Cvoice24.com

হঠাৎ ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধি সাড়ে ৫ গুণ

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৬:৫৯, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১
হঠাৎ ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধি সাড়ে ৫ গুণ

কিডনি ডায়ালাইসিস

বৃহত্তর চট্টগ্রামের কিডনি রোগীদের জন্য সরকার পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি)-এর আওতায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস করার জন্য ৩১ টি ডায়ালাইসিস মেশিন স্থাপন করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী ২০টি মেশিনের মাধ্যমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নির্বাচিত গরীব অসহায় মুক্তিযোদ্ধা এরকম ৪০ জন রোগীকে দৈনিক ৪৮৬ টাকা করে ডায়ালাইসিস দেওয়ার কথা। বেশ কবছর ধরে সেরকমই দিয়ে আসছিল ভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্যান্ডর মেডিকেইডস (প্রা.) লিমিটেড। রোগী প্রতি বাকি ২ হাজার ১৮০ টাকা ভর্তিুকি দিচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। 

কিন্তু বুধবার থেকে হঠাৎ করেই স্যান্ডর মেডিকেইডস (প্রা.) লিমিটেড তাদের স্বাভাবিক স্বচ্ছল রোগীদের মত টাকা নেওয়া শুরু করেছে বিশেষ ব্যবস্থায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নির্বাচিত রোগীদের কাছ থেকেও। হঠাৎ করে ৪৮৬ টাকার বদলে এক লাফে ২৬৬৬ টাকা ফি নেওয়ার কথা শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে আসা রোগীদের। বুধবার থেকেই এ নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন রোগীরা। তাদের দাবির সাথে একাত্মতা জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। বিষয়টি নিয়ে স্যান্ডর মেডিকেইডস ও চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখন হাজির হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। সেখান থেকেই এর সুরাহা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে রোগীদের। 

চমেক হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় হাসপাতালের নিচতলায় চালু করা হয় ৩১ বেডের স্যান্ডর ডায়ালাইসিস কেন্দ্র। সেখানে হাসপাতাল থেকে রেফার করা রোগীরা ৪৮৬ টাকায় ডায়ালাইসিস সেবা পান। সরকারের সঙ্গে স্যান্ডরের চুক্তি অনুযায়ী প্রতিবছর হাসপাতালের রোগীরা স্বল্প দামের ১০ হাজার সেশন পান। ৩১ বেডের এই সেন্টারে ২০ টি বেড হাসপাতাল থেকে রেফার করা রোগীদের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা চুক্তি অনুযায়ী। সেসব রোগী প্রতি সরকার ভূর্তিকিও দিচ্ছে ২ হাজার ১৮০ টাকা। 

বর্তমানে হাসপাতালের কিডনি বিভাগে ৯টি ডায়ালাইসিস মেশিন রয়েছে। এসব মেশিনে দৈনিক দুজন করে মোট ১৮ জন রোগীর ডায়ালাইসিস করা সম্ভব হয়। কিন্তু রোগী আসে এর ছয়গুণ বেশি। ফলে তাদের অন্তহীন ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়। সেকারণে সরকার বৃহত্তর চট্টগ্রামের কিডনি রোগীদের জন্য সরকার পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি)-এর আওতায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস করার জন্য ৩১ টি ডায়ালাইসিস মেশিন স্থাপন করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি ১০ বছর পর ব্যবসা গুটিয়ে পুরনো যন্ত্রপাতি হাসপাতালকে দিয়ে যাবে। 

চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসাপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান ডা. প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, ‘রোগীর তুলনায় আমাদের সুবিধা অনেক কম। অনেকে কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস দরকার হলেও সুযোগের অভাবে দিতে পারছে না। ফলে সরকারের সঙ্গে স্যান্ডরের ১০ বছরের চুক্তিতে শর্ত অনুযায়ী হাসপাতালের রেফার করা রোগীদের মাত্র ৪৮৬ টাকায় ডায়ালাইসিস করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।’ 

হঠাৎ ডায়ালাইসি ফি বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে চরম বেকাদায় পড়েছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। তাদের একজন মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জের বাসিন্দা প্রফুল্ল কুমার নাথ। ২১ বছর ধরে তিনি নিয়মিত ডায়ালাইসিসি করছেন। দুই পোশাক কর্মী মেয়ের বেতেনের ওপর নির্ভর করে মাসে ৮ বার কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হয় তাকে। ডায়ালাইসিস প্রতি তিনি দিতেন ৪৮৬ টাকা। এখন তাকে দিতে হচ্ছে ২৬৬৬ টাকা। ফলে এতো টাকা ব্যয় করার সামর্থ না থাকায় প্রফুল্ল কুমার নাথ ডায়ালাইসিস না করেই ফিরে যান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে। 

