকে শুরু করে হাঁটা চলা, সাঁতার কাটা থেকে শুরু করে জীবনে যা যা প্রয়োজন সবই আমাদের শিখতে হয়। যে যতবেশি শিখব, সে তত ভালো মানুষ হব। 
ছোটদের দেখভালের দায়িত্ব নেয় বড়রা, তারা বড়দের দেখে দেখে শেখে। কিন্তু যারা ছোট তাদেরও তো কিছু দায়িত্ব আছে। তাদের মনে রাখতে হবে আজকে যারা বড় হয়েছেন, বড় বিজ্ঞানী হয়েছেন, দার্শনিক হয়েছেন, বড় বড় নেতা হয়েছেন, বড় বড় চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, সরকারি অফিসের কর্তা ব্যক্তি হয়েছেন, তারাও একদিন ছোট ছিলেন। এসবের পাশাপাশি কেউ কেউ হয়েছেন বড় বড় শিল্পী, কবি, গায়ক, অভিনেতা। দেশজোড়া কিংবা পৃথিবীজোড়া নাম হয়েছে এরকম মানুষ তো একদিন ছোট ছিল। তারা নিজের নিজের জায়গায় বড় হল কীভাবে?  এই প্রশ্ন ছোটরা প্রায় করে থাকে। এই প্রশ্নের একটাই উত্তর। সেটা হল আমার নিজের কাজ ঠিকঠাকমতো করা। আমরা যারা এখনো ছোট আছি, মানে ক্লাস ফাইভ থেকে ধর টেন পর্যন্ত পড়ি। তাদের নিয়ে মা বাবারা খুব ভয়ে ভয়ে থাকে। বাবা মায়েরা চিন্তায় থাকেন ছেলে কোথাও গেল, কার সঙ্গে মিশছে, কোথাও কোন দুর্ঘটনায় পড়ল কিনা। তবে অভিভাবকেরা সবচেয়ে বেশি চিন্তা করেন ছেলে বা মেয়ে কাদের সঙ্গে চলাফেরা করছে তা নিয়ে। কারণ এই বয়সের ছেলেমেয়েদের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে তার বন্ধুরা। 

শিউলি নামে অষ্টম শ্রেণির এক মিষ্টি মেয়ে। সে সারাদিন বাবা অথবা মায়ের মুঠোফোনে গেইম খেলে। গেম খেলাটা তার নেশার মতো হয়ে গেছে। আগে বাবার ল্যাপটপে সে গেম খেলতো। সারাদিন মাথা উবু হয়ে সে থাকত খেলায় মত্ত। খাওয়া নেই, পড়া নেই, সারাদিন গেম আর গেম। সময় কোনদিকে গড়িয়ে যায় সে বুঝতে পারে না। বাড়িতে কোন অতিথি এলে সে খেয়াল করত না। কারো সঙ্গে ভালো করে কথাও বলত না। বাবা আর মা বুঝতে পারছে এটা ঠিক হচ্ছে না। সারাক্ষণ গেম খেলে খেলে যদি এভাবে সময় নষ্ট করে তবে সে তো মানুষ হবে না। এভাবে গেম খেলতে খেলতে যখন একদিন সময় চলে যাবে তখন তো আর কিছুই করার থাকবে না। কিন্তু সে কথা শিউলি বুঝত না। বাবা তাই ল্যাপটপটা ওর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখল। সেদিন সে খুব রাগ করল। খুব দুঃখ পেল সে। চুপি চুপি কান্না করেছে সে। মনে মনে সে বলেছে, ‘কী এমন অপরাধ করেছি আমি, সবাই আমাকে শুধু শুধু বকা দেয়। ল্যাপটপে গেম খেললে কী এমন ক্ষতি? আমি তো কারো ক্ষতি করছি না।’ 