শুধু তিনি নন, অবসরপ্রাপ্ত সাবেক সেনা কর্মকর্তা মোজাম্মেল হকও ডায়ালাইসিস না করে ফেরত যান হাসপাতাল থেকে। তাদের মত অনেকেই ফেরত গেলেও অনেকে ধার দেনা করে বাড়তি দামে ডায়ালাইসিস করাচ্ছেন। এই বাড়তি  ফি বাদ দিয়ে আগের মত ফি নেওয়ার জোর দাবি তাদের। রাউজান থেকে এসে স্বজনের নিয়মিত হাসপাতালের কিডনি সেন্টারে ডায়ালাইসিস করাতে আসা লাকী আক্তার বলেন, ‘শুধু ডায়ালাইসিস এর খরচ দিয়ে শেষ নয়, রক্ত ও আইরনের ইনজেকশনের খরচ, খাবারের খরচ এবং গাড়ি ভাড়া তো আছেই। এত খরচ বহন করে চিকিৎসা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই দ্রুত আগের মত ৪৮৬ টাকা করতে হবে।’ 

একইভাবে হাটাহাজারীর আমান বাজার থেকে এসে অসুস্থ স্বামীর কিডনি ডায়ালাইসিস করান শামীমা আক্তার। গত তিন মাস ধরে বাড়ি থেকে চমেক হাসপাতালে ছুটাছুটি করে যাচ্ছেন তিনি। শামীমা বলেন, ‘যে ইনকাম করবে তারই তো অসুখ হয়ে গেছে, কিভাবে এত খরচ বহন করবো। যে ইনকাম করে সে যদি পড়ে যায় কিভাবে চলবে পরিবার।’ একই সুরে নিজের অসহায়ত্বের কথা জানান কক্সবাজার থেকে মামাকে নিয়ে দীর্ঘ ৮ মাস ধরে চমেক হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস করার জন্য আসা যাওয়া করা সরওয়ার।

জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর সিভয়েসকে বলেন, ‘কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টারটি সরকারের সাথে পিপিপির আওতায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান “স্যান্ড” পরিচালনা করে। তারা চুক্তি অনুযায়ী আমাদের রেফার করা রোগীদের কাছ থেকে ৪৮৬ টাকার বেশি নিতে পারবে না। কিন্তু হঠাৎ করে ফি বাড়ানোর কারণে রোগীরদের কষ্ট হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমি হেলথের ডিজি মহোদয়কে জানিয়েছি। ডিজি অফিস থেকে তাদেরও (স্যান্ড) ডেকেছে। এখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ে গাইড লাইন দেওয়া হবে। আমার অবস্থান পরিস্কার কোনও ভাবেই বর্ধিত ফি নিতে পারবে না। এতো গরীব অসহায় ও মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় যাবে।’ 

ডায়ালাইসিস কী?

ডায়ালাইসিস একটি বিকল্প রক্ত পরিষ্কার পদ্ধতি। যার মাধ্যমে রক্তের দূষিত ও ক্ষতিকর পদার্থ এবং অতিরিক্ত পানি প্রস্রাব আকারে বের করে দেয়া যায়। সুস্থ মানুষের দেহে কিডনি এমনিতেই এ কাজগুলো করে থাকে কিন্তু যখন কিডনি বিকল হয় বা রক্ত পরিশোধন করার ক্ষমতা হারায় অথবা ক্ষমতা কমে যায়, তখন রক্ত পরিশোধনের জন্য ডায়ালাইসিস করতে হয়। অনেকে মনে করেন, শুধু দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে আক্রান্তদের ডায়ালাইসিস লাগে কিন্তু হঠাৎ করে যে কারো ডায়ালাইসিস লাগতে পারে যদি অ্যাকিউট কিডনি ফেইলিওর হয়।
 
সুস্থ মানুষের দেহে খনিজ ও পানির ভারসাম্য বজায় রাখে কিডনি। রক্তকণিকা তৈরির জন্য অতি আবশ্যক ইরাইথ্রোপয়েটিন ও কোলসিট্রায়াল হরমোনও উৎপাদন করে। ডায়ালাইসিস পদ্ধতিতে রক্ত পরিষ্কার হয় কিন্তু হরমোন উৎপাদন হয় না।

ডায়ালাইসিস কেন প্রয়োজন?

প্রতিদিন সুস্থ মানুষের দুটি কিডনি দেড় হাজার লিটার (রক্ত ২৪ ঘণ্টা কিডনির ভেতর দিয়ে বারবার যায় বলে রক্তের মোট পরিমাণ এত বেশি) রক্ত পরিশোধনের কাজ করে। যদি কিডনি রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে না দিত, তবে মানুষ বাঁচতে পারত না। যদি কারো কিডনি রক্ত পরিশোধনের কাজ করতে না পারে বা যথেষ্ট পরিমাণে করতে ব্যর্থ হয়, তখন ক্ষতিকর বর্জ্য রক্তে জমতে থাকে। যদি এসব পদার্থের পরিমাণ বেশি বেড়ে যায় তবে রোগী ধীরে ধীরে কোমায় চলে যায়। এমনকি মৃত্যুবরণ করে। তাই কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা কিডনির অসুখ হলে অনেক সময় ডায়ালাইসিস অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

ডায়ালাইসিসের ধরন

ডায়ালাইসিস প্রধানত দুই ধরনের। হিমোডায়ালাইসিস ও পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস। কী ধরনের ডায়ালাইসিস কার জন্য প্রযোজ্য হবে তা নির্ভর করে রোগীর ওপর। সাধারণত এক ধরনের ডায়ালাইসিস সব রোগীকে করা হয় না।
হিমোডায়ালাইসিস। এটি মেশিনের মাধ্যমে করতে হয়। এ ক্ষেত্রে রোগীর রক্ত শরীরের বাইরে স্থাপিত মেশিনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। মেশিন শুধু বর্জ্য পদার্থ রক্ত থেকে বের করে নেয়। ক্যাথেটারের মাধ্যমে শিরাপথের রক্ত মেশিনে যায়, পরিশোধন হয়ে অন্য ক্যাথেটারের মাধ্যমে আবার শরীরে আসে। সাধারণত সপ্তাহে তিন থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত হিমোডায়ালাইসিস করতে হয়। প্রতি সেশনে কতটা সময় করতে হবে তা নির্ভর করে রোগীর কিডনির অবস্থার ওপর। কিছু ক্ষেত্রে রোগীর হিমোডায়ালাইসিস বাড়িতেও করা সম্ভব। যেমন, ডায়ালাইসিস করার সময় যে রোগী সুস্থ থাকে বা অবস্থা পরিবর্তিত হয় না, যখন রোগীর অন্য কোনো অসুখ না থাকে।

ডায়ালাইসিস কিন্তু কিডনির বিকল্প নয়

ডায়ালাইসিস করে রক্ত থেকে দূষিত কিছু পদার্থ বের করা যায় কিন্তু এটা কিডনির অন্যান্য কাজ করতে পারে না। ডায়ালাইসিসের রোগীদের পানি ও তরল পানে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। সব ধরনের খাবার খাওয়া যায় না। কিছু ওষুধও সেবন করতে হয়। তবে ডায়ালাইসিসের রোগীরা অন্যান্য স্বাভাবিক কাজ করতে পারে। নারী হলে সাধারণত গর্ভধারণ না করার পরামর্শ দেয়া হয়। তবে এ অবস্থায় গর্ভধারণ করলে বেশি বেশি ডায়ালাইসিস করে রক্ত দূষিত পদার্থমুক্ত রাখতে হয়।

কিডনি ফেইলিওরের লক্ষণ

সাধারণত কিডনি হঠাৎ করে বিকল হয়ে যায় না। সময় নিয়ে ধীরে ধীরে হয়। এমনকি একটি কিডনি যদি ঠিক থাকে বা দুটি কিডনিই কিছু না কিছু ঠিক থাকে, তাহলে কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। সাধারণত কিডনির অর্ধেকের বেশি নষ্ট হলে কিডনি বিকলের কিছু লক্ষণ দেখা যায়। আবার সবার ক্ষেত্রে একই লক্ষণ থাকেও না। নিচের লক্ষণগুলো থাকতে পারে। অতিরিক্ত দুর্বলতাবোধ বা কাজকর্ম না করলেও শরীর দুর্বল লাগা। বারবার প্রস্রাবের বেগ হওয়া। বিশেষ করে রাতে। যতদিন যায় প্রস্রাবের বেগ ঘন ঘন হয়। ত্বকে চুলকানি। বমি ও বমি-বমি ভাব। শ্বাস নিতে অসুবিধা হওয়া।
ইরেকটাইল ডিসফাংশন বা পুরুষাঙ্গ উত্থানের সমস্যা। হাত-পা-পেটে পানি জমা। প্রস্রাবে রক্ত ও প্রোটিন যাওয়া।
কিছু ক্ষেত্রে হঠাৎ করেও কিডনি বিকল হতে পারে। সাধারণত আঘাতের কারণে এমন হয়। কিডনি বিকল যাদের হয়, তাদের অনেকের অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা রোগও হয়। কারণ কিডনি ইরাইথ্রোপোয়েটিন নিঃসরণ করতে পারে না। তখন রক্তকণিকা তৈরি হতে বাধা পায়।

ডায়ালাইসিসের খরচ

ডায়ালাইসিসে ভালো থাকতে হলে সপ্তাহে দুইবার প্রয়োজন হয়। প্রতি ডায়ালাইসিসে গড়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতে খরচ পড়ে ৫০০-৭০০ টাকা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খরচ পড়ে অনেক। এখানে প্রতি ডায়ালাইসিসের খরচ ৪০০০-৫০০০ টাকার মতো খরচ হয়।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়