মা তাকে বলল, তুই নিজের ক্ষতি নিজে করছিস। ‘কী ক্ষতি করছি আমি? ’ শিউলি নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে। কিন্তু কোনো উত্তর সে পায় না। এরকম মন খারাপ অবস্থায় তার ক’দিন গেল। পরে ল্যাপটপ না পেয়ে সে কখনো মায়ের, কখনো বাবার মুঠোফোন নিয়ে খেলতে শুরু করে। এই যে তার গেম খেলার একটা নেশা হয়ে গেল তাতে যে কী ক্ষতি হয়ে গেল সে বুঝল ক’দিন পরে। 

একবার পরিবারের সবাই মিলে গেল একটি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে। সেখানে তার বন্ধু রিতাও গেছে। রিতা শিউলির ক্লাসমেট। একই সঙ্গে পড়ে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে রিতা সবাইকে অবাক করে দিয়ে গিটার বাজিয়ে শোনাল। গিটারে সে দুইটা রবীন্দ্রসংগীতের সুর তুলল। গিটার বাজিয়ে যখন সে মঞ্চ থেকে নামল তখন ছোটবড় সবাই তাকে বাহবা দিল। শিউলির সঙ্গে তার দেখা হল।  শিউলি তাকে বলল, তুমি যে গিটার বাজাতে জান সেটা আমি তো জানতাম না। রিতা বলল, আমি তো মাত্র প্র্যাকটিস করি। আর কোনদিন প্রসঙ্গ আসেনি তাই বলিনি। 

শিউলি তার কাছে গিটার শেখার ইতিহাস জানল। প্রতি শুক্রবার আর শনিবার রিতা গিটার শিখতে যায়। আর প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে বাসায় প্র্যাকটিস করে। আর এভাবে সময় নষ্ট না করে একটা কিছু শিখেছে বলে সবাই তাকে আজ মর্যাদা দিল। রিতা যদি সারাদিন তার মতো মোবাইলে গেম খেলে খেলে সময় নষ্ট করত তাহলে কি সে শিল্পী হতে পারত? 

শিউলির ক্লাসে আরেকজন শিল্পী আছে, ওর নাম মিতুল, সে গান গায়। স্কুলের যে কোনো অনুষ্ঠানে, পয়লা বৈশাখ কিংবা কোন বড় আয়োজনে সে গান করে। মিতুল প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে গলা সাধে। তার প্রতিদিনের সাধনা একদিন তাকে খুব একটা বড় শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলবে। সবাই এটাই আশা করে। কারণ এরই মধ্যে সে অনেকের মন জয় করে নিয়েছে। কোন কিছুতে বড় হতে হলে তার জন্য তাকে শ্রম দিতে হবে। পৃথিবীতে যত নামকরা মানুষ আছে তারা কেউ কোনদিন এমনি এমনি বড় হয়ে যায় নি। সাধনায়, চেষ্টায়, একাগ্রতায় আর শ্রমে তারা বড় হয়েছেন।

তো বন্ধুদের এইসব সাফল্য শিউলিকে খুব ভাবিয়ে তুলল। মিছেমিছি কতটা সময় সে নষ্ট করল। একদিন সে বাবাকে বলল, বাবা আমাকে তুমি গিটার কিনে দাও। আমি গিটার শিখব। একথা শুনে বাবা মা খুব খুশি। যাক বাবা ভালো বন্ধু আছে বলেই শিউলির ভুল ভাঙল। 

শিউলির এই ঘটনা দিয়েই বোঝা গেল মা বাবারা কেন তাদের সন্তানের বন্ধুদের নিয়ে চিন্তা করে। বন্ধুরা যদি খেলোয়াড় হয় তবে সে খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। এই জন্য বন্ধু বাছাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু বন্ধু বাছাই নয়, ছোটদের কিন্তু অনেক দায়। তাদের মনে রাখতে হবে, তারা দিন দিন বড় হচ্ছে। জগতের নানা রকমের দায় তাদের মাথার ওপর দিয়ে আসবে।  আগামী দিনের পৃথিবীটা চালানোর জন্য তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। 

এই লেখার শুরুতে বলেছিলাম আট মাসের নিবিড়ের কথা। সেই নিবিড়ও দিনে দিনে বড় হয়েছে। নিবিড়ের জন্মদিনে তার বাবা ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে। চল কী লিখেছে একটু দেখা যাক।  

আজ আমার নিবিড়ের জন্মদিন। দিনে দিনে কখন সে বড় হয়ে গেল। লম্বায় সে এখন আমাকে এক ইঞ্চি ছাড়িয়ে গেছে। আমি একটা কথা নিবিড়কে অনেকদিন ধরে বলতে চাইছি। পারিনি। আজ তার জন্মদিনে বলে ফেলি। নিবিড়ের উচ্চতা এখন পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। এখন তো বয়স মাত্র ১৩। তার উচ্চতা আরও বাড়বে। লম্বা হবে আমার ছেলে। পঞ্চম শ্রেণি, আর অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষায়ও সে ভালো করেছে। সামনের পরীক্ষাগুলোতেও যদি সে নিয়মিত পড়ালেখা করে তবে ভালো করবে। এখন অনেকে  ভাবে, পড়লেখা করে  ভালো আয় উপার্জন হয় এরকম একটি ক্যারিয়ার গঠন করতে যে পারে সেই সত্যিকারের সফল মানুষ। 

অর্থসম্পদ ও নাম যশের পেছনে মানুষ এখন পাগলের মতো ছুটছে। নিবিড় তুমিও ছুটবে। কিন্তু পাগল হয়ে নয়। দিন দিন তোমার শরীরের উচ্চতা যেমন বাড়ছে, তেমনি তোমার মানবিক উচ্চতাও বাড়তে হবে। তার জন্য কী করতে হবে? সত্যিকারের জ্ঞান তোমাকে অর্জন করতে হবে। জ্ঞান পাবে কীভাবে? প্রকৃতির কাছে গিয়ে। মানুষের সাথে মিশে। মজার মজার বই পড়ে।গান শুনে। ভাল সিনেমা দেখে। মানুষের কথা ভেবে। পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস পড়ে। 

তোমার মনটা কী কখনো কোন অবহেলিত শিশুর জন্য কাঁদে? তুমি কি ফিলিস্তিনী শিশুদের কথা কোনদিন ভেবেছো? যারা নিজের মাতৃভূমিতে থেকেও কত কষ্টের মধ্যে আছে। এরকম দেশের কথা, পৃথিবীর কথা তোমার মনে স্বয়ংক্রিয় ভাবেই আসতে হবে। তুমি কী কখনো রাতের আকাশে অনেকগুলো তারা দেখে অবাক হয়েছো? তুমি কি কখনো গভীর মনযোগ দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত শুনেছো? তোমার মনে পড়ে? ছোটবেলায় তোমাকে আমি রবীন্দ্রনাথের ‘কি সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছো’ গানটি শোনাতাম। তুমি বার বার বলতে বাবা জোনাকির গান শোনাও। ক্যারিয়ার গড়বে, সাথে সাথে নিজের মনের উচ্চতাও বাড়াবে। এবারের জন্মদিনে তোকে অনেক উপদেশ দিয়ে ফেললাম। 

উপদেশ শুনতে ছোটদের একেবারেই ভালো লাগে না। বড়রা মনে করে ছোটরা উপদেশের ভাণ্ড। তাদের দেখলেই কিছু উপদেশ দিয়ে দেয় সবাই। ছোটরা তাই উপদেশ পছন্দ করে না। নিবিড়ও পছন্দ করে না। কিন্তু এবারের বাবার স্ট্যাটাসটা তার খুব ভালো লেগেছে। আর এই স্ট্যাটাসে প্রচুর মানুষ লাইক দিয়েছে। নিবিড় ভাবে বাবার কথামতো চললে তাকেও সবাই লাইক করবে।  

সিভয়েস/এসএ/এমইউ

ওমর কায়সার

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়